শিশু শ্রম
সূচনা
শিশুদের দুঃখকষ্টের কথা ভেবে ব্যথাতুর হৃদয়ে সুকান্তকে বলতে হয়েছিল- ‘সবচেয়ে খেতে ভাল মানুষের রক্ত’। মানুষ আজ লোভী পশুদের মতোই মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। মানুষের অর্থলালসার রাজ্যে শিশুদেরও মুক্তি নেই। শিশুদের কলকারখানার শ্রমিকবৃত্তিতে নিয়োগ করে এক শ্রেণির স্বার্থান্ধ মানুষ প্রচুর মুনাফা অর্জন করে চলেছে। আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তারা তাদের কাজ হাসিল করে চলেছে। ক্রিশ্চিনা রসেটি শিশু শ্রম সম্পর্কে তাঁর করুণ আর্তি ব্যক্ত করেছেন তাঁর লেখা- ‘Cry of the Children’-এ।
শিশুদের শ্রমিকবৃত্তিতে নিয়োগ ও নৃশংসতা
শিশুদের শ্রমিকবৃত্তিতে নিয়োগ প্রাচীনকাল থেকেই চলে এসেছে। বর্তমানে সভ্যদেশসমূহে মানুষ যেখানে বিবেকশক্তি ও স্বাধীনতাবোধের বড়াই করে, সেখানেও কেন থাকবে মানবাত্মার অপমান ও নির্লজ্জতার এই উদাহরণ। সারাদিন চৌদ্দ থেকে ষোল ঘণ্টা পরিশ্রম করে ঐ শিশু শ্রমিকটি উপার্জন করে যা আয় করে, তাতে তার নিজের আহারের সংস্থানও হয় না। অদক্ষ শ্রমিক বলে তাদের নেই নির্দিষ্ট মজুরি; অথচ তাদের ওপর চলে অকথ্য নিপীড়ন। সামান্যতম অমনোযোগের অভিযোগে লাথি ও বেত্রাঘাত সহ্য করতে হয়। এসব শিশু শ্রমিকের চোখের জলের হিসাব হয়তো পৃথিবীর সভ্য সমাজে রাখার সময় নেই। এ হাজার হাজার শিশুর কান্না ও তাদের লবণাক্ত অশু আজকের পৃথিবীকে যে ভাবিয়ে তুলেছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
আরও পড়ুন:
বসন্তকাল রচনা ক্লাস 6, 7, 8 (১০০% কমন)
শিশু শ্রমিকের বৃত্তি
বাংলাদেশে বিভিন্ন কলকারখানায় এবং গৃহস্থালিতে দশ বছরের নিচে শিশু শ্রমিকের সংখ্যাও কম নয়। ইদানীং আন্তর্জাতিক চাপে গার্মেন্টস শিল্পে কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা কমিয়ে প্রায় শূন্যের কোঠায় আনা হয়েছে। তবে বেশসংখ্যক শিশু শ্রমিককে হোটেল- রেস্তোঁরায় বয়-এর কাজ করতে হয়। চাষের কাজ ছাড়াও এদের দিয়ে আতসবাজী, দিয়াশলাই কারখানায় কিংবা কাচ ও পুঁতির কারখানায় কাজ করানো হয়। সমুদ্রবন্দর এলাকায় শিশু শ্রমিকদের জোর করে মাফিয়া চক্রান্তে লিপ্ত করানো হয়। এছাড়া এদের চুরি, ছিনতাই, ভিক্ষাবৃত্তি প্রভৃতি কাজে লাগিয়ে এক শ্রেণির সমাজবিরোধী লোক প্রচুর অর্থ উপার্জন করে। এ উদ্দেশে প্রচুরসংখ্যক শিশু অপহরণ করে পার্শ্ববর্তী দেশসহ অন্যান্য দেশে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণ
আমাদের দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী লোকের সংখ্যা শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ। এরা দারিদ্র্যের জ্বালায় নিজেদের সন্তানদের শিশু-শ্রমিকের বৃত্তি নিতে বাধ্য করে। এছাড়া জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সমআর্থিক বণ্টনের প্রতিক্রিয়ার ফলে শিশু শ্রম সমস্যা জটিল আকার ধারণ করছে। রাজনৈতিক বিপর্যয়, সাম্প্রদায়িকতা, উদ্বাস্তু জীবনের ছিন্নমূলতা, উচ্ছৃঙ্খল পিতামাতার নৃশংস আচরণ প্রভৃতিও এ সমস্যার জন্য অনেকাংশে দায়ী। পরিবারের আয়তনও এ সমস্যার অন্যতম প্রধান কারণ। এক একটি দম্পতির যেখানে অনেকগুলো সন্তান, সেখানে পরিবারের ভরণপোষণের জন্য শিশুদের রোজগার যুক্ত না হলে চলে না, ফলে সমস্যা ক্রমাগত বেড়েই যায়।
শিশু শ্রম প্রতিরোধ
বাংলাদেশে ‘শিশু ও নারী নির্যাতন আইন-১৯৯৫ বলবৎ থাকলেও এ সমস্যার সমাধান সম্ভব হয় নি। আসলে আইন দিয়ে সমস্যার বাস্তব সমাধান সম্ভব হয় না। উপযুক্ত শিক্ষার প্রসার এবং দারিদ্র্য বিমোচন ছাড়া সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। শিশু শ্রমিকের পুনর্বাসনের দায়িত্ব যেমন সরকারকে গ্রহণ করতে হবে, তেমনি এ ব্যাপারে সমাজকল্যাণমূলক সংস্থাসমূহকে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। শিশু শ্রমিক জাতির অভিশাপ : একজন বিশেষজ্ঞ এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘শিশু শ্রমিক প্রধানত আমাদের জাতির জন্য একটি অভিশাপ’। শিশু শ্রমের মূল কারণ দারিদ্র্য। দেশের একাংশের অপরিসীম দারিদ্র্যই এজন্য দায়ী। শিশু শ্রমিক প্রথা রদ করার জন্য আরও আইন প্রণয়নের দরকার।
শিশু নির্যাতন
বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে বিত্তবানদের গৃহে শিশু নির্যাতন হচ্ছে। এ সকল গৃহে কাজের মেয়ে হিসেবে যারা কাজ করে তাদের সামান্য অপরাধের জন্য পশু আত্মা গৃহিণী বা গৃহস্বামী অমানবিক শাস্তি দিয়ে থাকে। প্রায় প্রতিদিনই এ ধরনের নৃশংস ঘটনা খবরের কাগজে প্রকাশ পাচ্ছে। শিশুদের (শ্রমিক) প্রতি বিত্তশালী গৃহিণীদের অমানবিক ব্যবহারের কাহিনী পড়ে দেহ ও মন শিহরিত হয়ে ওঠে। এরা সহায়সম্বলহীন কাজের ছেলেমেয়েদের মানুষের সন্ধান বলে মনে করে না। এদের হাত থেকে শিশুদের রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। এছাড়াও কলকারখানাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রতিনিয়ত শিশু শ্রমিকেরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এর অবসান একান্ত জরুরি। অন্যথায় বিশ্বমানবতা ভূলুণ্ঠিত হয়ে পড়বে।
উপসংহার
আন্তর্জাতিক শিশুবর্ষের (১৯৮৯) প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও শিশু শ্রম সমস্যার সমাধান সম্ভব হয় নি। মানবতার নিদারুণ সঙ্কটের দিন ঘনিয়ে আসবে সেদিন যেদিন পৃথিবীর আলোয় শিশুমনেরও স্থান হবে না। শিশুর মনকে যেখানে নৃশংস পিশাচের দল অর্থলালসায় মত্ত হয়ে বন্দি করতে চায়, সেখানে জীবন হয়ে ওঠে ক্লেদাক্ত, সেই জীবন মূল্যহীন, অসার। পৃথিবীকে বধ্যভূমিতে পরিণত করার এ মনোভাবকে পরিবর্তিত করতেই হবে যেকোনো মূল্যের বিনিময়ে। তবে আশার কথা হচ্ছে, ‘শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য’ কর্মসূচি বাস্তবায়নের ফলে ইতোমধ্যে অনেক দরিদ্র পিতামাতাই তাদের সন্তানদের কর্মস্থলের পরিবর্তে বিদ্যালয়ে পাঠাতে শুরু করেছেন।