হেমন্তকাল
ভূমিকা
বাংলাদেশের ঋতুনাট্যের চতুর্থ কুশীলব হেমন্তকাল । হেমন্তের নেই শরতের বর্ণৈশ্বর্য, আছে সুদূর ব্যান্ত এক বৈরাগ্যের বিষণ্ণতা। হেমন্তলক্ষ্মী ধূম্র কুয়াশায় নয়ন ঢেকে ফসল ফলাবার নিঃসঙ্গ সাধনায় থাকে নিমগ্ন। ক্ষেতে খামারে রাশি রাশি ভারা ভারা সোনার ধান উঠতে থাকে। চারদিকে অন্তহীন কর্মব্যস্ততা। প্রাচুর্যময়ী হেমন্তের ফুলের বাহার নেই, সৌন্দর্যের জৌলুস নেই, রূপসজ্জারও প্রাচুর্য নেই, আছে মমতাময়ী নারীর এক অনির্বচনীয় কল্যাণী রূপশ্রী। সে আমাদের ঘর সোনার ধানে ভরে দিয়ে শিশিরের নিঃশব্দ চরণে বিদায় গ্রহণ করে।
আরও পড়ুন: পরিবেশ সংরক্ষণে বনায়ন রচনা
হেমন্তকালের বৈশিষ্ট্য
পঞ্জিকার হিসাব অনুসারে কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাস মিলে হেমন্তকালের পরিধি। কিন্তু পঞ্জিকার পাতা উল্টিয়ে হেমন্তের আগমন ঘটে না। সে আসে শরতের পায়ে পায়ে। প্রস্থান করে শীতের পদধ্বনি শুনতে শুনতে। বর্ষার প্রচুর পানি পেয়ে প্রকৃতি সতেজ হয়ে ওঠে। শরতের মাঝে তার যথাযথ প্রকাশ। শরতের মন ভোলানো রূপের পশরার মাঝেই হেমন্তের শুভ আগমন ঘটে। হেমন্তের বৈশিষ্ট্য তার ফসল ভরা মাঠে নিহিত। দেশের মানুষের আগামীদিনের সম্ভাবনা নিয়ে আসে হেমন্ত। মাঠে মাঠে পাকা ধানের সীমাহীন সমারোহ। মাঠ ভরা ফসলের উপহার নিয়ে আসে হেমন্ত। বাংলাদেশের প্রকৃতি তখন নতুন সাজে সেজে ওঠে। তার মধ্যে যেন পরিপূর্ণতা। আকাশে বাতাসে ফসলের মন জুড়ানো গন্ধ যেন ভেসে বেড়ায়। অনেক আশায় মানুষ মাঠে যে শ্রম দিয়েছিল তার ফল পায় ফসল হিসেবে এ সময়ে। আশার পূরণ ঘটে এ সময়ে। ফসল পেয়ে কৃষকের মুখে যে হাসি ফুটে ওঠে তা ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র দেশে। হেমন্ত আমাদের এই সমৃদ্ধি দেয়, আনন্দ দেয়, জীবনকে করে তোলে সুখকর। তাই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন-
“ভূমিগর্ভে আপনার দাক্ষিণ্য ঢাকিলে সাবধানে।
স্বর্গলোক ম্লান করি প্রকাশিলে ধরার বৈভব
কোন মায়ামন্ত্রগুণে, দরিদ্র্যের বাড়ালে গৌরব।”
হেমন্ত ফসলের ঋতু
বর্ষায় যে শস্য উৎপাদনের আয়োজন শুরু হয়, শরতের সম্ভারে তা সার্থক হয়ে ওঠে। আর হেমন্ত তা মানুষের হাতে তুলে দিয়ে বরণ করে নেয় চরম রিক্ততা। হেমন্তের জীবন ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল। ঘরে ঘরে ফসলের সওগাত বিলিয়ে দেওয়ার জন্যে তার আগমন ও অবস্থান। নিজেকে উজাড় করে দেওয়াই যেন তার মহান ব্রত। নিজেকে নিঃস্ব করে দেওয়ার মধ্যেই তার স্বার্থকতা। সে জন্যে কোনো পুরস্কারের প্রত্যাশা সে করে না। সে বিনম্রভাবে আপন কর্তব্য সম্পাদন করে অপেক্ষা করতে থাকে শীতের কুজঝটিকার আড়ালে বিদায় নেবার জন্যে। হেমন্ত নতুন ধানের নবান্ন মানুষের হাতে তুলে দেয়। নতুন শাকসবজির পসরা বহন করে আনে মানুষের দুয়ারে। মানুষকে বাঁচাবার উপকরণ হাতে তুলে দিয়ে সে বিদায় নেয়। তাই হেমন্তে কৃষকের মুখে ফোটে আনন্দের হাসি। হেমন্ত ঋতু তাই পার্থিব জীবনে আশীর্বাদস্বরূপ। এজন্যেই কবি বলেছেন-
“ধরার আঁচল ভরে দিলে
প্রচুর সোনার ধানে।
দিগঙ্গনার অঙ্গন আজ
পূর্ণ তোমার দানে।”
হেমন্তের সৌন্দর্য
বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত। নামেও যেমন এদের বৈচিত্র্য, রূপে প্রকৃতিতেও বিচিত্রতা নিয়ে তারা দেখা দেয়। এদেশের মানুষের জীবনে ও প্রকৃতিতে নানারকমভাবে তারা নিজেকে তুলে ধরে। সব ঋতুই নিজ নিজ রূপ নিয়ে এখানকার মানুষের মন ভোলায়। গ্রীষ্মের প্রখর গরম, বর্ষার বৃষ্টি আর কাদা, শরতের প্রাচুর্যহীনতা, শীতের আমেজ আর বসন্তের সৌন্দর্যের সঙ্গে খরার তীব্রতা- কোনো কিছুই যেন হৃদয়ে আপন করে গ্রহণ করার মত নয়। দায়ে পড়ে এদের সঙ্গে বসবাস করতে হয়। তাদের চোখে দেখা যায়, কখনো উপভোগ্য বিবেচিত হতে পারে। কিন্তু হেমন্তের ব্যাপারটি আলাদা। সে যেন হৃদয়ে আসন পেতে বসে আছে।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশের ষড়ঋতু রচনা | বাংলাদেশের ঋতু বৈচিত্র্য রচনা
হেমন্ত ঋতুর সৌন্দর্যের প্রধান দিক তার ফসল ভরা মাঠ। পাকা ফসলে সোনালি রং ছড়িয়ে থাকে। আকাশ থাকে নির্মল নীলাকাশ। বাতাস হালকা ঢঙে ফসলের শিষ নাড়া দিয়ে যেন খেলা করে বেড়ায়। তখন গরমের কোনো প্রভাব নেই। শীতের আমেজ অনুভব করার সুযোগ তখন ঘটে না। আবহাওয়ার এমন উপাদেয় পরিবেশ আর কোনো ঋতুতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্রকৃতিকে তখন খুবই চমৎকার উপভোগ্য বলে মনে হয়।
হেমন্তের ফল ও ফুল
বর্ষার অবসানে আসে শান্ত, স্নিগ্ধ, মধুর শরৎ ও হেমন্ত। শরৎ রাণীর তিরোধানের পর ‘হিমের ঘন ঘোমটায়’ আবৃত হয়ে হেমন্ত এসে হাজির হয় নানা ফল ও ফুলের সওগাত নিয়ে। এ সময়ে তাল, নারকেল, পেয়ারা ইত্যাদি ফল পাওয়া যায়। হেমন্তের প্রধান ফুল জুই, শেফালী, শিউলি ও কাশফুল। শরতেরও প্রধান ফুল এগুলো। শিউলি হেমন্তের সাঁঝবেলায় তার অবগুণ্ঠন মোচন করে ফুটে ওঠে আর রাতের অবসানে মাথায় লাল টিপ পরে মাটির বুকে ঝরে পড়ে। মনোহারিণী ফুলগুলো স্নিগ্ধ সকালে ছেলেমেয়েরা কুড়িয়ে তার রঙে কাপড় রাঙায় আর পরম আনন্দে উৎফুল্ল হয়। হেমন্তকালের বর্ণনা দিতে গিয়ে আবু জাফর সাবু লিখেছেন-
“হেমন্তকাল মধুর মাসে
পাকা ধানের গন্ধ ভাসে
জুঁই শেফালী ছড়িয়ে ঘাসে
হিম সিরসির হিমেল আসে।”
উৎসবের ঋতু হেমন্তকাল
হেমন্ত আবহমান বাংলার এক আনন্দময় উৎসবের ঋতু। এ সময়ে ঘরে আসে নতুন ধান। চারদিকে নবান্নের উৎসব আর আনন্দের ধুম পড়ে যায়। বাংলাদেশের মানুষের পারিবারিক জীবনের সাথে এই ঋতুর সংযোগ অত্যন্ত নিবিড়। এসময়ে ঘরে ঘরে পিঠা, পায়েস, চিড়া, মুড়ি তৈরির হিড়িক পড়ে যায়। মেহমানের আগমনে জমজমাট হয়ে ওঠে পল্লির পারিবারিক পরিবেশ। হেমন্ত ছাড়া আর কোনো ঋতুতেই এমন পারিবারিক আনন্দ উৎসব দেখা যায় না। কবির ভাষায়-
“হেমন্তের গান শুনি শিরায় শিরায়।
এসেছে সে গানের সুর
ফসলের মাঠ থেকে দূর বহু দূর
ভরে দেশ মন আনন্দ ধারায়।”
উপসংহার
হেমন্তকাল বাংলাদেশের অস্তিত্বের সাথে জড়িত। হেমন্তের অবদানেই দেশের সমৃদ্ধি আর মানুষের সুখ। হৈমন্তিক প্রকৃতির এই আনন্দময় ধারা মানুষের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। পার্বণের আনন্দ স্পর্শ জাগায় মনে মনে। আনন্দ উৎসবে মেতে থাকার ঋতু এই হেমন্ত।
1 comment
[…] আরও পড়ুন: হেমন্তকাল রচনা […]
Comments are closed.