খুচরা ব্যবসায়
চূড়ান্ত ভোক্তার নিকট পণ্যসামগ্রী বিক্রয় করার কাজকে খুচরা ব্যবসায় বলা হয়। ব্যক্তিগত ও অব্যবসায়িক ব্যবহারের জন্য চূড়ান্ত ভোক্তাদের নিকট পণ্য ও সেবা বিক্রয়ের সাথে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কযুক্ত সকল প্রকার কার্যাবলিই খুচরা ব্যবসায় নামে পরিচিত। সহজ কথায় বলা যায়, যারা শুধু নিজেদের ভোগের জন্য পণ্য ক্রয় করে, তাদের নিকট পণ্য বিক্রয় করার কাজই হলো খুচরা ব্যবসায়।
উদাহরণসরূপ একজন দোকানদার রাস্তার পাশে বসে শাকসবজি বিক্রয় করলে তার ব্যবসায়কে খুচরা ব্যবসায়্ বলা হবে। খুচরা ব্যবসায়ে নিয়োজিত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে খুচরা ব্যবসায়ী বলে। নিচে খুচরা ব্যবসায়ীর অবস্থান দেখানো হলো:
উৎপাদক → পাইকার → খুচরা ব্যবসায়ী → ভোক্তা
নতুন পণ্যের মূল্য নির্ধারণ কৌশল বর্ণনা কর। |
খুচরা ব্যবসায়ের সংজ্ঞা
খুচরা ব্যবসায় সম্পর্কে কয়েকটি যুগোপযোগী সংজ্ঞা এখানে তুলে ধরা হলো:
১. উইলিয়াম জে. স্ট্যান্টন (William J. Stanton)-এর মতানুসারে, “ব্যক্তিগত, অব্যবসায়িক ব্যবহারের জন্য চূড়ান্ত ভোক্তার নিকট পণ্য ও সেবা বিক্রয়ের সাথে সরাসরি জড়িত সর্ব প্রকার কাজ খুচরা ব্যবসায়ের অন্তর্ভুক্ত।”
২. বুস ও কির্ক প্যাট্রিক (Russ and Kirk Patrick) এ প্রসঙ্গে বলেন, “ব্যক্তিগত অথবা সাংসারিক ব্যবহারের জন্য চূড়ান্ত ভোক্তাদের নিকট পণ্যদ্রব্য বিক্রয় করাকে খুচরা ব্যবসায় বলে।”
৩. American Marketing Association-এর মতানুযায়ী, “পণ্যদ্রব্য চূড়ান্ত ভোক্তাদের নিকট বিক্রয় সংক্রান্ত সমুদয় কার্যাবলিই খুচরা ব্যবসায়্-এর অন্তর্ভুক্ত
৪. জে. আর, ইভ্যাল ও বারম্যান (J.R. Evans and Barman) বলেন, “ব্যক্তিগত বা পারিবারিক ব্যবহারের উদ্দেশ্যে প্রকৃত ভোক্তার নিকট পণ্য বা সেবা বিক্রয়ের প্রক্রিয়াকে খুচরা ব্যবসায় বলে।”
উল্লিখিত আলোচনা শেষে বলা যায়, ব্যক্তিগত ও অব্যবসায়িক ব্যবহারের উদ্দেশ্যে পণ্যদ্রব্য ও সেবাসামগ্রী চূড়ান্ত ভোক্তা ও ব্যবহারকারীদের নিকট বিক্রয় করার সাথে জড়িত সকল কার্যকলাপই খুচরা ব্যবসায়।
খুচরা ব্যবসায়ের শ্রেণীবিভাগ
বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন প্রকারের খুচরা ব্যবসায়্ দেখতে পাওয়া যায়। ব্যবসায়ের প্রকৃতি, এর আয়তন, সেবার প্রকৃতি, পণ্যের পরিমাণ ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করে খুচরা ব্যবসায়কে শ্রেণীবিন্যাস করা হয়। ব্যবসায়ের আয়তনের দিক থেকে এবং সেবার প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে যেসব খুচরা ব্যবসায় দেখা যায় সেগুলো নিম্নরূপ:
আয়তন অনুসারে খুচরা ব্যবসায়্ (According to the size of business)
আয়তনের দিক থেকে খুচরা ব্যবসায়কে প্রধানত দুভাগে ভাগ করা যায়-
ক. ক্ষুদ্রায়তন খুচরা ব্যবসায় (Small scale retaiers)
যে সব খুচরা ব্যবসায় আয়তনে ছোট, সাধারণত স্বল্প মূলধন নিয়ে গঠিত সে সব ব্যবসায় এ শ্রেণীভুক্ত। এ ব্যবসায় সাধারণত একমালিকানাধীনে গড়ে ওঠে। এ ব্যবসায় নিম্নোক্ত শ্রেণীর হয়ে থাকে-
১. স্থায়ী ক্ষুদ্রায়তন খুচরা ব্যবসায় (Fixed small scale retailers): যেসব ক্ষুদ্র আয়তনের খুচরা ব্যবসায় কোনো স্থায়ী গৃহে বা দোকান ঘরে গড়ে ওঠে তা স্থায়ী ক্ষুদ্রায়তন খুচরা ব্যবসায়। পাড়ায়, মহল্লায় বা গ্রামের হাট বাজারে, বিশেষ কোনো ব্যবসায় কেন্দ্রে এ জাতীয় খুচরা ব্যবসায় দেখা যায়।
২. ভ্রাম্যমাণ ক্ষুদ্রায়তন খুচরা ব্যবসায়্ (Small scale mobile retailers): যে ক্ষুদ্রায়তনের খুচরা ব্যবসায়ের জন্য কোনো স্থায়ী দোকান থাকে না এবং ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে পণ্যদ্রব্য বিক্রয় করে থাকে সেগুলো ভ্রাম্যমাণ ক্ষুদ্রায়তন খুচরা ব্যবসায়। কসমেটিক্স, আইসক্রিম, চানাচুর ইত্যাদি ফেরিওয়ালাদের ব্যবসায় এ জাতীয় খুচরা ব্যবসায়ের উদাহরণ।
খ. বৃহদায়তন খুচরা ব্যবসায় (Large scale retailers)
অধিক পুঁজি নিয়ে গঠিত বৃহৎ আয়তনের খুচরা ব্যবসায়ীকে বৃহদায়তন খুচরা ব্যবসায়্ বলা হয়। নিম্নলিখিত ব্যবসায়গুলো বৃহদায়তন খুচরা ব্যবসায় হিসেবে পরিগণিত-
১. বিভাগীয় বিপণি (Departmental store): একই মালিকানাধীনে ও ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন বিভাগের মাধ্যমে ক্রেতাদের প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য বিক্রয়ের কাজে নিয়োজিত বিপণিকে বিভাগীয় বিপণি বলে। একই ব্যবস্থাপনার অধীনে একই গৃহে বিবিধ প্রকার পণ্যের অনেকগুলো বিভাগের সমন্বয়ে বিভাগীয় বিপণি গড়ে ওঠে। বিভাগ অনেকগুলো থাকলেও এদের মধ্যে একটা নিবিড় যোগসূত্র থাকে। যেমন- একই বিক্রয় কেন্দ্র বা দোকানে মুদি জাতীয় দ্রব্য, রেডিমেড পোশাক, ক্রোকারিজ, বইপত্র, খাদ্যদ্রব্য ইত্যাদি বিক্রয় হলে এটি একটি বিভাগীয় বিপণি।
২. বজ্রশাখা বিপণি (Multiple store): নিজেদের উৎপাদিত পণ্য সরাসরি ভোক্তাদের নিকট বিক্রয় করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন অঞ্চলে অনেকগুলো শাখা-দোকান খুলে ব্যবসায়ে লিপ্ত প্রতিষ্ঠানকে বহুশাখা বিপণি বলে। একই জাতীয় পণ্য বিক্রয়ের লক্ষ্যে বহুসংখ্যক শাখা খোলা হয় বলেই এটিকে বহুশাখা বিপণি বলা হয়। এক্ষেত্রে উৎপাদক-বিক্রেতা সবগুলো দোকান কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন। প্রতিটি দোকান একই দামে পণ্যদ্রব্য বিক্রয় করে থাকে। বাংলাদেশে বাটার জুতোর দোকান একটি বহুশাখা বিপণির উদাহরণ।
৩. বিপণিমালা বা শৃঙ্খল বিপণি (Chain store): নিজেরা উৎপাদন না করে বিভিন্ন উৎস থেকে সংগৃহীত পণ্য অনেকগুলো শাখার মাধ্যমে বিক্রির ব্যবস্থা করা হলে সেক্ষেত্রে দোকানগুলোকে শৃঙ্খল বিপণি বা ‘চেইন স্টোর্স’ বলা হয়। শৃঙ্খল বিপণিগুলো একই মালিকানায় এবং ব্যবস্থাপনায় থেকেই পণ্যসামগ্রী সংগ্রহ করে এবং বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত শাখার মাধ্যমে বিক্রি করে। বাংলাদেশের Agora এরূপ একটি প্রতিষ্ঠানের উদাহরণ।
৪. সুপার বাজার বা অধি বিপণি (Super market): ফিলিপ ও ডানকানের মতে, “সুপার বাজার এমন একটি বিভাগীয় বিপণি যা বহু বিচিত্র ধরনের পণ্য বিক্রি করে এবং সেখানে খাদ্যসামগ্রী বিক্রি একটা বড় ভূমিকা পালন করে।” সুপার বাজারে • সাধারণত কোনো বিক্রয়কর্মী থাকে না। ক্রেতারা বিভিন্ন তাকে সাজিয়ে রাখা জিনিসগুলো থেকে পছন্দ করা জিনিসটি উঠিয়ে নিয়ে প্রধান গেইটে এসে ক্যাশিয়ারের নিকট মূল্য পরিশোধ করেন। প্রত্যেকটি তাকে পণ্যের গায়ে অথবা লটকানো মূল্য তালিকায় পণ্যের মূল্য উল্লেখ থাকে। বাংলাদেশে কোনো পরিকল্পিত সুপার বাজার নেই। নয়াদিল্লীর অভিজাত বাণিজ্যিক এলাকা ‘কনাট সার্কাস’ (Cannaught circus) এ অবস্থিত ‘দিল্লি সুপার বাজার’ এরূপ একটি বিখ্যাত সুপার বাজার।
মূল্য নির্ধারণের পদ্ধতিগুলো আলোচনা কর |
৫. বাট্টা বিপণি (Discount house): প্রথা হিসেবে বিক্রয়মূল্য থেকে একটা নির্দিষ্ট শতকরা অংশ সব সময়েই বাদ দিয়ে পণ্য বিক্রি করার জন্য যেসব বিপণি খোলা হয় সেগুলোকে বাট্টা বিপণি বলে। এসব বিপণিতে সাধারণত উচ্চমূল্যের ভোগ্যপণ্য রাখা হয়; যেমন- রেডিও, টেলিভিশন, ঘড়ি, রেফ্রিজারেটর, মোটর সাইকেল, বৈদ্যুতিক পাখা ইত্যাদি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাট্টা বিপণি বিশেষভাবে প্রসার লাভ করেছে।
সেবার প্রকৃতি অনুসারে খুচরা ব্যবসায় (According to the nature of service)
১. ডাকযোগে ব্যবসায় (Mail order business)
কোনো খুচরা ব্যবসায়ী যখন ডাক মারফত পণ্যসামগ্রী বিক্রির কাজে নিয়োজিত থাকে তখন তার ব্যবসায়কে ডাকযোগে ব্যবসায় বা ডাক মারফতে ব্যবসায় নামে অভিহিত করা হয়। বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে কোনো সম্ভাব্য ক্রেতা পণ্যের মূল্য তালিকা ও অন্যান্য বিবরণ চেয়ে চিঠি লিখলে উক্ত ব্যবসায়ী তখন সম্ভাব্য ক্রেতার নিকট এগুলো প্রেরণ করেন। সম্ভাব্য ক্রেতা এরপর ব্যবসায়ীর নিকট পণ্যের ফরমায়েশ প্রদান করলে ডাকযোগে উক্ত পণ্য ক্রেতার নামে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
২. বিক্রয়োত্তর সেবার ব্যবসায় (Post-service retailing)
যে সকল খুচরা বিক্রেতা পণ্য বিক্রয়ের পরেও ক্রেতাদের বিক্রয়োত্তর সেবা প্রদান করে থাকে তাকে বিক্রয়োত্তর সেবার খুচরা ব্যবসায়্ বলে। যেমন- কম্পিউটার, টিভি, ফ্যান ইত্যাদি। এসব পণ্য। বিক্রয়ের পরেও কোনোরূপ সমস্যা হলে বিক্রয়কর্মীরা ঐ সমস্যা সমাধান করে দেয়।
৩. খাদ্যসামগ্রীর ব্যবসায় (Food store)
এমন কিছু খুচরা ব্যবসায়ী রয়েছে যারা প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ করে থাকে। যেমন- কর্মব্যস্ততার কারণে অফিস কর্মচারীরা দুপুরের খাবার নিজ বাসায় কিংবা নিজেরা রান্না করে খেতে পারে না। তখন ঐসব ব্যবসায়ী তাদেরকে খাদ্য সরবরাহ করে।
পরিশেষে বলা যায়, উপর্যুক্ত বিভিন্ন ধরনের খুচরা ব্যবসায় সচরাচর পরিলক্ষিত হয়ে থাকে।