Home » চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কি বা কাকে বলে ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলাফল
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কি, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কাকে বলে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলাফল,

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কি বা কাকে বলে ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলাফল

by Susmi
0 comment

ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাসে লর্ড কর্নওয়ালিসের রাজত্বকাল গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তিনি গভর্নর জেনারেলের দায়িত্ব গ্রহণ করে রাজস্ব আদায় সম্পর্কে যে দুর্নীতি বিরাজমান ছিল তা দূর করার জন্য পূর্ববর্তী একসালা বন্দোবস্ত ও পাঁচসালা বন্দোবস্তের অনুকরণে দশসালা বন্দোবস্তের প্রবর্তন করেন। পরে এ দশসালা বন্দোবস্ত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নামে পরিচিত হয়।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত

বক্সারের যুদ্ধোত্তর বাংলায় দ্বৈতশাসনের প্রকোপে ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষের প্রচণ্ডতার জন্য আইনশৃঙ্খলার অবনতি হয়েছিল। এসময় কোম্পানি বাংলায় প্রত্যক্ষ শাসন কায়েম করেন। বাংলার শাসনক্ষমতা গ্রহণ করে ওয়ারেন হেস্টিংস বিধ্বস্ত অর্থনীতির পুনর্গঠন ও রাজস্ব আদায়ের সুষ্ঠু ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নিলামি ব্যবস্থায় পুনরায় সর্বোচ্চ ডাককারীকে পঞ্চসালা ভূমি বন্দোবস্ত দেয়। কিন্তু এ পঞ্চসালা ব্যবস্থা কার্যকরী হয় নি। এভাবে এক পর্যায়ে Court of Director ওয়ারেন হেস্টিংসকে বাৎসরিক মেয়াদে ভূমি বন্দোবস্ত প্রদানের নির্দেশ দেন।

আরও দেখুন:   মুজিবনগর সরকার সম্পর্কে সংক্ষেপে লিখ

১৭৮৪ সালে House of Commence এর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে Pitt’s India Act আইন পাস করা হয়। এ Act এর ৩৯ নং সংবিধানে স্থানীয় আইন ও প্রথার ভিত্তিতে ভূমি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। এ Act এর নির্দেশানুসারে ১৭৮৫ সালে Counselor Charles Star চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের একটি খসড়া প্রণয়ন করেন কিন্তু তা আর কার্যকরী হয় নি। এ অবস্থায় কর্নওয়ালিস গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হয়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের জন্য জোর প্রচেষ্টা চালান। ফলে ১৭৯০ সালে দশসালা বন্দোবস্ত প্রবর্তিত হয়। এ দশসালা বন্দোবস্তকে চিরস্থায়ী বন্দোবন্তে পরিণত করা হবে। নানা তর্ক-বিতর্কের পর ১৭৯৩ সালে ২২ মার্চ ডাইরেক্টর সভা থেকে নির্দেশ আসলে এটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে পরিণত হয়। এ ব্যবস্থা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থা নামে খ্যাত।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বৈশিষ্ট্য

নিম্নে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বৈশিষ্ট্যসমূহ তুলে ধরা হলো:

১ . জমিদারগণ বংশানুক্রমিক স্থায়ী ও একচ্ছত্র জমির মালিক হবে। এ নিজস্ব জমি তারা যথেচ্ছভাবে ব্যবহার বা হস্তান্তর করতে পারবে এবং এতে সরকারি অনুমতির প্রয়োজন হবে না।

২. রায়তগণ হবে জমিদারদের অধীনস্থ প্রজা। তবে আইনে রায়তদের প্রতি সুব্যবহার এবং রায়তের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনের জন্য জমিদারদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।

৩. এ বন্দোবস্তে নিয়ম করা হয় যে, জমির খাজনা চিরস্থায়ীভাবে এবং একবারই নির্ধারিত হবে।

৪. প্রজার সাথে তাদের দায়িত্ব অধিকার নির্ধারণে সরকারের কোনো সম্মতি নিতে হবে না।

৫. নিয়মিত ও নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে খাজনা পরিশোধ করতে হবে এবং এ ব্যাপারে ব্যক্তিগত বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কোনো অজুহাত সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। জমি নিলামে বিক্রি করে বকেয়া আদায় করা হবে।

৬. চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বিচার, পুলিশ ও শুল্ক আদায় সংক্রান্ত ক্ষমতা জমিদারদের হাতে না থেকে সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকবে।

আরও দেখুন:   মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা বর্ণনা কর

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলাফল

নিম্নে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলাফল তুলে ধরা হলো:

১. প্রশাসনিক ফলাফল

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তিত হওয়ার ফলে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে এক শ্রেণির মধ্যবিত্তের উদ্ভব হয়। এ মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব হয়েছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রশাসনিক যন্ত্র থেকে।

২. সামাজিক ফলাফল

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে গ্রামীণ সমাজ বিন্যাসেও পরিবর্তন হয়। এ বন্দোবস্তের ফলে দু’ধরনের মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব হয়। শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও গ্রামীণ মধ্যবিত্ত শ্রেণি। সমাজে দেখা যায়, উপরে জমিদার ও নিচে সাধারণ রায়তের মধ্যবর্তী এ শ্রেণির সদস্য ছিল ধনী কৃষক, জোতদার, ক্ষুদ্র জমিদার, তালুকদার, মধ্যস্বত্ব উপস্বত্বাধিকারী ভূস্বার্থসমূহ, গ্রামীণ মহাজন, শস্য ব্যবসায়ী ইত্যাদি।

৩. অর্থনৈতিক ফলাফল

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছিল। কৃষিতে পুঁজিবাদ সৃষ্টি ছিল এ ব্যবস্থার উদ্দেশ্য। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের তাত্ত্বিকদের ধারণা ছিল যে, যে জমিদার শ্রেণি উদ্ভব করা হবে তাঁরা মালিকানার নিশ্চয়তার জন্য ভূমিতে বিনিয়োগ করতে কৃষকদের উৎসাহিত করবে। ফলে কৃষির উন্নতি হবে। তাতে কোম্পানির লাভও হবে।

৪. মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে অনেক পুরাতন জমিদার শ্রেণি ধ্বংস হয়। ফলে পুরাতন জমিদার শ্রেণির ধ্বংসস্তূপের উপর নতুন জমিদার শ্রেণির উদ্ভব হয়। এ নতুন জমিদাররা জমিদারি সম্পর্কে ছিলেন একেবারে অজ্ঞ।

পরিশেষে বলা যায় যে, ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করার পশ্চাতে কোম্পানির স্বার্থ ছিল কীভাবে রাজস্ব বন্দোবস্তের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ভিত্তিকে মজবুত করে ব্রিটিশ শাসনকে টিকিয়ে রাখা যায়। তাই তারা সকল দিক ঠিক রেখে রাজস্ব সংক্রান্ত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেন।

Related Posts