1.3K
ট্রেনে ভ্রমণ বা একটি ট্রেন ভ্রমণ সম্পর্কে রচনা বিভিন্ন পরীক্ষায় এসে থাকে। আজকের এই লেখায় ট্রেনে ভ্রমণ রচনা তুলে ধরবো।
ভূমিকা
ভ্রমণ সবসময় আনন্দের হয়। আর আনন্দের সঙ্গে যুক্ত হয় জ্ঞানলাভ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন-
“বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি!
দেশে দেশে কত না নগর রাজধানী,
মানুষের কত কীর্তি, কত নদী গিরি সিন্ধু মরু,
কত না অজানা জীব, কত না অপরিচিত তরু,
রয়ে গেল অগোচরে।”
প্রকৃতপক্ষে, ভ্রমণের ফলে মানুষের চিত্ত প্রফুল্ল হওয়ার সাথে সাথে সে অনেক অজানা কিছু জানতে পারে। বলা হয়ে থাকে, মানুষ বই পড়ে যতটুকু না জানতে পারে, তার থেকে বেশি জানতে পারে ভ্রমণ করে। আর তাই আমিও একদিন ট্রেন ভ্রমণে বের হই। আজ সেই ভ্রমণের গল্পই এখানে লিখবো।
আরও পড়ুন: বিজয় দিবস রচনা । মহান বিজয় দিবস রচনা
ভ্রমণ কি?
ভ্রমণ হলো এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বেড়ানো । মহানবী তাঁর বাণীতে জ্ঞানার্জনের জন্য সুদূর চীন দেশে পর্যন্ত যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। অর্থাৎ পরোক্ষভাবে তিনি ভ্রমণকে ইঙ্গিত করেছেন। শ্রীকৃষ্ণও বিশেষ উদ্দেশ্যে মথুরা থেকে বৃন্দাবনে ভ্রমণ করেছেন। ধর্মীয় মহাপুরুষদের পাশাপাশি বিজ্ঞানীরা মহাশূণ্যে বিচরণের পাশাপাশি চাঁদের দেশেও ভ্রমণ করেছেন । এ সব কিছুর সঙ্গেই আছে আনন্দ আর জ্ঞানের পিপাসা। ভ্রমণের ফলে মানবমন আনন্দ লাভ করে এবং জ্ঞানের পিপাসা মেটায়। যার কাণে অনেকে এটি কর্তব্যকর্ম বলেও মনে করে।
ভ্রমণের পথসমূহ
ভ্রমণের জন্য চায় উপযুক্ত পথ। সাধারণত স্থলপথ, জলপথ, আকাশপথ এই তিন পথেই ভ্রমণ করা যায়। স্থলপথে বাস ভ্রমণ, সাইকেল ভ্রমণ, মোটর সাইকেল ভ্রমণ, টেক্সি ভ্রমণ ইত্যাদি হতে পারে। তবে দীর্ঘ পথ ক্লান্তিহীনভাবে ভ্রমণের জন্য আরামদায়ক ভ্রমণ হলো রেলপথ অর্থাৎ ট্রেন ভ্রমণ। এতে পথে অনেক স্টেশন থাকায় নানা স্থান এবং বিচিত্র মানুষের সঙ্গে ক্ষণিক সময়ের জন্য দেখা হওয়ার সুযোগ ঘটে।
ট্রেনে ভ্রমণের শুরু
তখন সবেমাত্র আমার পরীক্ষা শেষ। হাতে শীতকালীন বন্ধ। ডিসেম্বর মাসের ৬ তারিখে মা-বাবার সঙ্গে সকাল সাড়ে সাতটায় ঢাকার কমলাপুর স্টেশনে গিয়ে পৌঁছাই। সঙ্গে আমার বোন চিত্রা। উদ্দেশ্য গ্রামের বাড়ি শেরপুরে যাব। বাবা ট্রেনের টিকেট আগেভাগে কেটে রেখেছিলেন। আমরা স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনের ‘সুলভ’ শ্রেণিতে নির্ধারিত আসনে বসলাম। ট্রেনের নাম ‘তিস্তা এক্সপ্রেস’। দেখেই খুব ভালো লাগলো। নদী আমার খুব পছন্দের। সকাল ঠিক আটটায় ট্রেন কমলাপুর স্টেশন ছাড়ল।
ট্রেনের ভেতরের অবস্থা সম্পর্কে বাবা আমাকে বলেছিলেন: ‘সুলভ’ শ্রেণিতে উঠলে বিচিত্র ধরনের মানুষের দেখা মেলে। সত্যি সত্যি তাই দেখলাম। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত নানা ধরনের নারী-পুরুষের সঙ্গে শিশুরা আসনে বসেছে। দুজনের আসনে তিন বা চারজনও কষ্ট করে বসে ছিলেন। একজন বৃদ্ধ আসন পান নি। পাশের আসন থেকে একজন যুবক উঠে দাঁড়িয়ে তাকে বসতে দিলেন। এরই মধ্যে বাদামওয়ালা ‘বাদাম-বাদাম’ বলে মিহি সুর তুলে। বাদামের আকর্ষণীয় গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। আমার তখন ভাইরাল হওয়া গান ‘বাদাম বাদাম কাঁচা বাদাম’ গানটির কথা মনে পড়ল। আমাদের সিটের পাশের সারিতে একজন খবরের কাগজ মেলে মনোযোগ দিয়ে পড়তে লাগল। ধীর গতি থেকে ট্রেন আস্তে আস্তে গতিপ্রাপ্ত হল।
বিভিন্ন স্টেশন
ট্রেন কিছুদূর আসার পর আমি জানালার ধারে এসে বসে পড়ি। বোন চিত্র আমার মুখোমুখি বসে। আমার পাশে মা আর চিত্রার পাশে বাবা বসা। ট্রেনে বসা থেকেই দেখলাম তেজগাঁও, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, জয়দেবপুর ইত্যাদি। কিছু স্টেশনে ক্ষণিক দাঁড়াল। আর স্টেশনে অপেক্ষমাণ মানুষগুলো জলদি উঠে পড়ল ট্রেনে। কারও হাতে ছিল ব্যাগ, কারো কোলে শিশু। কিন্তু সবারই একটাই লক্ষ্য এবং তা হলো ট্রেন। ট্রেনে উঠেই তাদের সব ব্যস্ততা কমে যায়। যে যার আসন খুঁজে নিয়ে সেখানে বসে যান।
ট্রেন থেকে দেখা
জানালার ধারে বসে আছি। মনে হচ্ছে মাঠ-ঘাট-গাছপালা দৌড়াচ্ছে। আমার চোখ স্থির। কয়েকটা পাখি আকাশে পাখা মেলে আমাদের পাশাপাশি চলে আবার পিছিয়ে পড়ে। মনে হয়, সারা পৃথিবী যেন ঘুরছে, আর আমরা স্থির আছি। জানালার ধারে বাতাসের গতিবেগের কারণে আমার চুল এলোমেলো হয়ে যায়। তাকিয়ে দেখি বাবা বই হাতে, মা চোখ বুজে আছেন। ট্রেন থেকে শূন্য মাঠ দেখা যায়। কিছুদিন আগেও এখানে সোনালি ধান ছিল। একটি বাড়ি দ্রুত চলে যায়। সেখানে গরু আর মহিষ বাঁধা ছিল। দূরে একটি ইটের বাড়িও চোখে পড়ে। অনেক টিনের ঘরের চালে সূর্য চিক চিক করে। পুকুরে গ্রামের বৌঝিরা কাজে ব্যস্ত- সেটাও চোখে পড়ে। গ্রাম বাংলার রূপ যে এত সুন্দর তা এর আগে আমার চোখে এভাবে আর ধরা পড়ে নি। কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন-
“বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ
খুঁজিতে যাই না আর—”
জীবনানন্দের এই কবিতার লাইনগুলো কতটা সত্য, সেদিন ট্রেনে ভ্রমণ করে বুঝতে পারলাম ।
আরও পড়ুন: বাংলা নববর্ষ রচনা । পহেলা বৈশাখ রচনা
উল্লেখযোগ্য স্থান
ট্রেনে ভ্রমণ এর সময় প্রথমেই উল্লেখযোগ্য স্থান ও স্থাপনার মধ্যে চোখে পড়ল কমলাপুর রেলস্টেশন। এই স্টেশনের প্লাটফর্ম বেশ দীর্ঘ। তারপর তেজগাঁও আসার আগেই দূর থেকে চোখে পড়ে ঢাকার চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা বা এফডিসি। ভাওয়ালের জমির ওপর দিয়ে জয়দেবপুরে যাবার আগেই ঢাকা বিমানবন্দর চোখে পড়ে। একটি বিমান তখন উড্ডয়ন করেছিল মাত্র। আর চোখে পড়ল ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। জামালপুরে যমুনা সার কারখানা ছাড়াও পথে নানা স্থান ও স্থাপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে গেলাম। সাইনবোর্ডগুলোর ওপর একটু স্থির দৃষ্টি রাখলে স্থান ও স্থাপনাগুলোর নাম ভালোভাবেই পাঠ করা সম্ভব। ট্রেনে ভ্রমণের সময় নানা স্থান ও বিচিত্র স্থাপনাগুলো আমাকে আকৃষ্ট করে।
শেষ স্টেশন
ট্রেন থেকে নামার আগের প্রস্তুতি হিসেবে আমরা সবাই যে যার ব্যাগ হাতে নিলাম। বাবা বড় ব্যাগগুলো এক সঙ্গে রেখে ট্রেন থামার অপেক্ষা করলেন। আমি আমার একপাটি জুতো খুঁজে পাচ্ছিলাম না। চিত্রা বলল : চয়ন দাদা তোমার জুতো আমার সিটের নিচে এসে গেছে। ট্রেন থামতেই লাল শার্ট পরা কুলিরা এলো। বাবা তাদের হাতে ব্যাগ বুঝিয়ে দিলেন। আমরা নামার চেষ্টায় ব্যস্ত, আবার অনেকে ট্রেনে ওঠার চেষ্টায় মত্ত। এসময় একটা বিশৃঙ্খল পরিবেশের সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত আমরা জামালপুর স্টেশনে নামলাম। আমাদের সাত ঘণ্টার ট্রেনে ভ্রমণ সমাপ্ত হলো।
উপসংহার
ট্রেনে ভ্রমণ না করলে জীবনের বিরাট অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হতাম। বিচিত্র মানুষের দেখা, বিভিন্ন স্থান অবলোকন ও নানা স্থাপনা দর্শন ইত্যাদি আমার মনে নানা জিজ্ঞাসার জন্ম দেয়। সুজলা-সুফলা সোনার বাংলাদেশের রূপ দেখে আমার মনে তীব্র দেশপ্রেমের উদয় হয়। ট্রেন ভ্রমণের এই সাতটি ঘণ্টা আমার কাছে যেন সাত জনমের অভিজ্ঞতার চিত্র হয়ে গেঁথে থাকল।