পণ্যের জীবন চক্র
কোনো প্রতিষ্ঠান একটি নতুন পণ্য বাজারে ছাড়ার পর স্বভাবতই আশা করে যে পণ্যটির বিক্রয়ের পরিমাণ উত্তরোত্তর বাড়বে। এবং বহুদিন যাবৎ এটি বাজারে টিকে থাকবে। তবে কোনো পণ্যই চিরকাল একইভাবে বাজার দখল করে রাখতে পারে না- বিভিন্ন কারণে পণ্যের জীবনে উত্থান-পতন ঘটে থাকে। অর্থাৎ প্রত্যেক পণ্যেরই একটি জীবন চক্র রয়েছে। উদ্ভিদ এবং প্রাণীর ক্ষেত্রে আমরা যেমন জন্ম, বৃদ্ধি এবং শেষ পরিণতি দেখতে পাই ঠিক তেমনি পণ্যের ক্ষেত্রেও জন্ম, বৃদ্ধি, পরিণতির এ গতিধারা দেখতে পাওয়া যায়। একটি পণ্যের জীবদ্দশায় তাকে যেসব পর্যায় বা ধাপ অতিক্রম করতে হয় সে পর্যায়গুলোকে পণ্যের জীবন চক্র বলে। এ প্রসঙ্গে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উক্তি নিচে উদ্ধৃত হলো:
১. ফিলিপ কটলার (Philip Kotler) বলেন, “পণ্য বিক্রয় কার্যক্রমের বিভিন্ন স্তর চিহ্নিতকরণ প্রক্রিয়াকে একটি পণ্যের জীবন চক্র বলা হয়” (The product life-cycle is an attempt to recognise distinct stages in the sales history of the product.)
২. ম্যাকার্থি (McCarthy)-এর মতানুযায়ী, “পণ্যের জীবন চক্র হলো কতকগুলো পর্যায় যা একটি নতুন পণ্য এর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অতিক্রম করে” (The product life-cycle is the stages a new product goes through from beginning to end.)
শিল্প পণ্য কি? শিল্প পণ্যের বৈশিষ্ট্য সমূহ আলোচনা কর |
৩. Zikmund এবং d’Amico-এর মতে, “পণ্য জীবন চক্র হচ্ছে একটি পণ্যের বিক্রয় ইতিহাসকে লেখচিত্রের মাধ্যমে বর্ণনা করার বাজারজাতকরণ ব্যবস্থাপনার ধারণা।” (“Product life-cycle is a marketing management concept providing a graphic description of a product’s sales history.”) পরিশেষে আমরা বলতে পারি, একটি পণ্যকে উৎপাদনের পর থেকে আরম্ভ করে সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যাওয়া পর্যন্ত যেসব পর্যায়ের মধ্য দিয়ে ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে হয় সেটিকে পণ্যের জীবন চক্র বলা হয়।
পণ্যের জীবন চক্রের পর্যায়
একটি পণ্যের জীবদ্দশায় এটিকে যেসব পর্যায় বা ধাপ অতিক্রম করতে হয় সে পর্যায়গুলোকে পণ্যের জীবন চক্র বলে। পণ্যের জীবন চক্রকে পাঁচটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়:
১. পণ্য উন্নয়ন
২. প্রবর্তন
৩. প্রবৃদ্ধি
৪. পূর্ণতা প্রাপ্তি ও
৫. বিক্রয় অবনতি।
এ পাঁচটি স্তরকে নিচের চিত্রে দেখানো হলো। চিত্রে উপরের রেখাটি হচ্ছে বিক্রয় রেখা এবং নিচের রেখাটি মুনাফা রেখা।
পণ্যের জীবন চক্রের বিভিন্ন পর্যায় নিচে আলোচিত হলো-
১. পণ্য উন্নয়ন (Product development)
কোনো কোম্পানি যখন নতুন পণ্য ধারণা খুঁজে পায় এবং এর উন্নয়ন শুরু হয় তখন এ স্তরকে পণ্য উন্নয়ন স্তর বলে। এ পর্যায়ে বিক্রয়ের পরিমাণ শূন্য থাকে এবং কোম্পানির বিনিয়োগ ব্যয় অধিক হয়।
২. প্রবর্তন (Introduction)
এ পর্যায়ে পণ্যকে সম্পব্য গ্রাহকদের নিকট পরিচিত করানোর জন্য প্রচারমূলক কার্য চালানো হয়। এ পর্যায়ে বিক্রয়ের পরিমাণ তেমন বেশি হয় না এবং প্রায় ক্ষেত্রে মুনাফাও অর্জিত হয় অতি সামান্য-অনেক ক্ষেত্রে মুনাফা একেবারেই হয় না। পণ্য প্রবর্তনজনিত বহুল খরচ এবং গ্রাহকের সংখ্যার অপ্রতুলতা মুনাফা না হওয়ার প্রধান কারণ। ভবিষ্যৎ মুনাফার আশায় এ পর্যায়ে পণ্যের পেছনে বিস্তর অর্থ খরচ করা হয়।
৩. প্রবৃদ্ধি (Growth)
পণ্যের জীবন চক্রের দ্বিতীয় পর্যায়ে পণ্যের কাটতি বাড়ে, গ্রাহকের মধ্যে পণ্যের কদর বৃদ্ধি পায়। ফলে মুনাফার পরিমাণও বাড়তে থাকে। প্রবৃদ্ধির পর্যায়ে বিক্রির পরিমাণ দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পায় এবং সেই গতিতে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছে। পণ্যের চলমান জীবনের এ পর্যায়ে প্রতিযোগীরা উন্নতমানের কিংবা কম মূল্যের পণ্য নিয়ে বাজারে প্রবেশ করতে থাকে। কোম্পানির জন্য সর্বোচ্চ মুনাফার এটাই মুখ্য সময়, তবে প্রতিযোগিতার দরুন এটা মুনাফার অধোগতি শুরুরও সময়।
ভোগ্য পণ্য কাকে বলে ও ভোগ্য পণ্যের বৈশিষ্ট্য সমূহ |
৪. পূর্ণতা প্রাপ্তি (Maturity)
এ পর্যায়ে প্রতিযোগিতা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। ফলে বিক্রয়ের পরিমাণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে আবার নিম্নমুখী হতে থাকে এবং তার সাথে মুনাফা রেখাও নিম্নগামী হয়। এ অবস্থায় প্রচারের পেছনে প্রচুর খরচ করতে হয় যাতে পণ্যকে প্রতিযোগিতার মুখে টিকিয়ে রাখা যায়।
৫. বিক্রয় অবনতি (Sales decline)
পণ্যের জীবন চক্রের এটি শেষ ধাপ। এ পর্যায়ে বিক্রয়ের পরিমাণ আরও হ্রাস পেতে থাকে। ফলে শেষ পর্যন্ত মুনাফা অর্জন করা আর সম্ব হয়ে ওঠে না। যদি পণ্যটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষাপটে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া না হয়, তাহলে পণ্যটির পঞ্চত্বপ্রাপ্তি (মৃত্যু) ঘটে।
পরিশেষে বলা যায়, অন্যান্য জীবের ন্যায় প্রত্যেকটি পণ্যেরই জীবন চক্রে আলোচিত ধাপগুলো পরিলক্ষিত হয়। তাই বাজারজাতকারীকে পণ্যের জীবন চক্রের বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনাপূর্বক পণ্য পরিকল্পনা করতে হবে।