Home » প্রাচীন প্রস্তর যুগের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা
প্রাচীন প্রস্তর যুগের বৈশিষ্ট্য

প্রাচীন প্রস্তর যুগের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা

by Susmi
0 comment

প্রাচীন প্রস্তর যুগের বৈশিষ্ট্য সমূহ

পুরোপলীয় বা প্রাচীন প্রস্তর যুগকে সবচেয়ে দীর্ঘতম সময় বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ যুগে আবিষ্কৃত অবিকৃত, অমসৃণ ও স্থল পাথরের অস্ত্র ব্যবহৃত হলেও একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে মানব সভ্যতা বিকাশের প্রথম ভিত্তি পুরোপলীয় বা প্রাচীন প্রস্তর যুগেই স্থাপিত হয়েছিল। নিম্নে প্রাচীন প্রস্তর যুগের বৈশিষ্ট্য সমূহ উপস্থাপন করা হলো-ে

১. বাসস্থান

প্রাচীন প্রস্তর যুগে জলবায়ু উষ্ণ ও মৃদু থাকায় মানুষ তখন-কোনো রকম আশ্রয় ছাড়াই মানুষ উন্মুক্ত স্থানে বসবাস করত। তুষার যুগের আবির্ভাবের সাথে সাথে শীতের প্রচণ্ডতা ও কনকনে প্রবল হাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মানুষকে রুহায় আশ্রয় নিতে হয়েছে। শরীর গরম রাখার জন্য পশুর চামড়া দিয়ে শরীর ঢাকতে হয়েছে। শুকনো পাতা, ডাল ও কাঠ সংগ্রহ করে আগুন জ্বালাতে হয়েছে। গুহায় আশ্রয় পাওয়ার জন্য পশুর সাথে প্রতিযোগিতা করতে হয়েছে। এভাবে প্রাচীন প্রস্তর যুগের গুপ্ত, নিমডেল ও রিস তুষার যুগে মানুষ তিনবার গুহায় আশ্রয় নেয় এবং প্রথম ও দ্বিতীয় আন্তঃতুষার যুগে সমভূমিতে ফিরে আসে।

২. খাদ্য

প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষ নিজে খাদ্য উৎপাদন করতে পারত না। সম্পূর্ণরূপে প্রকৃতির উপর খাদ্যের জন্য নির্ভরশীল ছিল। শিকার ও সংগ্রহ এবং আহরণ করা ছিল তাদের প্রধান জীবিকা। ফলমূল, সবজি ভোজ, বড় বড় পশু যেমন- হরিণ, ঘোড়া, বন্য শূকর, ছোট পাখি, খরগোশ, বনমোরগ, হাঁস, রাজহাঁস ইত্যাদি ছিল তাদের খাদ্য। তখন দলবদ্ধভাবে শিকার করত ও ভাগাভাগি করে সকলে খেতো। এ অবস্থাকে নৃবিজ্ঞানীরা হয় উপোস নয় ভূরিভোজ বলে আখ্যায়িত করেছেন। আদি প্রস্তর যুগে প্রথমে মানুষ কাঁচা মাংস ভক্ষণ করত। পরে আগুনে পুড়িয়ে খেতে শুরু করে।

আরও পড়ুন:   প্রাচীন প্রস্তর যুগ সম্পর্কে আলোচনা

৩. বস্ত্র

প্রাচীন প্রস্তর যুগের প্রথমে মানুষ উলঙ্গ থাকলেও এ যুগের শেষের দিকে মানুষ শীত থেকে বাঁচার জন্য চামড়া দিয়ে গা ঢাকা অভ্যন্ত ছিল। গোড়ার দিকে গাছের ছালবাকল ও পাতা দিয়ে লজ্জা নিবারণ করত। পরে আস্ত পশুর চামড়া জড়িয়ে রাখতো। পরবর্তীতে এই চামড়াকে শরীরের মাপ অনুযায়ী সেলাই করে নিতো। সেলাইয়ের জন্য পশুর হাড় সূচ হিসাবে ও শক্ত গাছের বাকল দিয়ে তৈরি সুতা হিসেবে ব্যবহার করা হতো।

৪. আগুনের ব্যবহার

প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষের প্রধান আবিষ্কার ছিল আগুন। আগুন জ্বালানোর কৌশল আয়ত্ব করার পরেই মানুষ মাংসকে পুড়িয়ে খাওয়া শুরু করলো। প্রথম দিকে মানুষ বাইরে থেকে আগুন সংগ্রহ করে এনে গুহার মধ্যে আগুন জ্বালিয়ে রাখতো। আগুনের ব্যবহারে চার ধরনের পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে। যথা-

  • আগুন আবিষ্কারের ফলে প্রকৃতির এক বিরাট শক্তিকে নিয়ন্ত্রণে এনে নিজের ভাগ্য নিজেই নিয়ন্ত্রণ করার দিকে ধাবিত হয়।
  • আগুনের আবিষ্কারের ফলে হিংস্র জানোয়ারের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া, জন্তু জানোয়ার শিকার করা সহজ হয়। এবং শীতের তীব্রতা থেকে রক্ষা পাওয়া সহজ হয়।
  • আগুনের আবিষ্কারের ফলে রান্না সম্পর্কেও মানুষ জানতে পারে এবং মাংস আগুনে পুড়িয়ে খেলে সু-স্বাদু লাগে।
  • আগুনের আবিষ্কারের ফলে স্বল্পসময়ে আহারের ব্যবস্থা করা যায়। এছাড়া অস্ত্র নির্মাণ, মৃৎ ও অন্যান্য দ্রব্যাদি নির্মাণ কৌশলেও মনোনিবেশ করা যায়।

৫. হাতিয়ার

প্রাচীন প্রস্তর যুগে প্রথমে মানুষ শিকারের জন্য বিভিন্ন হাতিয়ার বেছে নিয়েছে। পিকিং মানুষ কোয়ার্টজ পাথরের হাতিয়ার ব্যবহার করত। এ যুগের মাঝখানে এসে একখণ্ড পাথরকে ঘষে পাতলা পরত খসিয়ে নিয়েছে যাকে পরত পাথরের হাতিয়ার বা flake tools বলে অভিহিত করা হয়। মূল পাথর থেকে পরত পাথর খসিয়ে তৈরি হাতিয়ারকে মূল পাথরের হাতিয়ার বা Core tools বলা হয়। এগুলো ছাড়া হস্তকুঠার, শাবল, ছুরি, বাটালি, বিউরিন, আল নামক ছিদ্রকারী সুচ, বর্শা, বলম, কাঁটাবিশিষ্ট হাফর বা হার্পন উল্লেখযোগ্য। পাথর ছাড়াও জীব-জন্তুর হাড়, হাতির দাঁত, পশুর সিং ব্যবহার করা হতো। হাতিয়ার প্রসঙ্গে Gorden V. Childe উল্লেখ করেছেন, হাতিয়ার তৈরির মাধ্যমে প্রাচীন মানুষ এক প্রকার বৈজ্ঞানিক ঐতিহ্যের সৃষ্টি করেছিল।

৬. শিকার করার পদ্ধতি

প্রাচীন প্রস্তর যুগের প্রথম দিকে ছোট ছোট প্রাণী শিকার করলেও হাতিয়ারের উন্নতির সাথে সাথে এ যুগের মানুষের শিকার করায় পরিবর্তন আসে। ক্রমশ মানুষ বড় বড় প্রাণী শিকারের দিকে ধাবিত হয়। পাথরের উন্নত অস্ত্র ব্যবহারের পাশাপাশি ফাঁদ পেতে পশু শিকারের কৌশল আয়ত্ত করে।

৭. সমাজ সংগঠন

প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষ তাদের প্রয়োজনের তাগিদেই দলবদ্ধ হয়ে বসবাস ও শিকার করত। এ দলবদ্ধ থাকার প্রসঙ্গে L. H. Morgan উল্লেখ করেছেন যে, মানুষ জোট বেঁধেছে জ্ঞাতি সম্পর্কের ভিত্তিতে। একই পূর্বপুরুষ থেকে যাদের জন্ম নৃবিজ্ঞানীরা একে ক্ল্যান নামে অভিহিত করেছেন। এই ক্ল্যানের মাধ্যমে ছোট ছোট শিকার কার্য পরিচালনা করা হত। বড় শিকারের জন্য বেশি লোকের প্রয়োজন দেখা দেওয়ায় আদিম মানুষ কয়েকটি ক্ল্যান নিয়ে ট্রাইব সৃষ্টি করেছিল।

৮. ধর্ম বিশ্বাস

প্রাচীন প্রস্তর যুগে সামাজিক সংগঠন ক্ল্যানের সদস্যরা তাদের কল্পিত পূর্বপুরুষ পূজা করত। ক্ল্যানের সদস্যরা যে সমস্ত নিয়মকানুন মেনে চলত নৃবিজ্ঞানীরা সেগুলোকে ট্যাবু নামে অভিহিত করেছেন, Durkheim আদিম ধর্মীয় বিশ্বাসকে টোটেম বলে অভিহিত করেছেন। প্রাচীন প্রস্তর যুগে মানুষরা অদৃশ্য ও অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাস করত। এই অলৌকিক ও অদৃশ্য শক্তির বিশ্বাস থেকেই তাদের মনে ধর্মীয় অনুভূতির জন্ম হয়েছে।

৯. অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া

প্রাচীন প্রস্তর যুগের প্রথম দিকে মৃতকে কবর দেওয়া হতো। তখন দেহ সংরক্ষণের চেষ্টা করা হতো। গুহার মাটি অগভীরভাবে খুঁড়ে তৈরি করা হতো লা শ্যাপেল আঁ সাঁ। এই লা শ্যাপেল আঁ সাঁ- তে কখনো মাথাটি স্থাপন করা হতো পাথরের বালিশে এবং মাটির চাপ কমানোর জন্য চারদিকে পাথর দেওয়া হতো। তারা পুনর্জন্যে বিশ্বাস করত। যার জন্য তারা মৃতদেহের কবরের সাথে খাদ্য, পানীয়, মৃতের ব্যবহৃত হাতিয়ার প্রভৃতি সামগ্রী রাখা হতো।

১০. শিল্পকলা

প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষ শিল্পকলার বিভিন্ন শাখায় যথেষ্ট অগ্রগতি লাভ করে। বিশেষ করে গুহাচিত্র অঙ্কনে পারদর্শী ছিল। ১৮৭৩ সালে স্পেনের আলতামিরা গুহা, ১৮৯৫ সালে ফ্রান্সের লা মুখ গুহা, ১৮৯৬ সালে ফ্রান্সের পেয়ার নন পেয়ায় গুহা, লাসকো ও আইজিস গুহা প্রাচীন প্রস্তর যুগের শিল্পকলার প্রমাণ পাওয়া যায়। অধিকাংশ গুহা চিত্রেই জীবন্ত জীব জন্তু ও শিকারী জীবন প্রাধান্য পেয়েছে। এছাড়া নৃত্যরত নারী মূর্তিও স্থান পেয়েছে। রানার্স ও বালদ উল্লেখ করেছেন, চিত্রকর একজন সুদক্ষ শিল্পীই ছিলেন না, তিন একজন যাদুকরও ছিলেন। মূলত যাদুবিদ্যার প্রভাব বাড়ানোর জন্য প্রাগৈতিহাসিক চিত্রশিল্পীরা স্বেছায় দূর্গম বিপদসংকুল ও বসবাসের অযোগ্য গুহার ভেতর বেছে নিতো এবং সেখানে বসে ছবি আঁকত।

উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো ছাড়াও পুরোপলীয় বা প্রাচীন প্রস্তর যুগের অন্যান্য বৈশিষ্ট্য গুলো হলো- সামান্য পরিমাণে ভাষার ব্যবহার, সীমিত ব্যক্তিগত সম্পতির উদ্ভব, ব্যক্তির ব্যবহার্য সম্পত্তির ধারনার উদ্ভব ঘটে। পরিশেষে বলা যায়, পুরোপলীয়রা তাদের চিন্তা-চেতনাকে নব উদ্ভাবনী কর্মের দিকে নিবদ্ধ করতে পারেনি। ফলে পুরোপলীয় সমাজ ক্রমাবনতির দিকে এগিয়ে যায় এবং সে সমাজের স্থবির ভাবাদর্শের স্থলে নবচেতনা সমৃদ্ধ মধ্যপলীয় ও আরও পরে নবোপলীয় কৃষি উৎপাদনীয় ভাবাদর্শ স্থান লাভ করে। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির উদ্ভাবনের ফলে পুরোপলীয় বন্যদশাগ্রস্ত অনিশ্চিত ও স্থবির অর্থনীতি একেবারে অপাংক্তেয় হয়ে পড়ে এবং এভাবে পুরোপলীয় যুগের অবসান হয়।

Related Posts