Home » বাঙালি জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ও বিকাশধারা আলোচনা
বাঙালি জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ও বিকাশ

বাঙালি জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ও বিকাশধারা আলোচনা

by Susmi
0 comment

বাঙালি জাতীয়তাবাদের উদ্ভব

বাংলাদেশ ভূখণ্ডে প্রধান জনগোষ্ঠীর ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং সর্বোপরি ভৌগোলিক অঞ্চলের ভিত্তিতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উৎপত্তি হয়েছে। মোগল আমলের বিখ্যাত ঐতিহাসিক আবুল ফজল তার ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থে লিখেছেন, আগে ভারতবর্ষের এ অঞ্চলের নাম ছিল বঙ্গ। অন্যান্য ঐতিহাসিকগণও মনে করেন যে, প্রথমে বঙ্গ থেকে বঙ্গাল এবং পরে বাংলার উদ্ভব হয়েছে। তাই বলা যায় যে, বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী এবং তাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতির সমন্বয়েই বাঙালি জাতীয়তাবাদের উৎপত্তি হয়েছে। তাছাড়া পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী ছিল সংখ্যাগুরু এবং ভৌগোলিক দিক থেকে বিচ্ছিন্ন। ফলে একই ভাষাভাষী একই সাহিত্য পাঠকারী জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই প্রবল ঐক্যবোধ সৃষ্টি হয়। এ বিশেষ প্রেক্ষিতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের পথ আরো প্রশস্ত হয়। আবার আধুনিক জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রে ভাষা সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পায়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিশেষ আত্মপ্রকাশ ঘটে এবং তখন থেকেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রকাশ্য অভিব্যক্তির শুরু হয়। বলা যায়, একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র ও একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে বিশ্ব স্বীকৃতি পাওয়ার অনেক আগে থেকেই এ অঞ্চলের মানুষের মনে জাতীয়তাবাদী চিন্তার বিকাশ হতে শুরু করেছিল। আধুনিক রাষ্ট্রতাত্ত্বিক অর্থে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভবের আগেই বাঙালি জাতীয়তাবাদ স্বতান্ত্রিক শক্ত অবস্থান করে নিয়েছিল এবং সে চেতনাই বাংলাদেশের উদ্ভবকে অনিবার্য করে তোলে।

আরও দেখুন:   সামন্তবাদের বৈশিষ্ট্য | সামন্তবাদ এর বৈশিষ্ট্য

বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ

নিচে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশের পর্যায়সমূহ তুলে ধরা হলো:

১. বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন

পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর ওপর উর্দু ভাষা চাপিয়ে দিয়ে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র-জনগণ তখন থেকেই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। মূলত ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই পাকিস্তানের মাটিতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিস্তার ঘটে।

২. যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন

১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে বিরোধী দলসমূহ ঐক্যবদ্ধভাবে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে এবং ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে। যুক্তফ্রন্টও নির্বাচনে পূর্ব বাংলার স্বাধিকারের দাবিসহ অন্যান্য দাবি নিয়ে অংশগ্রহণ করায় পূর্ব বাংলার জনগণ বিপুলভাবে সমর্থন জানায়। মূলত এর মাধ্যমে মুসলিম লীগ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কাছে আস্থা হারাতে থাকে এবং পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ নির্বাচনে বিজয়ের ফলে পূর্ববঙ্গের যথার্থ প্রতিনিধিগণ দ্বিতীয় গণপরিষদের সদস্যপদ লাভ করেন। এতে তারা তাদের ঐক্যের গুরুত্ব ও শক্তি সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে।

৩. ছয়দফা আন্দোলন

বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবাদের ধারণার উন্মেষ ঘটানোর ক্ষেত্রে ছয় দফার গুরুত্ব অপরিসীম। ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাঙালি জাতিকে ৬-দফা ভিত্তিক কর্মসূচি প্রদানের মাধ্যমে অধিকার বা স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আহ্বান জানান। ছয়দফা কর্মসূচি প্রদানের মাধ্যমে অধিকার বা স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আহ্বান জানান। ছয়দফা কর্মসূচি বাঙালী জাতীয়তাবাদের ধারাতে সর্বপ্রথম অর্থনৈতিক উপাদানের সংযোজন ঘটিয়ে প্রগতিশীল সমাজবাদী আন্দোলনের সূত্রপাত করে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছিলেন ছয় দফা আন্দোলনের প্রবক্তা। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। আসলে এ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাই বিশ্বের বুকে জনগণের জাতীয়তাবাদের পূর্ণতার স্বীকৃতি এনে দেয়। ছয়দফা এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে বাঙালির জাতীয় চেতনাবোধ আরো সুদৃঢ় হয়ে ওঠে এবং পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করে।

৪. গণ-অভ্যুত্থান

১৯৬৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তানি শাসকচক্রের বিরুদ্ধে বাংলার জনগণ তীব্র প্রতিবাদ গড়ে তোলে। এগারো দফা দাবিতে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি ছাড়াও ছাত্র-কৃষক শ্রমিকের দাবি অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাই সব শ্রেণির মানুষ এ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। এ আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতিতে আইয়ুব সরকারের পতন ঘটলে এ অঞ্চলের জনগণ তাদের আত্মশক্তিতে আরো বলীয়ান হয়ে ওঠে। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান স্বাধিকার আন্দোলনের সাফল্যের সাক্ষ্য হিসেবে এদেশের ইতিহাসকে অলংকৃত করেছে। এদেশের মানুষ তাদের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এবং তাকে বাস্তবায়িত করার জন্য জীবনদানের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে বিকাশ ঘটিয়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের।

৫. ১৯৭০-এর নির্বাচন

বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশে ১৯৭০ সালের নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ নির্বাচন আওয়ামী লীগের একচেটিয়া বিজয় প্রমাণ করে যে, পূর্ব বাংলার জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন হতে মুক্ত হয়ে নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে চায়। তাছাড়া এ নির্বাচনে জয়লাভের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের বাংলাভাষী জনগণের জাতীয় সংহতি আরো সুদৃঢ় হয়।

‘৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রাম বাংলার জনগণ তাদের জাতীয়তাবাদের চরম বিকাশ ঘটিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েমের জন্য ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। তারপর নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বাস্তব রূপ লাভ করে। স্বাধীনতার পর বাঙালি জাতীয়তাবাদকে অন্যতম রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

উপরিউক্ত আলোচনার সমাপ্তিতে বলা যায়, বাঙালি জাতীয়তাবাদের অভিব্যক্তি ঘটেছিল ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে, আর তা বাস্তব রূপ লাভ করেছিল ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে। তাই ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত এ ঘটনা প্রবাহ বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের মূল ভিত্তি কোনটি?

ঐক্য ও সংহতি।

Related Posts