ব্রিটিশ ভারত খণ্ডিত হয়ে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে পূর্ব বাংলার জনগণ তাদের ঐতিহ্য, কৃষি, সংস্কৃতি সর্বোপরি যে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম শুরু করে, তার মধ্যে ভাষা আন্দোলন অন্যতম। মূলত এ আন্দোলন সাংস্কৃতিক আন্দোলন হলেও এ আন্দোলন বাঙালি জাতিকে রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়। ফলে বাঙালিদের মধ্যে জাতীয়তাবোধের জন্ম নেয়। যার ফলশ্রুতিতে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালিরা ১৯৭১ সালে বিশ্বের মানচিত্রে নতুন দেশ হিসেবে ‘বাংলাদেশ’ নামে একটি নতুন রাষ্ট্র সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়।
আরও দেখুন: সামাজিক নীতি কি | সামাজিক নীতির সংজ্ঞা
ভাষা আন্দোলনের পটভূমি
দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রকদের চিন্তা-চেতনায় সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তি প্রবল ছিল। ভাষা আন্দোলন ধর্মভিত্তিক ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিপরীতে এক নতুন মাত্রা সংযোজন করে। পাকিস্তানি শাসকদের মূল উদ্দেশ্য ছিল, বাংলাভাষাকে ইসলামিকরণ, আদি বাংলা শব্দে আরবি ও ফারসি শব্দের অনুপ্রবেশ, মূল বাংলা বর্ণমালার ভিত্তিতে তৈরি ভাষা সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি তথা সামাজিক কাঠামো ভেঙে উর্দুভাষাকে রাষ্ট্রভাষার নামে প্রচলন করে বাংলা ভাষার মৌলিক কাঠামোতে আঘাত করা। নিচে ভাষা আন্দোলনের পটভূমি এর বিভিন্ন ধাপ তুলে ধরা হলো:
বাংলা ভাষা-ভাষীর সংখ্যা বেশি
যেখানে উর্দু ভাষায় কথা বলে ৭.২% মানুষ; পক্ষান্তরে বাংলা ভাষায় কথা বলে ৫৪.৬% মানুষ। সুতরাং এক্ষেত্রে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে বাংলার দাবি যৌক্তিক। অথচ এ দাবি উপেক্ষিত হতে থাকে। দ্রোহের আগুনে বলীয়ান বাঙালি জাতি সরকারের হীনচক্রান্তের বিরুদ্ধে মেতে ওঠে। এভাবেই শুরু হয় ভাষা আন্দোলন।
ভাষা বিতর্ক
১৯৪৭ সাল পরবর্তী সময়ে ভাষা নিয়ে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন হতে থাকে। ১৯৪৭ সালের ১৭ মে মুসলিম লীগ নেতা চৌধুরী খালিকুজ্জামান এবং আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে জোরালো বক্তব্য উত্থাপন করেন। বাংলা ভাষার প্রশ্নে এ সময়ে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে প্রবল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। তাঁরা যুক্তিসহকারে পত্রপত্রিকায় প্রবন্ধ প্রকাশ করতে থাকেন। বাংলার বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলা ভাষার পক্ষে শক্তিশালী এবং যৌক্তিক দাবি তুলে ধরেন।
আরবি হরফে বাংলা লেখার ষড়যন্ত্র
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান আরবি হরফে বাংলা লেখার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। মুসলিম লীগের এ ষড়যন্ত্রের উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ঐক্য জোরদার করা। এ পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বাংলা ভাষা ও বাঙালি ঐতিহ্য রক্ষার্থে পূর্ব বাংলার জনগণ প্রবল প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
গণতান্ত্রিক যুবলীগের আন্দোলন
পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর আরবি হরফে বাংলা লেখার চক্রান্ত নস্যাৎ হলে শাসক গোষ্ঠী তাদের অপতৎপরতা বন্ধ করেনি। দেশে প্রচলিত ডাকটিকেট, মানি অর্ডার ফরম, রেলগাড়ির টিকেট, খাম, মুদ্রায় উর্দু ব্যবহার এবং সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উর্দু ভাষা ব্যবহারের আদেশে বাংলার শিক্ষিত সমাজ তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তুলতে তৎপর হয়।
১৯৪৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত সম্মেলনে গণতান্ত্রিক যুবলীগ বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার মাধ্যম এবং আইন আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহারের দাবি জানায়। কামরুদ্দীন আহমদকে আহ্বায়ক করে গণআজাদী লীগ নামে একটি সংগঠন গড়ে ওঠে। তারা বাংলাকে পূর্ব বাংলার রাষ্ট্র ভাষা দাবি করে।
তমদ্দুন মজলিস
১৯৪৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাসেমের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ‘তমদ্দুন মজলিস’। ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা বাংলা না উর্দু’ শীর্ষক এক প্রচার পুস্তিকায় বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন এবং আইন আদালতের ভাষা করার দাবি করা হয়। ১৯৪৭ সালের ২৭ নভেম্বর করাচীতে পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করার সুপারিশ গৃহীত হয়। এ খবরে ঢাকায় সচেতন শিক্ষিত মহল বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ৬ ডিসেম্বর বাংলা ভাষার দাবিতে ঢাকায় ছাত্র বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ঢাকার প্রধান প্রধান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আগত ছাত্রদের নিয়ে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ডিসেম্বর মাসে আন্দোলন সুসংগঠিত রূপ লাভ করে। ১২ ডিসেম্বর ঢাকায় উর্দু ও বাংলা সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে তাৎপর্যপূর্ণ।
আরও দেখুন: সামাজিক নীতির বৈশিষ্ট্য
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন
১৯৪৭ সালে করাচিতে এক শিক্ষা সম্মেলনে ফজলুর রহমান উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করলে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি আরো চাঙ্গা হয়ে ওঠে। পকিস্তান সরকার উর্দুর পক্ষে যতই চেষ্টা করতে থাকে বাংলাভাষার দাবি ততই সংঘবদ্ধ হতে থাকে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৪৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সম্মুখে আমতলায় এক বিক্ষোভ সভাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রভাষার দাবিকে আরো জোরদার করার লক্ষে এ সমাবেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক ও বিভিন্ন সংগঠনের নেতাদের নিয়ে গঠিত হয় ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’।
রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের দাবি
১৯৪৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনের কার্যক্রমের ভাষা হিসেবে উর্দু ও ইংরেজিকে নির্ধারণ করা হয়। কুমিল্লা হতে নির্বাচিত গণ-পরিষদের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এক্ষেত্রে উর্দুর পাশাপাশি ‘বাংলা’ ব্যবহারের দাবি উত্থাপন করলে এ সম্পর্কিত প্রস্তাব অগ্রাহ্য হয়। ১৯৪৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার দাবি অগ্রাহ্য হওয়ায় ঢাকায় তীব্র বিক্ষোভ দেখা দেয়।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ হরতাল ও গণআন্দোলন
ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাব গণপরিষদে বাতিলের খবর ঢাকাসহ পূর্ব পাকিস্তানের জনমনে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ১১ মার্চ ১৯৪৮ রাষ্ট্রভাষা বাংলা সমর্থনে প্রদেশব্যাপী সকল প্রতিষ্ঠানে এবং ঢাকায় সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হয়। পিকেটিং-এর প্রাথমিক পর্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হন এবং এর পরে গ্রেফতার হন গোলাম মাহবুব। এর ফলে আন্দোলন আরো তীব্র আকার ধারণ করে। এ সংবাদ ঢাকার বাইরে ছড়িয়ে পড়লে সারাদেশে উত্তেজনা সৃষ্টি হয় এবং ছাত্ররা দেশব্যাপী প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কায় প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিউদ্দীন আপোষ আলোচনার প্রস্তাব রাখেন এবং ১৫ মার্চ ১৯৪৮ সালে সংগ্রাম পরিষদের কাছে শান্তি প্রস্তাব পাঠান। মুখ্যমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনার পর সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক শামসুল আলম আট দফা সংবলিত চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এ ৮ দফার মধ্যে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ও গণপরিষদে তা অনুমদিত করার বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়। প্রাথমিক পর্যায় খাজা নাজিমউদ্দীন স্বীকার করলেও শেষ পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত হয় নি।
জিন্নাহর উর্দুর সপক্ষে জোরালো বক্তব্য ও প্রবল প্রতিবাদ
২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে এবং উর্দুর সপক্ষে জোরালো বক্তব্য প্রদান করেন। ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে সমাবেশ অনুষ্ঠানে জিন্নাহ একমাত্র উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হবে বলে ঘোষণা করার সাথে সাথে উপস্থিত ছাত্ররা ‘না’ ‘না’ বলে প্রবল প্রতিবাদ করে।
উপরোক্ত কারণগুলোই ছিলো ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পটভূমি । লেখাটি ভালো লাগলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন।