মূল্য নির্ধারণের উদ্দেশ্য
কোনো বিপণন কার্যই সুচিন্তিত উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য ছাড়া সঠিকভাবে সম্পাদন করা যায় না। মূল্য নির্ধারণের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। মূল্য স্থির করার পূর্বেই ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে মূল্য নির্ধারণের লক্ষ্য ঠিক করে নিতে হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিকট মূল্য নির্ধারণের উদ্দেশ্য বিভিন্ন প্রকার হতে পারে। নিম্নে প্রধান প্রধান উদ্দেশ্য সমূহের উপর আলোকপাত করা হলো:
১. বিনিয়োগ বা নিট বিক্রির উপর নির্দিষ্ট মুনাফা অর্জন
বিনিয়োগে বা নিট বিক্রয়ের উপর নির্দিষ্ট শতকরা হারে মুনাফা অর্জনের নিমিত্ত কোনো প্রতিষ্ঠান (firm) পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করতে পারে। কতিপয় গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, প্রায় সব প্রতিষ্ঠানই উপরিউক্ত লক্ষ্য হাসিলের জন্য তাদের পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে থাকে। অধ্যাপক স্ট্যান্টন এ জাতীয় কয়েকটা মার্কিন গবেষণার বিষয় তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। অনেক খুচরা বিক্রেতা ও পাইকার মূল্য নির্ধারণের লক্ষ্য হিসেবে ‘নিট বিক্রির উপর নির্দিষ্ট মুনাফা’ নীতি প্রয়োগ করে থাকে। শতকরা নির্দিষ্ট পরিমাণ অংক তারা বিক্রির উপর যোগ করে যাতে প্রত্যাশিত (anticipated) প্রচলন ব্যয় ও আকাঙ্ক্ষিত মুনাফা কভার হয়ে আসে। এরূপ ক্ষেত্রে মুনাফার হার একই রকম থাকতে পারে; তবে বিক্রিত পণ্যের পরিমাণে হ্রাস-বৃদ্ধির সাথে সাথে মোট মুনাফার পরিমাণে তারতম্য হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল মোটরস, জন্স ম্যানিভিল ও ইউনিয়ন কারবাইডের মতো নেতৃস্থানীয় শিল্পসমূহ বিনিয়োগের উপর নির্দিষ্ট মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে পণ্যসামগ্রীর মূল্য নির্ধারণ করে থাকে। আমাদের দেশেও বহু লব্ধপ্রতিষ্ঠ শিল্পকারখানা রয়েছে যারা একই উদ্দেশ্য পরিপূরণের জন্য তাদের পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে।
বাংলাদেশের সেবা খাত সমূহ আলোচনা কর |
২. মূল্যে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা
পণ্যের মূল্যে স্থিতিশীলতা বজায় রেখে নির্বিঘ্নি মুনাফা অর্জন কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানের মূল্য নির্ধারণের লক্ষ্য। যেসব শিল্পে চাহিদা ঘন ঘন, এমনকি মাঝে মাঝে ব্যাপকভাবে উঠানামা করে, সেসব শিল্পের অন্তর্গত বৃহৎ ফার্মসমূহ তাদের মূল্য নির্ধারণে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার চেষ্টা করে। মূল্য নির্ধারণে স্থিতিশীলতা কামনার প্রধান কারণ হলো মূল্য-যুদ্ধ (Price war) পরিহার করা। মূল্য-যুদ্ধ বলতে বুঝায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমজাতীয় পণ্যের মূল্য হ্রাস করে বাজার দখল করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া। এ ধরনের বাণিজ্যিক যুদ্ধ সবার জন্য ক্ষতিকর বলে উৎপাদক বা ব্যবসায়ীরা মূল্যে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার পক্ষপাতি।
৩. বাজার অক্ষুণ্ণ রাখা বা পরিবর্ধন করা
ক্ষুদ্র এবং বৃহৎ সব ধরনের প্রতিষ্ঠানই অনেক ক্ষেত্রে মূল্য নির্ধারণের অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে বর্তমানে দখলীকৃত বাজার অক্ষুন্ন রাখার চেষ্টা করে কিংবা বাজারের পরিধি আরও বিস্তৃত করার প্রয়াসী হয়। একটি প্রতিষ্ঠান কতটুকু বাজার তার দখলে আছে তা বিভিন্ন উপায়ে নির্ণয় করতে পারে। সে যদি দেখে যে, বর্তমান বাজার বজায় রাখতে পারলেই তার জন্য যথেষ্ট তবে সে এমনভাবে পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করতে পারে যেন তার বাজার বিঘ্নিত না হয়। পক্ষান্তরে, বাজারে শেয়ার বিস্তৃত করার প্রয়োজন বোধ করলে সে প্রতিষ্ঠান তা বাস্তবায়িত করার জন্য মূল্য নির্ধারণ নীতি অনুরুপভাবে গড়ে তুলবে।
৪. বিক্রয় প্রবৃদ্ধি
পণ্যের বিক্রির পরিমাণ বৃদ্ধি করাও মূল্য নির্ধারণের অন্যতম উদ্দেশ্য। অধিকাংশ কোম্পানিই বিক্রয় বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে সঠিকভাবে মূল্য নির্ধারণের জন্য প্রচেষ্টা চালায়। তারা এমনভাবে মূল্য নির্ধারণ করে যাতে পণ্যের বিক্রয় বৃদ্ধি পায়।
৫. প্রতিযোগিতা মোকাবেলা বা প্রতিহত করা
অনেক প্রতিষ্ঠান, তা বড় কিংবা ছোট যাই হোক না কেন, শুধু প্রতিযোগিতা মোকাবেলা করার জন্য সচেতনভাবে পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে। তারা বাজারে প্রতিযোগিতা প্রকট আকার ধারণ করার জন্য সচেতনভাবে পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে। বাজারে প্রতিযোগিতা প্রকট আকার ধারণ করলে পণ্যের মূল। অপরিবর্তিত বা উচ্চ রেখে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব হয় না। এমতাবস্থায় এমনভাবে পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করা হয় যেন প্রতিযোগিরা এঁটে উঠতে না পারে কিংবা এঁটে উঠতে পারলেও যেন সমানে সমানে থাকে। একই জাতীয় পণ্য উৎপাদকদের প্রতিযোগিতা প্রতিহত করার উদ্দেশ্য নিয়েও অনেক প্রতিষ্ঠান পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে থাকে।
৬. মুনাফা বৃদ্ধি করা
সম্ভবত অধিক পরিমাণ মুনাফা অর্জনের নিমিত্ত অনেক প্রতিষ্ঠান পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে। মূল্য নির্ধারণের লক্ষ্য হিসেবে অধিক মুনাফা সম্বত অন্যান্য পলিসির চেয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে বেশি পছন্দনীয় ও অধিক অনুসৃত।
৭. মূল্য-বিবর্জিত প্রতিযোগিতা
প্রতিযোগিরা অনেক ক্ষেত্রে মূল্য না কমিয়ে অন্যভাবে বিক্রির পরিমাণ বাড়িয়ে মুনাফা বৃদ্ধির চেষ্টা চালায়। তাই প্রত্যেক কোম্পানিরই চেষ্টা করা উচিত এমনভাবে মূল্যনীতি ঠিক করা, যাতে অন্যান্য প্রতিযোগিদের মূল্য-বিবর্জিত প্রতিযোগিতা মোকাবেলা করা সম্ভব হয়।
সেবা কি বা কাকে বলে? সেবার বৈশিষ্ট্য কি কি? |
মুনাফা বৃদ্ধি সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে কাম্য নয় বলে অনেকে এটির সমালোচনা করে থাকেন। তাই এ ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। মূল্য নির্ধারণের লক্ষ্য হওয়া উচিত প্রত্যেক আইটেমের উপর মুনাফা বর্ধিত না করে সামগ্রিকভাবে সব পণ্যের উপর মুনাফা বৃদ্ধি করা। অনেক উৎপাদক মোটা মুনাফা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কতিপয় আকর্ষণীয় আইটেম বিনা লাভে বিক্রি করে গ্রাহক আকর্ষণ করে। আগত গ্রাহকগণ সাধারণত অন্যান্য পণ্যের প্রতিও দৃষ্টি দেয় এবং তা খরিদ করে। ফলে সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠানের মুনাফা বৃদ্ধি পায়।