১৯৫৬ সালের সংবিধান
১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন অনুযায়ী ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে ভারতীয় ইউনিয়ন ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার সুদীর্ঘ ৯ বছর পর প্রথম সংবিধান প্রণয়ন করে। পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ একটি সংবিধান প্রণয়নে কতকগুলো জটিল সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার কারণে দীর্ঘ সময় নিয়ে পাকিস্তানের দ্বিতীয় গণপরিষদ জাতিকে একটি সংবিধান দিতে সক্ষম হয়। ১৯৫৬ সালের জানুয়ারি মাসে সংবিধানের খসড়া প্রস্তুত করে আইনমন্ত্রী আই.আই. চন্দ্রীগড় কর্তৃক তা গণপরিষদে পেশ করা হয়। ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি উক্ত সংবিধান গণপরিষদে গৃহীত হয় এবং ২৩ মার্চ থেকে নতুন সংবিধান কার্যকর হয়।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনের ফলাফল আলোচনা কর |
১৯৫৬ সালের সংবিধানের বৈশিষ্ট্য সমূহ
যদিও ১৯৫৬ সালে প্রবর্তিত সংবিধান ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে বাতিল করা হয় তথাপি উক্ত সংবিধান কিছু বৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধ ছিল। নিম্নে ১৯৫৬ সালের সংবিধানের বৈশিষ্ট্য সমূহ আলোচনা করা হলো।
১. ইসলামি প্রজাতন্ত্র
১৯৫৬ সালের সংবিধানে পাকিস্তানকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সংবিধানে উল্লেখ করা হয় যে, মুসলমান ছাড়া কেউ পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন না। রাষ্ট্রপতি পরোক্ষভাবে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য কর্তৃক নির্বাচিত হবেন।
২. বৃহত্তম সংবিধান
সংবিধান বিশেষজ্ঞ মহল মনে করেন যে, ১৯৫৬ সালে প্রবর্তিত পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান ছিল পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম সংবিধান। এতে মোট ১০৫ পৃষ্ঠা, একটি প্রস্তাবনা, ১৩টি অংশ, ২৩৪টি বিধি ও ৬টি তালিকা ছিল। সংবিধানে সংখ্যালঘু তথা তফসিলী সম্প্রদায়, অনুন্নত শ্রেণি, দেশীয় রাজ্য ও তাদের শ্রেণি স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
৩. ইসলামিক বিধানসমূহ
১৯৫৬ সালে প্রবর্তিত পাকিস্তানের সংবিধানে পাকিস্তানকে Islamic Republic of Pakistan ঘোষণা করায় ইসলামিক বিধিবিধানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সংবিধানের প্রস্তাবনা শুরু হয় পরম করুণাময় আল্লাহর নামে। গণতন্ত্র, সাম্য, সহনশীলতা, সামাজিক সুবিচার ইত্যাদি ক্ষেত্রে ইসলামি বিধিবিধান অনুসরণ করা হয়।
৪. গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন
পাকিস্তানের নতুন সংবিধানে রাষ্ট্রীয় শাসন পদ্ধতি হিসেবে গণতন্ত্রকে উল্লেখ করা হয়। গণতন্ত্রে জনসাধারণের চিন্তাচেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এতে জনসাধারণের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।
৫. লিখিত সংবিধান
১৯৫৬ সালে প্রবর্তিত পাকিস্তানের সংবিধান একটি সুস্পষ্ট দলিল। এর অধিকাংশ ধারা-উপধারা লিপিবদ্ধ আকারে ছিল। এর ফলে সংবিধান সংক্রান্ত কোনো জটিলতার সম্ভাবনা তিরোহিত হয়।
৬. দুষ্পরিবর্তনীয়
পাকিস্তানের সংবিধান দুষ্পরিবর্তনীয় প্রকৃতির। এর কোনো ধারা পরিবর্তন বা সংশোধন করতে বিশেষ পদ্ধতির আশ্রয় নিতে হয়। অর্থাৎ জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থনে কোনো সংশোধনী বিল উত্থাপন করা গেলেও মোট সদস্যের দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থনে উক্ত বিল পাস হতো।
৭. যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা
১৯৫৬ সালের সংবিধানে পাকিস্তানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। মূলত পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান এ দুটি প্রদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হয়। সেই সাথে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে সংবিধানের আলোকে ক্ষমতা বণ্টন করে দেওয়া হয়।
৮. সংসদীয় শাসনব্যবস্থা
পাকিস্তানের নতুন সংবিধান কেন্দ্র ও প্রদেশে সংসদীয় তথা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করে। আইনসভায় জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রাধান্য থাকবে। শাসন ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিসভার হাতে ন্যস্ত করা হয় এবং মন্ত্রিসভার যাবতীয় কর্মকাণ্ডের জন্য আইনসভার কাছে দায়িত্বশীল রাখা হয়।
৯. এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা
এ আইনের মাধ্যমে পাকিস্তানের জন্য এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভার ব্যবস্থা রাখা হয়। যদিও পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সদস্যসংখ্যা ৩০০। ১৫০ জন সদস্য পূর্ব পাকিস্তান থেকে এবং বাকি ১৫০ জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত হবার ব্যবস্থা রাখা হয়। আবার প্রাদেশিক আইনসভাকেও এককক্ষবিশিষ্ট করা হয়। এর সদস্য সংখ্যা ৩০০। তবে মহিলাদের জন্য ১০টি আসন সংরক্ষিত রাখা হয়।
১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের পটভূমি আলোচনা কর |
১০. মৌলিক অধিকারের উল্লেখ
পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারসমূহ উল্লেখ করা হয়। মৌলিক অধিকারসমূহ বলবৎ করার জন্য আদালতকে এখতিয়ার দেওয়া হয়। তঅর্থাৎ মৌলিক অধিকার ভঙ্গ হলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি আদালতের শরণাপন্ন হয়ে সুবিচার লাভ করতে পারবে।
১১. প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন
পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান এ দুটি প্রদেশ নিয়ে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হয়। প্রদেশগুলোকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়। সংবিধানে উল্লেখ করা হয় যে, প্রাদেশিক সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপ মুক্ত হয়ে দায়িত্ব পালন করবে। প্রাদেশিক আইনসভার কাছে শাসন বিভাগকে দায়বদ্ধ রাখা হয়।
১২. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা
সংবিধানের প্রাধান্য রক্ষা ও নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ এবং সর্বোপরি সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা স্বীকৃত হয়। এ লক্ষ্যে একটি সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট এবং প্রত্যেক প্রদেশে একটি করে হাইকোর্ট ও অধস্তন আদালত গঠনের ব্যবস্থা রাখা হয়। এছাড়া কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যকার বিরোধ মীমাংসার জন্য সুপ্রিম কোর্টকে এখতিয়ার দেওয়া হয়।
১৩. জরুরি বিধান
দেশের মধ্যে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হলে রাষ্ট্রপতি কোনো প্রদেশের সরকারের ক্ষমতা গ্রহণ করতে পারেন। তাছাড়া পার্লামেন্টও কোনো প্রদেশের জন্য আইন তৈরি করতে পারে। অবশ্য এরূপ অবস্থায় নাগরিক অধিকার স্থগিত রাখা হয়।
১৪. রাষ্ট্রভাষা
পাকিস্তানের দু অংশের ভাষা সম্পূর্ণ ভিন্ন। পশ্চিম পাকিস্তানিদের ভাষা উর্দু আর পূর্ব পাকিস্তানিদের ভাষা বাংলা। রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে প্রাণ দিয়েছে। সেই আন্দোলনের প্রেক্ষিতে পাকিস্তান সরকার ১৯৫৬ সালের সংবিধানে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়।
১৫. রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি
এ সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার কয়েকটি মূলনীতির সন্নিবেশ করা হয়। যেমন- বিশ্বভ্রাতৃত্ব, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমতা প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। তবে এ মূলনীতিগুলো আদালত কর্তৃক বলবৎযোগ্য নয়।
১৬. প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থা
এ সংবিধানে পাকিস্তানকে একটি প্রজাতন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এ ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি নামসর্বস্ব রাষ্ট্রপ্রধানের ভূমিকায় বিবেচিত হন। কারণ রাষ্ট্রপতিকে আইনসভার সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত হওয়ার বিধান রাখা হয়।
১৭. সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সংরক্ষণ
সংবিধানে ইসলামি আদর্শ ও বিধিবিধানের প্রাধান্য স্বীকৃত হলেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বার্থরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। অর্থাৎ সকল ধর্মের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান করা হয়।
১৮. জনগণের সার্বভৌমত্ব
সংবিধানে জনগণকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার উৎস হিসেবে উল্লেখ করা হয় এবং জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে সকল প্রকার আইন প্রণয়নের ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়। এছাড়া পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে পাকিস্তানের উভয় অংশের মধ্যে সাম্যাবস্থায় স্বাধীন নির্বাচন কমিশন ও সরকারি কর্মকমিশন গঠনের বিধান রাখা হয়।
দীর্ঘ ৯ বছর পর পাকিস্তান সর্বপ্রথম ১৯৫৬ সালে যে সংবিধান লাভ করে তা ছিল একটি আদর্শ সাংবিধান। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছিল বটে কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এ সংবিধান বেশি দিন কার্যকর হয়নি। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি ইস্কান্দার মির্জা সারাদেশে সামরিক আইন জারি করেন, সংবিধান বাতিল করেন এবং কেন্দ্রীয় ও প্রদেশের আইনসভা ও মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে সকল রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।
আশাকরি, উপরের আলোচনা থেকে আপনারা ১৯৫৬ সালের সংবিধানের বৈশিষ্ট্য সমূহ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছেন।