রচনা: কাজী নজরুল ইসলাম
ভূমিকা
বিদ্রোহ ও তারুণ্যের কবি কাজী নজরুল ইসলাম । বাংলাকাব্যে ধূমকেতুর মতোই তাঁর আবির্ভাব। পচনধরা প্রথাগত সমাজকে ভেঙেচুরে স্বাস্থ্যকর নতুন এক সমাজ নির্মাণ করাই তাঁর স্বপ্ন ছিল। তাই তিনি বিদ্রোহ করেছিলেন সকল অন্যায়, অসত্য, শোষণ-নির্যাতন আর দুঃখ-দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে। ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ এবং পরাধীনতার গ্লানি থেকে জাতিকে মুক্ত করতে তিনি কলম ধরেছিলেন। কবিতা লেখার অপরাধে তিনি কারারুদ্ধ হন। বন্দি করেও থামানো যায়নি তাঁর লেখা। দুঃখ, দারিদ্র্য এবং সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে তাঁর জীবন।
জন্ম ও শৈশব-কৈশোর
কাজী নজরুল ইসলাম ১১ই জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ বঙ্গাব্দে, ২৪শে মে ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম কাজী ফকির আহমদ এবং মাতার নাম জাহেদা খাতুন। শৈশবে, মাত্র আট বছর বয়সে তাঁর পিতা মারা যান। চরম আর্থিক অনটন আর দুঃখ-দারিদ্র্যের মধ্যেই তাঁর বাল্যকাল কাটে। গ্রামের মক্তবে প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর তিনি কিছুদিন স্থানীয় মাজারে খাদেম, মসজিদে ইমামতি ও মোল্লাগিরি করেন।
নজরুলের জন্মের পূর্বে তাঁর একাধিক ভাইবোন অকালে মারা যায়। এজন্য ছোটবেলায় নজরুলকে তাঁর পিতামাতা ‘দুখু মিয়া’ বলে ডাকতেন। খুব অল্প বয়সে তাঁর কবিত্বশক্তির প্রকাশ পায়। তিনি মুখে মুখে ছন্দ মিলিয়ে পদ্য রচনা করতে পারতেন। গ্রামের লেটোর দলে যোগ দিয়ে নজরুল গান গেয়েছেন, অনেক পালাগান রচনা করেছেন। ছোটবেলা থেকেই নজরুল ছিলেন মুক্তমনা। স্কুলের বাঁধাধরা জীবন তাঁর ভালো লাগত না। বাড়ি থেকে পালিয়ে তিনি মহকুমা শহর আসানসোলে গিয়ে রুটির দোকানে চাকরি নেন। রুটির দোকানের কাজের ফাঁকে নজরুল সুর করে গান গাইতেন, পুঁথি পড়তেন। প্রতিভাবান বালক হিসেবে তাঁর পানে মুগ্ধ হয়ে আসানসোলের দারোগা কাজী রফিজউল্লাহ নিজ বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার দরিরামপুরে এনে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। এখানে কিছুদিন পড়ালেখার পর নজরুল আবার গ্রামে ফিরে যান। ভর্তি হন শিয়ারশোল রাজ হাইস্কুলে।
১৯১৪ সাল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে সমগ্র ইউরোপে। নজরুল তখন দশম শ্রেণির ছাত্র। যুদ্ধের আহ্বান শুনে স্কুল থেকে পালিয়ে তিনি ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টনে সৈনিক হিসেবে যোগ দিয়ে চলে যান করাচি। নিজ দক্ষতার গুণে অল্পদিনের মধ্যে নজরুল হাবিলদার পদে উন্নীত হন। সেনাশিবিরে ব্যস্ততার মাঝেও তিনি সাহিত্যচর্চা চালিয়ে যান। করাচি থেকেই তিনি কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা পাঠান। তাঁর প্রথম লেখা ‘বাউণ্ডেলের আত্মকাহিনী’ নামে একটি গল্প এবং প্রথম কবিতা ‘মুক্তি’।
নজরুলের সাহিত্যিক জীবন
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর কলকাতায় ফিরে এসে নজরুল পুরোপুরি সাহিত্যে মনোনিবেশ করেন। এ সময় ভারতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন চলছিল। করাচি থেকে পাঠানো কয়েকটি লেখা পূর্বেই বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশের কারণে নজরুল কলকাতার কবি-সাহিত্যিক মহলে সমাদৃত হন। তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘বিদ্রোহী’ প্রকাশিত হলে নজরুলের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘ব্যথার দান’ এবং প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’ ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয়। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ, গানসহ প্রায় পঞ্চাশটি গ্রন্থ রচনা করেন। এ ছাড়া নজরুল ‘নবযুগ’ ‘ধূমকেতু’ ‘লাঙল’ ‘গণবাণী’ ইত্যাদি পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
নজরুলের লেখায় নিপীড়িত মানুষের মুক্তির কথা ধ্বনিত হয়েছে। তিনি লিখেছেন :
“মহা বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না
অত্যাচারীর খড়গ-কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না।
বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।”
নজরুলের শেষ জীবন
১৯৪২ সালে এক দুরারোগ্য মস্তিষ্কের রোগে নজরুল সম্পূর্ণ বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। অনেক চিকিৎসার পরও তিনি আর সুস্থ হননি। ১৯৭২ সালের ২৪শে মে কবিকে কলকাতা থেকে বাংলাদেশ সরকার এ দেশে নিয়ে আসেন এবং বাংলাদেশের জাতীয় কবির মর্যাদায় অভিষিক্ত করেন। ১৯৭৬ সালের ২৯শে আগস্টে ঢাকা পিজি হাসপাতালে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) নজরুলের মৃত্যু হয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়। গণমানুষের এই কবি চিরকাল আমাদের প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন।
আরও রচনা দেখুন:
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রচনা (১২৫০ শব্দ)
দেশ গঠনে ছাত্র সমাজের ভূমিকা রচনা