বাংলাদেশের কৃষক
ভূমিকা
নদীমাতৃক ও নদীবিধৌত বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এ দেশের মানুষের জীবিকার প্রধান উপায়ও কৃষি। এই প্রেক্ষাপটেই কৃষককে বলা হয় ‘জাতির মেরুদণ্ড’। অক্লান্ত পরিশ্রমে কৃষক ফলায় সোনার ফসল, দেশবাসী পায় ক্ষুধার অন্ন। কৃষকের উৎপাদিত কৃষিপণ্য বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে সমৃদ্ধ হয় দেশের অর্থনীতি, দেশ এগিয়ে যায় শিল্পায়নের পথে। তাই দেশের অর্থনীতিতে কৃষি ও কৃষকের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
জাতীয় অর্থনীতিতে কৃষকের ভূমিকা
জাতীয় অর্থনীতিতে কৃষকের ভূমিকা অপরিসীম। জনসংখ্যাবহুল আমাদের দেশে খাদ্য-সমস্যা মোকাবেলা কৃষি-উৎপাদনের ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। কৃষি-উৎপাদন হ্রাস পেলে দ্রব্যমূল্য নাগালের বাইরে চলে যায়। কৃষিভিত্তিক শিল্প-কারখানার স্বাভাবিক উৎপাদনে সংকট দেখা দেয়। পক্ষান্তরে কৃষি-উৎপাদন ভালো হলে অর্থনীতি হয়ে ওঠে চাঙা।
জাতীয় আয় সৃষ্টিতে কৃষকের ভূমিকা
জাতীয় আয় সৃষ্টিতে কৃষি ও কৃষকের ভূমিকা ইতিবাচক। আমাদের দেশে খাদ্যদ্রব্য, নিত্য প্রয়োজনীয় কৃষিদ্রব্য ও শিল্পের কাঁচামাল জোগায় কৃষি। তা সম্ভব হয় কৃষকের ঘাম- নিংড়ানো শ্রমে। কৃষকের উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। এভাবে কৃষক জাতীয় আয় বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে।
খাদ্য উৎপাদনে কৃষকের ভূমিকা
খাদ্য উৎপাদনে কৃষকের রয়েছে মুখ্য ভূমিকা। আমাদের দৈনন্দিন অপরিহার্য খাদ্য ভাত, মাছ, মাংস, ডাল, আলু, তরকারি, শাকসবজি সবই উৎপাদন করে কৃষক। কৃষকের উৎপাদিত খাদ্যই আমাদের জীবন বাঁচায়। চাষযোগ্য জমির স্বল্পতা, আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতির অভাব ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রাদুর্ভাব ইত্যাদি কারণে খাদ্য উৎপাদনে এ দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। তবুও বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ খাদ্যশস্য কৃষকই জোগান দিয়ে থাকে।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ রচনা
শিল্পায়নে কৃষকের অবদান
শিল্পায়নের ক্ষেত্রেও কৃষকের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। এ দেশের অনেক শিল্প কৃষি-নির্ভর ও কৃষিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। বাংলাদেশের কৃষকরা এসব শিল্পের প্রধান কিংবা একমাত্র জোগানদার। পাট ও বস্ত্রশিল্পের প্রধান উপকরণ আসে কৃষি থেকে। চিনিশিল্পের অন্যতম উপকরণ আখ কৃষকেরই উৎপাদিত পণ্য। দেশে এরকম অনেক শিল্প রয়েছে যেগুলোর কাঁচামালের জোগানদাতা এ দেশের কৃষক। কৃষকরাই জোগান দেয় শিল্প-শ্রমিকের খাদ্য।
রপ্তানি আয়ে কৃষি ও কৃষকের ভূমিকা
বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে বিশেষ ভূমিকা রাখার জন্যে একসময় পাটকে বাংলাদেশের ‘সোনালি আঁশ’ বলা হতো। এই পাট কৃষকের উৎপাদিত পণ্য। এখনও পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে দেশ যথেষ্ট বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে। পাটের পরে আছে চা। রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে চা-এর গুরুত্বও কম নয়।
কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কৃষি ও কৃষকের ভূমিকা
কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কৃষকের ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ। কৃষক যখন কৃষিকাজ করে তখন বিভিন্ন পর্যায়ে তাকে কৃষিশ্রমিক নিয়োগ করতে হয়। পাশাপাশি কৃষি থেকে উৎপন্ন কাঁচামাল দিয়ে প্রতিষ্ঠিত শিল্প-কারখানায়ও নতুন নতুন কর্মের সংস্থান হচ্ছে। বাংলাদেশে কৃষিতে নিয়োজিত জনশক্তির পরিমাণ প্রায় ৭০ শতাংশ।
কৃষকের সমস্যা
ফসল ও অন্যান্য কৃষিপণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিতে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও কৃষক প্রতিনিয়ত বিভিন্নমুখী সমস্যার সম্মুখীন। যেমন:
(ক) প্রশিক্ষণের অভাব: কৃষিফলন বাড়ানোর জন্যে চাই লাগসই উন্নততর প্রযুক্তির ব্যবহার। এ ক্ষেত্রে কৃষকের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্যে চাই উপযুক্ত প্রশিক্ষণ। কিন্তু কৃষকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে।
(খ) মূলধনের অভাব: মূলধনের অভাব এ দেশের কৃষকদের চিরায়ত সংকট। সহজ শর্তে সময়মতো প্রয়োজনীয় ঋণ পেলে কৃষকরা কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
(গ) সেচ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা: শুকনো মৌসুমে ইরি চাষের জন্যে পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ থাকে না। গভীর নলকূপ ক্রয়ের সামর্থ্য অধিকাংশ কৃষকের নেই।
(ঘ) কৃষি উপকরণের অভাব: উন্নতমানের বীজ, সার, কীটনাশকসহ কৃষির বিভিন্ন উপকরণের অভাবেও কৃষকদের চাষাবাদ ব্যাহত হয়।
(ঙ) ত্রুটিপূর্ণ বাজার: মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রাধান্যমূলক ত্রুটিপূর্ণ বাজার ব্যবস্থার কারণে কৃষক শস্যের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়।
কৃষকের বর্তমান অবস্থা
বাংলাদেশের অধিকাংশ কৃষক ভূমিহীন। অন্যের জমিতে তারা বর্গাচাষ করে। আবার অনেকের নিজস্ব হালের বলদসহ পুঁজির সমস্যা রয়েছে। বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য দাতা সংস্থার ও বৈদেশিক চাপে পড়ে সরকার দিন দিন কৃষির ওপর ভর্তুকি কমিয়ে আনছে। মধ্যস্বত্বভোগীরা কৃষিবাজার নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে অনেক সময়ে কৃষকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
উপসংহার
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষি ও কৃষকের ভূমিকা অপরিহার্য। কৃষকের শ্রম ও কার্যকর ভূমিকার ওপরেই বহুলাংশে নির্ভর করে এ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন। অথচ বাংলাদেশের কৃষকের অর্থনৈতিক অবস্থা এখনও নাজুক। বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলহানি থেকে এখনও কৃষক মুক্ত হতে পারেনি। কৃষিজাত পণ্যের ব্যাপক চোরাচালানও কৃষকের সামনে ক্রমশ হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের কৃষিকে যুগোপযোগী আধুনিকায়ন এবং কৃষকের সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নে সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন। তাহলেই বাংলাদেশের অবহেলিত দরিদ্র কৃষকদের ভাগ্য ফিরবে। আর কৃষকদের ভাগ্য ফিরলে বাংলাদেশও অর্থনৈতিক দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারবে।