মুক্তিযুদ্ধের আর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমি
আমাদের জাতীয় জীবনের এক অবিস্মরণীয় ঘটনা হলো ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ । এ মুক্তিযুদ্ধে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার মানুষ স্বাধীনতার প্রত্যাশিত লাল সূর্য ছিনিয়ে আনে। এর মাধ্যমে নিজের অধিকারকে ছিনিয়ে আনার জন্য এবং দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে স্বাধীন করার জন্য ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে স্থান দখল করে নেয়। আজ আলোচনা করবো মুক্তিযুদ্ধের আর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমি নিয়ে।
আরও পড়ুন: ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পটভূমি, গুরুত্ব ও ফলাফল
বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে দীর্ঘপথ পরিক্রমায় মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়। নিচে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পিছনে মুক্তিযুদ্ধের আর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমি আলোচনা করা হলো:
১. বাঙালির দাবি
বাঙালিদের অনেক দিনের দাবি ছিল একটি স্বাধীন বাংলাদেশ । তাই লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে যখন ১৯৪৭ সালে পাক-ভারত বিভক্ত হচ্ছিল, তখন বাঙালিরা পূর্ব বাংলাকে আলাদা একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে দাবি করতে থাকে। কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তানি শাকগোষ্ঠী তাদের স্বীয়স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য বাঙালির এ ন্যায্য দাবিকে উপেক্ষা করতে থাকে এবং ঔপনিবেশিক মনোভাব নিয়ে বাঙালিদের উপর শাসন শোষণ চালাতে থাকে।
২. ভাষা আন্দোলন
১৯৪৮-৫২ সালের ভাষা আন্দোলন সর্বপ্রথম বাঙালিদের স্বাধীনতার বীজ বুনে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা দিলে বাঙালি জাতি বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বাঙালি জাতি তাদের মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠিত করার দৃঢ় প্রত্যয়ে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রের সব বেড়াজাল ছিন্ন করে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে তাদের অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করে। এখান থেকেই এদেশের মানুষ দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার দীক্ষা পায়, যা মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণা যোগায়।
৩. আওয়ামী লীগ গঠন
ভাষা আন্দোনের সফলতা পূর্ব বাংলার জনমনে ব্যাপক উৎসাহ সৃষ্টি করে। তাই মুসলিম লীগের মেরুদণ্ডবিহীন কার্যকলাপ এবং পশ্চিম পাকিস্তানি ও সামন্তপ্রভুদের কার্যকলাপ বীতশ্রদ্ধ হয়ে এদেশের মানুষ আওয়ামী লীগ গঠন করে, যা স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকনির্দেশনায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
৪. যুক্তফ্রন্ট গঠন
অধিকার সচেতন এদেশের মানুষ ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সম্মিলিত যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। একুশ দফার ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ী হয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করে। বাঙালিদের এ বিজয়কে পাকিস্তানি চক্র সহজে মেনে নিতে পারে নি।
আরও পড়ুন: ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান : কারণ, ফলাফল ও গুরুত্ব
৫. কাশ্মীর যুদ্ধ
১৯৬৫ সালের কাশ্মীর যুদ্ধে বাঙালি সৈনিকরা তাদের শৌর্য বীর্যের নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করে। যুদ্ধের সময় পূর্ব বাংলার অর্থনীতি ভেঙে পড়ে, দেশে খাদ্য সংকট দেখা দেয়, দেশ সম্পূর্ণ নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে। যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি পূরণের জন্য সরকার এ দেশবাসীর উপর ট্যাক্সের বোঝা চাপিয়ে দেয়।
৬. শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপপ্রচার চালাতে থাকে। বাঙালি অবাঙালি শ্রমিকদের মধ্যে দাঙ্গা বাধিয়ে এদেশের সামাজিক জীবনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। ১৯৫৫ সালে গণপরিষদ ভেঙে দিয়ে অনেক নেতা কর্মীকে গ্রেফতার করে।
৭ . সামরিক অভ্যুত্থান
১৯৫৮ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করে নেয়। ক্ষমতা দখলের পর থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সামরিক কায়দায় এদেশের মানুষের উপর শোষন চালাতে থাকে। তাই জনগণ মুক্তির জন্য দিশেহারা হয়ে পড়ে।
৮. ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে যেসব বিষয় ও ঘটনা ত্বরান্বিত করেছে তন্মধ্যে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান অন্যতম। ১৯৬৯ সালে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠনের মধ্য দিয়ে ১১ দফা দাবিকে সামনে নিয়ে ছাত্র জনতার এক গণঅভ্যুত্থান ঘটে। ছাত্র শিক্ষকের রক্তে ভেজা এ গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা। আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে।
৯. অর্থনৈতিক বৈষম্য
পাক-ভারত বিভক্তির পর পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য চরম আকার ধারণ করে। অথচ প্রাথমিক পর্যায়ে জাতীয় আয়ের শতকরা ৫২ ভাগই ছিল পূর্ব বাংলার অবদান। পশ্চিম পাকিস্তানিরা এদেশের উৎপাদিত কাঁচামাল সেখানে নিয়ে সেখানকার শিল্পজাত দ্রব্য এদেশে রপ্তানি করে। এতে ব্যাংক, বিমা, শিল্পকারখানা, ব্যবসায়-বাণিজ্য এককভাবে পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে চলে যায়। পূর্ব পাকিস্তানিরা হয়ে পড়ে পশ্চিম পাকিস্তানি শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের কাঁচামালের যোগানদাতা।
১০. শিক্ষাব্যবস্থায় বৈষম্য
এদেশের শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিও পাকিস্তানিরা চরম বৈষম্য সৃষ্টি করে। এখানকার তুলনায় সে দেশে শিক্ষা সামগ্রীর সহজলভ্যতা এর বড় প্রমাণ।
১১. সাংস্কৃতিক আগ্রাসন
পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে শাসকগোষ্ঠী বিভিন্নভাবে এদেশের উপর সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালাতে থাকে। তারা এদেশের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার পাঁয়তারা করে। এমনকি কাশ্মীর যুদ্ধের পর এদেশের বেতারে রবীন্দ্র সঙ্গীতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
১২. জাতীয় পরিষদ স্থানান্তর
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বাঙালিদের অভূতপূর্ব সাফল্যে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হারাবার ভয়ে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ঢাকা থেকে রাওয়ালপিণ্ডিতে স্থানান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। ঢাকার বিভিন্ন অফিসে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ঢাকার পরিবেশকে অশান্ত করে তোলে এবং জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করে।
আরও পড়ুন: রেনেসাঁর বৈশিষ্ট্য গুলো কি কি?
১৩. বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ এদেশের মানুষকে স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে।
১৪. মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ
সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলায় অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে নরপিশাচ ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে সামারিক জান্তা এদেশের ঘুমন্ত মানুষের উপর রাতের অন্ধকারে অতর্কিত হামলা চালায়। সেদিন ছিল ২৫ মার্চ, ১৯৭১ সাল কিন্তু এদেশের স্বাধীনচেতা জনগণও বসে থাকে নি। তারা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতার লাল সূর্য কেড়ে আনে।
পরিশেষে বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধের যেসব আর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে বাঙালি জাতি জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের মধ্যে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের ঐতিহাসিক ছয় দফা, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলন অন্যতম। তাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমি অতি দীর্ঘ।