Home » মিশরীয় সভ্যতার প্রধান বৈশিষ্ট্য গুলো আলোচনা কর।
মিশরীয় সভ্যতার প্রধান বৈশিষ্ট্য

মিশরীয় সভ্যতার প্রধান বৈশিষ্ট্য গুলো আলোচনা কর।

by Susmi
0 comment

মিশরীয় সভ্যতার বৈশিষ্ট্য

বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে স্বমহিমায় উদ্ভাষিত, পৃথিবীব্যাপী আলো ছড়ানো সভ্যতা হলো মিশরীয় সভ্যতা। এই মিশরীয় সভ্যতা অন্যান্য সকল সভ্যতা থেকে আলাদা ও স্বাতন্ত্রিক। নিজের আলোচনায় স্বাতন্ত্রিক মিশরীয় সভ্যতার প্রধান বৈশিষ্ট্য গুলো সম্পর্কে উপস্থাপন করা হবে।

মিশরীয় সভ্যতার সামাজিক অবস্থা

মিশরবাসীরা তাদের নিজস্ব প্রয়োজনের তাগিদেই সমাজ সংগঠন গড়ে তুলেছে।

আইনের চোখে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাই সমান। কিন্তু সম্পদ অধিকারের বিষয়ে সমাজে শ্রেণি বিভাজনের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। মিশরীয় সমাজে মানুষ ছিল দুটি ধারায় বিভক্ত। এই দুটি শ্রেণির মধ্যে মুক্ত মানুষের নিজেদের প্রয়োজনে এক সমাজ কাঠামো থেকে অন্য সমাজ কাঠামোতে স্থানান্তরিত হতো। অপর শ্রেণিটি হচ্ছে দাস।

স্বাধীন মানুষের মধ্যেও শ্রেণী বিভাজন ছিল। মিশরীয় সমাজে স্বাধীন মানুষের মধ্যে কয়েকটি শ্রেণির অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। যথা: (ক) রাজপরিবার, (খ) পুরোহিত, (গ) অভিজাত; (ঘ) লিপিকর, (ঙ) ব্যবসায়ী, (চ) শিল্পী (ছ) কৃষক ও (জ) ভূমিদাস।

মুক্ত মানুষ ও ভূমিদাস উভয়কেই রাষ্ট্রীয় ও মন্দিরের কাজে অংশ নিতে হতো। প্রয়োজনের তাগিদে সৈন্যবাহিনীতেও যোগ দিতে হতো আবার ফারাওদের ব্যক্তিগত কাজও করতে হতো।

আরও পড়ুন:   সিন্ধু সভ্যতার বৈশিষ্ট্য গুলি কি কি?

মিশরীয় সভ্যতার অর্থনৈতিক অবস্থা

প্রাচীন মিশরীয়দের অর্থনৈতিক জীবন ছিল প্রাচুর্যপূর্ণ। টেকসই এই সভ্যতার প্রায় দুই হাজার বছর স্থায়ী হওয়ার পিছনে অন্যতম ভূমিকা রেখেছে মিশরীয় সভ্যতার অর্থনীতি।

১. কৃষি

নীলনদের অববাহিকা প্লাবিত হওয়ায় দু’কূলের উর্বর ভূমিতে পর্যাপ্ত ফসল জন্মাতো। উৎপাদন কাজের জন্য সাধারণ লাঙল, কাঠের কোদাল ও বাঁড় ব্যবহার করা হতো। লাঙল চালানোর জন্য দু’জন মানুষের প্রয়োজন হতো মিশরীয়দের উৎপাদিত ফসলের তালিকায় যব, গম, পীচ, পিঁয়াজ, কাউন, বার্লি, মটরশুঁটি, বর্বটি, লেটুস, তরমুজ, মুলা, কার্পাস, শণ জাতীয় তন্ত্র এবং বিভিন্ন বর্ণের শাকসবজি ও ফলমূল উল্লেখযোগ্য। কৃষকরা তাদের মোট উৎপাদনের ১০%-২০% কর হিসেবে সরকারি কোষাগারে প্রদান করত। কৃষির গুরুত্ব প্রসঙ্গে ওয়ার্ডব্যাংক ও ইবি টেইলর উল্লেখ করেছেন, ‘মিশরীয় ইতিহাসে কৃষি ছিল মূল অর্থনীতি।’

মিশরীয় মিথলজি - আদি থেকে অন্ত: এস এম নিয়াজ মাওলা - Egyptian Mythology: S M Niaz Mowla

TK. 2,000 TK. 1,748

২. পশুপালন

প্রাচীন মিশরে সে সময় গরু, ভেড়া, গাঁধা, ছাগল, কবুতর, মৌমাছি, রাজহাঁস, পাতিহাঁস প্রভৃতি পালন করত। পশুর চামড়া মূল্যবান অর্থকরী ফসল হিসেবে পরিচিত ছিল এবং পশুর চামড়ার উপর ভিত্তি করে প্রাচীন মিশরে চামড়া শিল্পের বিকাশ হয়েছিল।

৩. ব্যবসা-বাণিজ্য

মিশরীয় অর্থনীতির ভিত্তি কৃষি আর ব্যবসা-বাণিজ্য হলো মিশরীয় অর্থনীতির চালিকা শক্তি। এসময় গ্রিস, নুবিয়া, সিরিয়া, ইজিয়ান দ্বীপ, ফিনিশীয় ও প্যালেস্টাইনের সাথে মিশরের বাণিজ্য চলত। তাদের রপ্তানি দ্রব্যের তালিকায় গম, লিলেন কাপড়, মৃৎপাত্র, প্যাপিরাস ও চামড়া ছিল উল্লেখযোগ্য আর আমদানি দ্রব্যের তালিকায় হাতির দাঁত, স্বর্ণ, রৌপ্য, অস্ত্র, মসলা, সুগন্ধি দ্রব্য ও দেবদারু ও আবলুস কাঠ অন্যতম। ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার জন্য মিশরীয়রা বিভিন্ন ব্যবহারিক কলা-কৌশল হিসেবে কানুন শিখেছিল। এ প্রসঙ্গে Wallbank & E.B Tylor উল্লেখ করেছেন যে, ‘ব্যবসা-বাণিজ্যির ভিত্তি হিসেবে মিসরীয়রা বুককিপিং ও অ্যাকাউন্টিং সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেছিল এবং লেনদেন করত বিনিময়ের মাধ্যমে।’

৪. শিল্প

মিশরীয় সভ্যতায় অতি অল্পসময়ের মধ্যে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। প্রাচীন মিশরে খ্রিঃ পূর্ব ৩০০০ অব্দের দিকে শিল্পকারখানায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। প্রাচীন রাজবংশীয় যুগে শিল্পের উত্তরণ ঘটে এবং অতি দ্রুত গতিতে এর বিকাশ ঘটেছে। প্রাচীন মিশরে শিল্পের মধ্যে পাথর শিল্প, তাঁত শিল্প, চামড়া শিল্প নৌযান শিল্প, মৃৎশিল্প, বয়ন শিল্প ও কাঁচশিল্প ছিল উল্লেখযোগ্য। শিল্পের অর্থনৈতিক গুরুত্ব প্রসঙ্গে H.S. Lucas উল্লেখ করেছেন, ‘শিল্প স্থাপন মিশরীয়দের অর্থনৈতিক জীবনকে ব্যাপকভাবে উন্নত ও উৎসাহিত করেছিল।’

মিশরীয় সভ্যতার ধর্মীয় চিন্তা ও ধারণা

মিশরীয়দের জীবনের সকল ক্ষেত্রেই ধর্মের প্রতিফলন ঘটেছিল, যার ভিত্তিতেই প্রাচীন মিশরবাসীরাও এক বৃহত্তর পরিসরে ধর্মীয় কাঠামো গড়ে তুলেছিল। তাছাড়াও মিশরীদের শিল্প, সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞানসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রভাব লক্ষণীয় ছিল।

১. পৌত্তলিকতা

প্রাচীন মিশরীয়দের ধর্মীয় ধারণা বহুদেবতাবাদ থেকে একেশ্বরবাদ পর্যন্ত আবর্তিত হয়েছে। প্রাচীন মিশরীয়রা প্রথম দিকে বিভিন্ন জীবজন্তু ও মূর্তির পূজা করত। তারা জীবজন্তুর সাথে মানুষের আকৃতির সংমিশ্রণে বিভিন্ন দেবতার সৃষ্টি করত। এছাড়া তারা মিন, ওসিরিস, কোনস্, নামের মনুষ্যাকৃতি মূর্তির পূজা করত। এসময় তাদের প্রধান দেবতা ছিলেন সূর্যদেবতা ‘রে’ অথবা ‘রা’। কিন্তু পরবর্তীতে ‘থিবসে’ রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় সূর্যদেবতার নাম পরিবর্তিত হয়ে ‘আমন’ বা ‘আমন রে’ নামে পরিচিতি লাভ করে। প্রাকৃতিক শক্তির দেবতা ও নীলনদের দেবতার নাম ছিল ওসিরিস (Osiris)।

২. পরকালে বিশ্বাস

মিশরীয়দের ধর্মচিন্তায় পারলৌকিক চেতনাই প্রাধান্য লাভ করে। মিশরীয়দের ধারণা, প্রতিটি মানুষের মধ্যে ‘বা’ অর্থাৎ ‘আত্মা’ এবং একটি ‘কা’ অর্থাৎ ‘দ্বিতীয় সত্তা’ আছে। মৃত্যুর পরে আত্মা ‘বা’ পাখির বেশে উড়ে যায় এবং পরে তা পুনরায় ‘কা’ অর্থাৎ ‘দ্বিতীয় সত্তা’ রূপে দেহে এসে ভর করে। ফলে দেহ পুনরুজ্জীবিত হয়। এ চিন্তা থেকেই মিশরীয়রা দেহকে ধরে রাখার জন্য মমি তৈরি করেছিল।

৩. পুরোহিত রাজা

রাজা নিজেদেরকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে দেশ পরিচালনা করতেন। রাজা বা বাদশাগণই দেশ পরিচালনার পাশাপাশি পুরোহিত হিসেবেও দায়িত্ব পালন করতেন। প্রাচীন মিশরের প্রধান পুরোহিত ছিলেন ফারাও। ফারাও অন্যান্য পুরোহিতদেরকে ও নিয়োগ করতেন।

৪. পুনরুজ্জীবন ও বিচার

প্রাচীন মিশরীয়দের বিশ্বাস মতে, মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবিত ব্যক্তিকে তাঁর পাপ-পুণ্যের বিচারের জন্য দেবতা ওসিরিসের সামনে হাজির করা হতো।

৫. নৈতিকতার অবক্ষয়

ধর্মের প্রভাবের ফলাফলকে বশে এনে কর্ম সম্পাদনের চেষ্টার মাধ্যমেই ধর্মের নৈতিক দিকগুলোর অবক্ষয় হতে থাকে এবং ধীরে ধীরে কুসংস্কার ও জাদুবিদ্যার প্রাধান্য লাভ করতে থাকে। পুরোহিতগণ নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য সাধারণ জনগণকে ধোঁকা দিত। অর্থের বিনিময়ে পুরোহিতরা বিভিন্ন ভূঁয়া তাবিজ কবজ ঝাড়ফুঁক দিত।

মিশরীয় সভ্যতার পরিবারব্যবস্থা

মিশরীর সমাজব্যবস্থার মূলভিত্তি পরিবার। মিশরীয়দের মধ্যে একক বিবাহের প্রচলন ছিল বেশি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের প্রবণতা মিশরীয়দের মধ্যে লক্ষ করা যায়। ফারাওগণ একাধিক বিবাহ করতে পারত এমনকি উপপত্নীও রাখতে পারত। ফারাওদেরকে নিজস্ব গোত্রের বাইরে বিয়ে করা নিষিদ্ধ ছিল। রাজা নিজের বোন এমনকি নিজের মেয়েকেও বিয়ে করতে পারতেন।

মিশরীয়দের পরিবার ছিল মাতৃতান্ত্রিক। মেয়েদেরকে দেবতার প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচনা করা হতো। মেয়েরা সম্পত্তির মালিকানা ও অংশীদার হতে পারতো। জিনিসপত্র ক্রয়-বিক্রয় করতে পারতো এবং ইচ্ছানুযায়ী ভোগ করত। মেয়েরা উত্তরাধিকার সূত্রে সিংহাসনের দাবিদারও হতো।

প্রাচীন মিশরীয় সমাজে প্রেম-ভালোবাসা, যৌনাচার, উপপত্নী ও নতর্কী রাখার অনেক লিখিত প্রমাণ রয়েছে। উনবিংশ ও বিংশতম রাজবংশের শাসন আমলে প্রাপ্ত উপাদান থেকে জানা যায় যে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মধুর ও রোমাঞ্চকর সম্পর্ক থাকলেও তাদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটত। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রেই, নারী-পুরুষরা সমান মর্যাদা ভোগ করত। মধ্য রাজবংশ যুগে নারীরা সম্পত্তি লাভ, হস্তান্তর, চুক্তি ও মামলা করতে পারত। নারীদের প্রসঙ্গে Max Muller উল্লেখ করেছেন, ‘মিশর নারী জাতিকে যে উচ্চ আইনগত মর্যাদা দিয়েছে অন্য কোনো প্রাচীন বা আধুনিক জাতি তা দেয়নি।’

মিশরীয় সভ্যতার বিজ্ঞান

নবপলীয় গ্রাম সংস্কৃতির বিলোপ সাধনের মাধ্যমে যখন নগর সভ্যতার বিকাশ সাধিত হচ্ছে, তখন নানাবিধ সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা থেকেই মিশরীয় সভ্যতার বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার আবিষ্কার শুরু হয়েছিল। মিশরীয়দের বাস্তব প্রয়োজন থেকেই বিজ্ঞানের তিনটি শাখা জ্যোতির্বিদ্যা, গণিতশাস্ত্র এবং চিকিৎসাবিজ্ঞান চর্চা শুরু হয়েছিল। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মধ্যে প্যাপিরাস কাগজ, কাচ, ধাতুর তৈজসপত্র, সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রভৃতি ক্ষেত্রে মিশরীয়রা পারদর্শী ছিল। নিম্নের আলোচনায় মিশরীয়দের বিজ্ঞান চর্চার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো:

১. জ্যোতির্বিদ্যা

মিশরীয় সভ্যতার মূল ভিত্তি ছিল নীলনদ ও নীলনদের প্লাবন। নীলনদের এই প্লাবনের সাথে অতিমাত্রায় জ্যোতির্বিদ্যার ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে। এই সম্পর্কের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে গিয়ে গ্রহ নক্ষত্রের পর্যবেক্ষণ মুখ্য বিবেচ্য বিষয় হয়েছিল এবং এই ধারণাই জ্যোতির্বিদ্যার প্রাথমিক ভিত্তি। কৃষিক্ষেত্র রক্ষা ও ধর্মীয় পবিত্র দিন বের করার জন্য প্রাচীন মিশরীয়রা চান্দ্র পঞ্জিকা উদ্ভাবন করেছিল। প্রাক্ রাজবংশীয় যুগে মিশরীয়রা লুব্ধক নক্ষত্রের আবির্ভাবকাল পর্যবেক্ষণ করে ৩৬৫ দিনে সৌর পঞ্জিকা প্রবর্তন করে। এছাড়াও প্রাচীন মিশরীয়রা বিভিন্ন বিন্দুর নক্ষত্রের অবস্থান নির্ণয়, ধ্রুবতারার সাহায্যে দিক নির্ণয় এবং নক্ষত্র মানচিত্র রচনায় পারদর্শিতা অর্জন করেছিল। সময় গণনার জন্য মিশরীয়রা জলঘড়ি ছায়াঘড়ি ও সূর্যঘড়ি আবিষ্কার করেছিল। খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০ অব্দে নির্মিত একটি ছায়াঘড়ি কারনাকের মন্দিরে পাওয়া যায়।

২. গণিত শাস্ত্র

প্রাচীন মিশরীয়দের বাস্তব প্রয়োজনের তাগিদেই বিজ্ঞানের শাখা হিসেবে গণিতশাস্ত্রের উৎপত্তি ও বিকাশ সাধিত হয়েছিল এবং গণিতশাস্ত্রের মৌলিক অবদানও মিশরীয়দের। কৃষিজ পণ্য সামগ্রীর পরিমাপ, কৃষিকাজের খবরের পরিমাণ ও কারিগরদের জিনিসপত্র তৈরির সময় পরিমাপ প্রভৃতি প্রয়োজনেই গণিতশাস্ত্রের বিকাশ সাধিত হয়েছিল।

পণ্ডিতদের মতে মিশরীয়রাই সর্বপ্রথম গণিতশাস্ত্রের দুটি অপরিহার্য শাখা পাটিগণিত ও জ্যামিতির উদ্ভাবন করে। পাটিগণিতের ক্ষেত্রে যোগ, বিয়োগ ও ভাগ পদ্ধতি আয়ত্ত করেছিল। ভগ্নাংশ সম্পর্কে মিশরীয়দের জ্ঞান ছিল সীমিত। শূন্য ও গুণ সম্পর্কে মিশরীয়দের কোনো ধারাণা ছিল না।

পিরামিড নির্মাণ করতে, খালখনন করতে, জমি জমার হিসাব করতে, জ্যামিতিক জ্ঞান অপরিহার্য ছিল। এছাড়া চুনাপাথরের টুকরাগুলো কাটতে জ্যামিতিক ও Stereotomer বা নিরেট পাথর কাটার বিদ্যা জানা অত্যাবশ্যক ছিল। জ্যামিতিক জ্ঞান আয়ত্তের কারণেই ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ, বহুভুজ ও বৃত্তের ক্ষেত্রফল সিলিন্ডার, পিরামিড প্রভৃতির পরিমাপ মিশরীয়রা সহজেই নির্ণয় করতে পারত।

৩. চিকিৎসাবিদ্যা

চিকিৎসাবিদ্যার পুরোধা হিসেবে বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে মিশরীয়দের গৌরবময় ভূমিকা রয়েছে। মিশরীয়দের চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। ইতিহাসের ধারাবাহিকতার বিভিন্ন সময়ে প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত থেকে অতি সহজেই মিশরীয়দের চিকিৎসাবিদ্যার বিভিন্ন বিষয়, যেমন- দপ্ত, চক্ষু, পাকস্থলী প্রভৃতি ক্ষেত্রে খ্যাতি অর্জনের দৃষ্টান্ত চোখে পড়ে। এসময় থেকেই চক্ষুরোগ দাঁতের রোগ, পেটের পীড়া, শল্যবিদ্যা, হৃৎপিণ্ড ও নাভির তাৎপর্য রেচক ওষুধ আবিষ্কার এবং সর্বপ্রথম মেটেরিয়া মেডিকা প্রণয়ন করেছিলেন।

৪. রসায়নবিদ্যা

মিশরীয়রা ভেষজ গুণাগুণ জানত। খুব সম্ভবতই মিশরীয়রাই সর্বপ্রথম সুগন্ধি জলপাই তেল এবং ক্যাস্টর তেল আবিষ্কার করে। ভেষজ ও সুগন্ধি তেল দ্বারা মৃতদেহকে সতেজ রাখতে গিয়েই মিশরীয়রা বিজ্ঞানের অন্যতম শাখা হিসেবে রসায়নবিদ্যায়ও যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করেছে।

মিশরীয় সভ্যতার শিল্পকলা

মিশরীয়রা নান্দনিক ও চিত্রাকর্ষ জাতি হিসেবে বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে বিশেষ স্থান দখল করে আছে। মিশরীয় শিল্পকলার গুরুত্বপূর্ণ তিনটি শাখা হলো- স্থাপত্য শিল্প, ভাস্কর্য ও চিত্রকলা।

১. ভাস্কর্য

মিশরীয় স্থাপত্যের অনুষঙ্গী হিসেবে ভাস্কর্যের উৎকর্ষ সাধিত হয়। মিশরীয়দের ভাস্কর্যের মধ্যে পিরামিড ও মন্দিরের প্রবেশ পথ অলংকরণ ভেতরের দেয়ালের নকশা, গির্জাতে স্থাপিত স্ফিংসের মুখমণ্ডল ফারাও দ্বিতীয় রামসেসের মূর্তি ও পিরামিড উল্লেখযোগ্য।

মিশরীয় সভ্যতার ভাস্কর্য

মিশরীয় ভাস্কর্য সব সময় স্থাপত্যের মতোই বিশালাকৃতির হতো। বড় বড় পাথর কেটে চমৎকার সব মূর্তি তৈরি হতো। দেয়ালের গায়ে খোদিত ভাস্কর্যের উভয়ের মাধ্যমে একক মূর্তি তৈরি হতে থাকে। খোদাই এবং রঙের ব্যবহারে বসা অথবা দাঁড়ানো ভঙ্গিতে মূর্তিগুলো প্রায়শই জীবন্ত মনে হতো, প্রাচীন মিশরের এ ধরনের অসংখ্য ভাষ্কার্য মূর্তি তৈরি করা হয়েছিল। প্রাচীন রাজবংশের যুগে পিরামিডের সামান্য দূরেই সম্পূর্ণ একটা পাহাড় কেটে তৈরি করা হয়েছিল এরূপ ভাস্কর্য, যা স্ফিংস (Sphinx) নামে পরিচিত। বিশাল ফারাও মূর্তি বিশালাকার দেহ ছিল সিংহের এবং মাথা ছিল মানুষের। দান আকৃতির প্রস্তর মূর্তিকে মিশরীয়রা আতঙ্কের জনক বলে ডাকত।

২. স্থাপত্য শিল্প

বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে মিশরীয় সভ্যতার মূল পরিচয় বহন করেছিল স্থাপত্য শিল্প। ঐতিহাসিক Kolb উল্লেখ করেছেন যে, স্থাপত্য শিল্পে মিশরীয়দের অসাধারণ দক্ষতার জন্যই মিশরীয় স্থাপত্য শিল্প অনন্য ঐশ্বর্যের দাবিদার।

প্রাচীন মিশরীয়রা মৃত্যুর পরের জীবনের উপর অগাধ বিশ্বাসের জন্য মৃতদেহকে অবিকল অবস্থায় রক্ষা করার জন্য মৃতদেহকে মমি করার উপর বিশেষ গুরুত্বরোপ করেছেন। প্রায়-রাজবংশীয় যুগে বিশেষ এক ধরনের সমাধি তৈরি করা হতো, যাতে রোদে পোড়ানো কাদামাটির স্থট ব্যবহার করা হতো। এই সমাধিতে পাঁচটি ছোট ছোট ঘরে বিভক্ত চৌকো বা গর্ত ছিল। ঠিক মাঝখানের ঘরটিতে মমি। তারপাশের ঘরটি পূজার জন্য, তার পাশেরটি মৃতের পাথর মূর্তি এবং অন্যান্যগুলোতে ব্যবহার্য জিনিসপত্র ও প্রচুর্য ধনরত্ন রাখা হতো। এই বিশেষ ধরনের সমাধিটি ‘মাসতাবা’ নামে পরিচিত ছিল। আস্তে আস্তে এভাবেই মাসতাবা থেকেই পিরামিডের উদ্ভব হয়েছিল। ‘পিরামিড’ শব্দটি গ্রিকদের দেওয়া, যার অর্থ খুব উঁচু। ‘পিরামিড’ হলো পাথরের তৈরি আকাশচুম্বী বিশালাকার সমাধিসৌধ। ঐতিহাসিকগণের খননকার্যের ফলে প্রায় ৮০টি পিরামিডের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে, যার মধ্যে ৭০টি কালের স্বাক্ষী হিসেবে সাক্ষর বহন করছে। এছাড়া ধনী ধর্মীয় পুরোহিতরা ধর্মমিন্দর তৈরি করেছিল।

৩. চিত্রকলা

সমাধি সৌধ, পিরামিড ও মন্দিরসমূহের দেয়াল অলংকৃত করতে গিয়েই মিশরীয়রা প্রথম চিত্রকলার বিকাশ ঘটিয়েছে। মিশরীয় চিত্রকলাকে দুটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। প্রথম পর্যায় ছিল সম্পূর্ণ ধর্মকেন্দ্রিক আর দ্বিতীয় পর্যায় ছিল বাস্তবতা ও আধ্যাত্মিকতার মিশ্রিত রূপ।

মিশরীয় বিভিন্ন মন্দিব, সমাধিসৌধ ও পিরামিডের দেয়ালে প্রাপ্ত ছবিগুলোর চারপাশে মিশরীয় চিত্রলিপি রয়েছে, যা ছবিটির সৌন্দর্যবোধ প্রকাশের সাথে সাথে একটি স্বার্থক ভিন্ন অর্থবোধ প্রেক্ষাপটের উপস্থিতিকে নির্দেশ করেছে।

প্রাচীন মিশরীয়রা কারুশিল্পেও নান্দনিক ছিল। স্বর্ণ শিল্পীরা স্বর্ণ দিয়ে মহামূল্যবান অলংকার, আংটি, নেকলেস, বাজুবন্দ, মুকুট, সীতাপাটি, ছাড়াও মূর্তিসহ অন্যান্য চমৎকার নিপুণ-চিত্রশিল্প তৈরি করেছিল। মৃৎশিল্পীরা দৈনন্দিন ব্যবহারের উপযোগী মৃৎপাত্র তৈরি করে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিল। সুন্দর নকশার আসবাবপত্র তৈরি হতো। বয়ন শিল্পী সুন্দর নকশার আসবাবপত্র তৈরি হতো। বয়ন শিল্পীগণ চিত্রিত কম্বল, পর্দা এবং কুশন তৈরিতে সক্ষম ছিলেন।

মিশরীয় সভ্যতার লিখন পদ্ধতি

মানব সভ্যতার ইতিহাসে মিশরীয় সভ্যতার লিখন পদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। নবপলীয় গ্রাম সংস্কৃতির বিলোপ সাধনের সাথে সাথে প্রাচীন মিশরের প্রাক-রাজবংশীয় যুগে মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য সর্বপ্রথম লিপির উদ্ভব হয় এবং ধীরে ধীরে তার বিকাশের মাধ্যমে পরিপূর্ণতা লাভ ঘটে। প্রথমে ছবির সাহায্যে পরবর্তীতে ছবি ও চিত্রের সাহায্যে মনের সম্পূর্ণ ভাব প্রকাশ করার যে রীতি মিশরীয়রা উদ্ভবন করেন। তাই বিশ্ব ইতিহাসে মিশরীয় লিখন পদ্ধতি নামে পরিচিতি। এ প্রসঙ্গে ডেভিস উল্লেখ করেছেন যে, “মিশরীয়রাই প্রথম লিখন পদ্ধতির আবিষ্কার করেন।” ছবি বা চিত্রসমূহ দ্বারা প্রকাশিত পদ্ধতি ‘হায়ারোগ্লিফিক’ নামে পরিচিত। হায়ারোগ্লিফিকোন শব্দের অর্থ হলো খোদাই করা বা পবিত্র খোদাই কাজ। প্রায় ৭৫০টি চিত্রলিপি চিহ্ন দিয়ে প্রাচীন মিশরীয় লিপি পদ্ধতি তৈরি হয়েছিল। সফলতার জন্য হায়ারোগ্লিফিক লিখন পদ্ধতি তিনটি রূপ লাভ করেছে। যথা: চিত্রভিত্তিক (Pictographic), অক্ষরভিত্তিক (Syllabic) এবং বর্ণভিত্তিক (Alphabetic) |

আরও পড়ুন:   প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা বর্ণনা কর।

মিশরীয় সভ্যতার সাহিত্য মিশরীয় সভ্যতায় সাহিত্য চর্চার উল্লেখযোগ্য নিদর্শন হলো মন্দির, পিরামিড ও সমাধিসৌধের গাত্রের খোদাইকৃত লিপিমালা। মিশরীয়দের সাহিত্য চর্চার মূলভিত্তি ছিল দর্শন, ধর্ম ও বাস্তবতা। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান, কিংবাদপ্তি পৌরাণিক কাহিনি, রূপকথা, জাদুবিদ্যা, ধর্মসঙ্গিত শোক ছিল সাহিত্যের মূল বিষয়বস্তু। ধর্মভিত্তিক সাহিত্য চর্চার নিদর্শন রয়েছে Book of the Dead বা মৃতদের পুস্তকে। এই গ্রন্থটিতে শোক, প্রার্থনা, স্তুতি ও জাদুবিদ্যার বর্ণনা লিপিবদ্ধ ছিল। জনপ্রিয় সাহিত্য হিসেবে সর্বাধিক খ্যাতি অর্জন করেছিল “The tale of sinune (সিনুহার রূপকথা)। এছাড়া মিশরীয় সাহিত্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল মেমফাইট ড্রামা, রয়াল হীম অব ইখনাটন। প্রাচীন রাজবংশীয় যুগে ধর্মকে রাষ্ট্রীয় স্বার্থে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে প্রধানত সাহিত্য রচিত হতো।

দ্বাদশ রাজবংশের সময় মিশরীয় সাহিত্যের ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। এসময় ধর্মকেন্দ্রিকতার পরিবর্তে ধর্ম নিরপেক্ষতার স্থান হয়। এসময় লোককাহিনি রূপকথা ও প্রবচন লিখিতভাবে সংরক্ষণ করা হয়। সাহিত্য ব্যাপক উৎকর্ষ ও বৈচিত্র্যের জন্য দ্বাদশ রাজবংশকে মিশরীয় সাহিত্যের ইতিহাসে ধ্রুপদি যুগ হিসেবে মূল্যায়ন করা হতো। এই সময় বিভিন্ন রূপকথা, উপখ্যান, গ্রামীণ ছড়া, বীরত্বগাঁথা কাহিনি, প্রেমের অমর কাহিনি প্রভৃতির উপর সাহিত্য চর্চা শুরু হয়। সাধারণত মিশরীয় সাহিত্য ছিল পদ্য ও গদ্য নির্ভর। তবে গদ্য নির্ভরতার চেয়ে পদ্য নির্ভর সাহিত্যের সংখ্যাই বেশি ছিল।

মিশরীয় সভ্যতার রাজনৈতিক অবস্থা

প্রাচীন মিশরের রাজাদেরকে বলা হতো ফারাও। রাজারা নিজেদেরকে দেবতার অংশ হিসেবে মনে করত এবং নিরঙ্কুশ ক্ষমতার ব্যবহার করত। মন্দির ও পুরোহিত সম্প্রদায়ের যথেষ্ট ধন-সম্পদ ছিল। ফলে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেত।

সার্বিক আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা ছিল স্ব-মহিমায় উদ্ভাষিত অন্যতম প্রাচীন সভ্যতা। জ্ঞান-বিজ্ঞান, ব্যবসা-বাণিজ্য, স্থাপত্য কলা, কৃষি ও শিল্পে মিশরীয়দের অবদান বিশ্ব ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে রয়েছে।

Related Posts