রেনেসাঁর বৈশিষ্ট্য
রেনেসাঁ ইউরোপীয় সমাজে এক সোনালি যুগের সূচনা করেছিল। সমাজ ও সভ্যতার ইতিহাসে রেনেসাঁ এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। রেনেসাঁকে বাস্তবে অনুধাবন করতে হলে এর বৈশিষ্ট্যগুলো জানা প্রয়োজন। রেনেসাঁর ফলে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই নতুন প্রভাব ও বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। নিম্নে প্রধান প্রধান রেনেসাঁর বৈশিষ্ট্য সমূহ তুলে ধরা হলো-
১. বুর্জোয়া প্রভাবপুষ্ট
নবজাগরণকে বুর্জোয়া শ্রেণির প্রভাবের ফসল হিসেবে অনেকে দেখতে চান এবং এই দেখার মধ্যে কোনো অযৌক্তিকতার নিহিত নেই। কারণ বুর্জোয়া শ্রেণি সম্পদ আহরণ, সম্পদ সৃষ্টি শিল্পবিকাশ ব্যবসা- বাণিজ্যের সম্প্রসারণের বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং এই লক্ষ্য সাধনের নিমিত্ত শিক্ষার বিস্তার যতটুকু প্রয়োজন ছিল বুর্জোয়ারা সেটুকু করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হয়নি। শিক্ষাবিস্তারে বুর্জোয়া শ্রেণির এই নবোদ্যোগ মানুষের চেতনারাজ্যকে প্লাবিত করে তুলল। সুতরাং নবজাগরণ ও বুর্জোয়া শ্রেণির উত্থানকে স্বতন্ত্র করে দেখা ঠিক নয়। নতুন বা আধুনিক যুগে আবির্ভাবে বুর্জোয়াদের প্রাধান্য যদি স্থাপিত না হতো তাহলে নবজাগরণ এমনভাবে সমাজকে নানাভাবে ঐশ্বর্যশালী করে তুলত না। আইন, রাজনীতি শাস্ত্র ইত্যাদির নানা বিষয়ে বুর্জোয়া নতুন ভাবনার আমদানি করে এবং তাদের অনুকূলেই উদারনীতিবাদের জন্ম ঘটে। আধুনিক যুগের রাষ্ট্রচিন্তার বিশ্লেষণ প্রসঙ্গ এ বিষয়টির ওপর আলোকপাত করেছি। গবেষণার ক্ষেত্রেও বুর্জোয়া শ্রেণি অবদান রেখে গেছে। বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গবেষণা ক্ষেত্রে বুর্জোয়াদের আর্থিক আনুকূল্যে সমৃদ্ধশালী হয়ে অনুসন্ধানের কাজ চালিয়ে গেছে। সুতরাং এই শ্রেণির সাহায্যকে নগণ্য করে দেখা অনুচিত।
আরও পড়ুন: রেনেসাঁ কি? রেনেসাঁর কারণ গুলো কি কি?
২. নবজাগরণ ব্যাপকতা দ্বারা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ
মানুষ যে একটি সমগ্র সত্তার বিমূর্ত প্রতীক নবজাগরণ এটি জাগিয়ে তুলেছিল। তাই মধ্যযুগে সে যেমন কেবল ধর্ম নিয়ে মাতামাতি করেছিল আধুনিক যুগে তা করেনি। জ্ঞানবিজ্ঞানের সমস্ত শাখায় দর্শন সাহিত্য শিল্প সর্বত্র সে অবাধ বিচরণের অধিকারী হয়ে উঠল।
ব্যক্তিসত্তাকে বিকশিত করে তোলার জন্য নানা প্রকার প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কাজে মন দেয়। এটিকে নবজাগরণের ফল হিসেবে গণ্য করা চলে। মানুষ প্রকৃতিগতভাবে সামাজিক জীব, সমাজবদ্ধ হয়ে সে বসবাস করতে চায়। তাই সে গড়ে তোলার প্রবণতা ও প্রচেষ্টাকে উন্নত করে ফেলল। নবজাগরণের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এর প্রভাবে এসে মানুষ অজনাকে জানার ও অচেনাকে চেনার কজে ব্রতী হল। ১৪৯২ সালে কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার ও ১৪৯৮ সালে ভাস্কো দা গামার ভারতের মাটিতে পদার্পণকে নবজাগরণের প্রত্যক্ষ ফসল বলে মনে করা হয়। কেবল এই দু’জন নন আরও অনেকে অজানার উদ্দেশ্য পাড়ি দিয়েছিলেন। সাগর, মহাসাগর, পাহাড় পর্বত, মরুভূমি জঙ্গল কোনোটাই মানুষের নিকট আর দুর্গম হয়ে থাকেনি। এই প্রবণতাকে নিঃসন্দেহে নবজাগরণের প্রত্যক্ষ ফল বলতে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়।
৩. মানুষের মনে আত্মবিশ্বাস জেগেছিল
নবজাগরণ বহুল পরিমাণে মানুষকে আত্মপ্রত্যয়ী করে তুলেছিল। মধ্যযুগে একদিকে গির্জা অন্যদিকে সামন্ত প্রভুরা মনুষকে যুক্তি ও বুদ্ধি অনুযায়ী চলতে দেয়নি। তাদের চেতনাবোধকে দমন করে রাখার সর্ববিধ প্রয়াস চলত কিন্তু নবজাগরণের ফলে মানুষ ভাবতে শিখল যে প্রকৃতি বা ভগবান তাদেরকে যুক্তি ও চেতনাবোধ দিয়ে তৈরি করেছে এবং তারা সে অনুযায়ী চলবে। এই ভাবনা বৃদ্ধি পাবার ফলে তাদের মনে আত্মবিশ্বাস জেগেছিল।
৪. নানা জায়গায় নবজাগরণের বিকাশ হয়েছিল
এমন কথা বললে অযৌক্তিক হবে না যে কোনো একটি কারণে নবজাগরণের উন্মেষ হয়নি, একাধিক কারণ কাজ করেছিল। আবার ইউরোপের কোনো একটি দেশে নবজাগরণ আসেনি। একই সঙ্গে একাধিক দেশে নবজাগরণ দেখা দিয়েছিল। তবে নবজাগরণের উন্মেষ ও বিকাশের স্বরূপ বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখব যে ইতালিতে নবজাগরণ সবার আগে এবং অধিকতার সক্রিয়ভাবে এসেছিল। নবজাগরণ এসে মানুষের মনকে ধর্মান্ধতা থেকে মুক্ত করেছিল এবং তার থেকেই জন্ম নিয়েছিল ধর্মমুক্ত রাজনীতি। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা চলে যে নবজাগরণ এসে অতীতকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করেনি এভাবে ইউরোপের নানাস্থানে নবজাগরণ বিপ্লব এনে সমাজের পরিবর্তন সাধন করেছিল।
৫. ব্যক্তি স্বাধীনতার জয়
মধ্যযুগে ব্যক্তি স্বাধীনতা বা ব্যক্তিত্ব বিকাশের পথ উন্মুক্ত ছিল না। রেনেসাঁর ফলে ব্যক্তি স্বাধীনতা বা ব্যক্তিত্ব বিকাশের পথ উন্মুক্ত হয়।
৬. ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তা ও চেতনা
ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তা ও চেতনা রেনেসাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মধ্যযুগে গির্জার মূল শিক্ষা ছিল যে, এ বিশ্ব শুধু পাপ মোচনের জন্য। কিন্তু রেনেসাঁর মধ্যে তারা গ্রিক ও ল্যাটিন সাহিত্য হতে জানতে পারে যে, পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ উপভোগ করার জন্য ধর্ম মানব জীবনের বাধাস্বরূপ নয়।
৭. বিজ্ঞানের উন্নতি
রেনেসাঁর আর একটি বৈশিষ্ট্য হলো বিজ্ঞানের উন্নতি। রেনেসাঁর প্রভাবে টলেমির স্থির বিশ্বের তত্ত্ব পরিত্যক্ত হয়। পক্ষান্তরে, কোপারনিকাস, ব্রাহে, গ্যালিলিও এবং কেপলার হলেন পথিকৃৎ বিজ্ঞানী যারা নান ভ্রান্তি দূর করে বৈজ্ঞানিক সত্য প্রতিষ্ঠা করেন।
৮. মানবতাবাদ
রেনেসাঁর আর একটি বৈশিষ্ট্য হলো মানবতাবাদ। মধ্যযুগের শেষের দিকে সমাজে সচেতন বুদ্ধিজীবীরা মানুষকে নতুনভাবে দেখতে, বুঝতে ও অনুভব করতে থাকেন।
৯. যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানমনস্কতা
মধ্যযুগে মানুষ পোপ ও সম্রাটের আদেশ-নির্দেশ বিনাবাক্যে মেনে নিত। তাঁদের এই সব আদেশ-নির্দেশের সত্যাসত্য যাচাই বা ভালো-মন্দ খতিয়ে দেখার ন্যূনতম প্রয়োজনীয়তাও মানুষ উপলব্ধি করত না। কিন্তু গ্রিক-ল্যাটিন ভাষা, সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা মানুষের মনে যুক্তি ও প্রশ্নের উদ্ভব ঘটায়।
১০. জাতীয় ভাষা ও সাহিত্যের অগ্রগতি
এটি রেনেসাঁর আর একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মধ্যযুগে ল্যাটিন ছিল রাষ্ট্রীয় ভাষা। ভাষাটি ছিল জনবিচ্ছিন্ন। কিন্তু পেট্রার্ক, দাঁন্তে, বোকাসিও, মিচেল, সাইমন্ডস, বাকারহার্ট প্রমুখ কবি- সাহিত্যিকরা দেশীয় ভাষায় ল্যাটিন সাহিত্যের অনুবাদ এবং দেশীয় ভাষায় সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে জাতীয় ভাষা ও সাহিত্যের মর্যাদা বৃদ্ধি করেন।
১১. ধর্মনিরপেক্ষ ও জীবনধর্মী সাহিত্য
রেনেসাঁর আর একটি বৈশিষ্ট্য হলো তার সাহিত্য ছিল ধর্মনিরপেক্ষ ও জীবনধর্মী। সাহিত্যের এ ধারা সৃষ্টিতে মূল ভূমিকা রেখেছিলেন মানবতাবাদী লেখকগণ। যেমন, সনেটের জনক পেট্রার্ক তাঁর প্রেয়সী লরার প্রতি তিনশতাধিক সনেটের সংকলন করেছিলেন।
১২. শিল্প ও চিত্রকলা
রেনেসাঁর অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত হয়েছিল শিল্প ও চিত্রকলার মধ্য দিয়ে। এ সময়ের শিল্প ও চিত্রকলা মধ্যযুগীয় ধর্মীয় ও কাল্পনিক বিষয় থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীনতা, প্রেম, সৌন্দর্য, প্রকৃতি ইত্যাদি বিষয়কে মূল উপজীব্য হিসেবে গ্রহণ করে। রেনেসাঁ যুগের প্রখ্যাত চিত্রশিল্পীরা হলেন রাফায়েল, মাইকেল অ্যাঞ্জেলো ও লিওনার্দো দ্য ভিচি।
১৩. ভৌগোলিক আবিষ্কার
রেনেসাঁর অন্যতম প্রধান আর একটি বৈশিষ্ট্য হলো ভৌগোলিক আবিস্কারের প্রেরণা। এ প্রেরণার বশবর্তী হয়ে কলম্বাস ১৪৯২ সালে আবিষ্কৃার করেন নতুন মহাদেশ আমেরিকা, আর ভাস্কো-দা-গামা ভারতবর্ষে পৌঁছে যান নতুন আবিষ্কৃত জলপথ দিয়ে।
১৪. গ্রিক ল্যাটিন সভ্যতার পুনর্জন্ম
রেনেসাঁর আর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো গ্রিক ও ল্যাটিন সভ্যতার পুনর্জন্ম। প্রাচীন গ্রিক ও ল্যাটিন সভ্যতাকে জানার মাধ্যমে মানুষের মন থেকে ভ্রান্ত ধারণা মুছে যায়।
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, রেনেসাঁ শিল্প, সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস, রাজনীতি সকল ক্ষেত্রে এক নব উদ্যম ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। সাহিত্য ও শিল্পকার চর্চা মানুষকে নতুন জীবনবোধ দান করে। মানুষ তার নিজের কর্মশক্তিতে বিশ্বাসী হয়। বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কারের বিশ্বাসের জগতে বিপ্লব সাধিত হয়। ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে কর্মভিত্তিক ইতিহাস চর্চার পরিবর্তে জাগতিক বিষয় প্রাধান্য পায়। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক ও জাতীয় রাষ্ট্রের উত্থান ঘটে। এভাবে নানা বৈশিষ্ট্য মধ্যযুগের অবসান ঘটিয়ে রেনেসাঁ যুগ এবং পরবর্তীতে আধুনিক যুগের আগমনকে ত্বরান্বিত করে।
1 comment
[…] আরও পড়ুন: রেনেসাঁর বৈশিষ্ট্য গুলো কি কি? […]
Comments are closed.