সামন্তবাদের বৈশিষ্ট্য
সামন্তবাদের মূল লক্ষ্য হলো সমাজের শক্তিশালী মানুষ দুর্বল মানুষকে সাহায্য করবে। অর্থাৎ সামন্তবাদের মূল বৈশিষ্ট্যের ভিত্তি হলো সেবা ও রক্ষার চুক্তি। এটা এমন একটি আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে ভূমিকেন্দ্রিক সেবা ও রক্ষার চুক্তিতে সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। নিম্নের আলোচনায় প্রধান প্রধান সামন্তবাদের বৈশিষ্ট্য গুলো আলোকপাত করা হলো-
১. ভূমি লেনদেন
সামন্ততন্ত্রে অভিনব পন্থায় ভূমি লেনদেন হতো। সামন্তবাদের ভূমির মূল মালিক ছিল রাষ্ট্র বা রাজা। রাজ্য কিছু শর্তের বিনিময়ে তার অধীনস্থ সামন্ত প্রভু বা লর্ডের মধ্যে ভূমি বিতরণ করতেন। সামন্ত চুক্তি অনুসারে সামন্ত প্রভু বা ভেসালরা রাজার নিকট থেকে বশ্যতা ও আনুগত্যের ভিত্তিতে জমি ভোগ দখলের অধিকার লাভ করত। সামন্ত প্রভুদের নিকট থেকে কৃষকরা জমি ইজারা নিত।
আরও দেখুন: সামন্তবাদ কি | সামন্তবাদ কাকে বলে | সামন্তবাদের সংজ্ঞা
২. ভূমির উপর সার্বভৌম ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত
ভেসালগণ লর্ডের নিকট থেকে যে ভূমি ঋণ হিসেবে গ্রহণ করত সে জমির উপর তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য ও সার্বভৌম প্রতিষ্ঠিত ছিল। তারা ইচ্ছামতো ভূমি ব্যবহার করার যাবতীয় অধিকার ভোগ করত।
৩. বংশপরম্পরায় জমিদারি স্বতভোগ
ভেসাল বা সামন্ত প্রভুরা লর্ড-এর বশ্যতা স্বীকার করতো। তারা লর্ডকে আর্থিক ও সামরিক সাহায্য প্রদানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল এবং এর বিনিময়ে বংশপরম্পরায় জমিদারি স্বত্ব ভোগের অধিকার লাভ করতো।
৪. ভূমির মালিকানা
তাত্ত্বিকভাবে সামন্তপ্রথা অনুযায়ী সকল ভূমির মালিক ছিল রাষ্ট্র বা রাজা। রাজার কাছ থেকে জমি পেতেন ডিউক কাউন্ট, আর্থ, মারগ্রেড প্রভৃতিরা। এদেরকে বলা হতো টেনান্টস-ইন-চিতে এবং সর্বনিম্ন পর্যায়ে জমি পেতেন নাইট।
৫. ভেসালের স্বাধীনতা
নিজস্ব জমিদারিতে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা, শাসনকার্য ও বিচারকার্য পরিচালনার পূর্ব স্বাধীনতা ভেসালের ছিল। নিজস্ব ভূখণ্ডে সৈন্য মোতায়েন, প্রজাদের উপর কর ধার্য, জরিমানা আদায় ইত্যাদি তারা স্বাধীনভাবে করতে পারতো। লর্ডরা তাদের এ কাজে হস্তক্ষেপ করতো না।
৬. লর্ডের ভূমিকা
সামন্ততন্ত্রে লর্ডকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হতো। লর্ডের প্রধান কর্তব্য ছিল বহিঃশত্রু বা অন্যান্য লর্ডের আক্রমণ থেকে তার ভেসালদেরকে রক্ষা করা। কোনো ভেসালের মৃত্যু হলে তার স্ত্রী ও নাবালক সন্তানের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করাও লর্ডের দায়িত্ব ছিল।
৭. ভেসালের দায়িত্ব
সামন্ত প্রথায় লর্ডকে যুদ্ধাস্ত্র ও সৈন্য সরবরাহ করা, তার অনুসরণ করা, লর্ড বন্দি হলে তাকে মুক্ত করা, লর্ডের বিরুদ্ধে গোপন ষড়যন্ত্র ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের গোপন পরিকল্পনা উদঘাটন করা এ সব কিছুই ছিল ভেসালের প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য।
৮. শ্রেণিবিভক্ত সমাজ
সামন্তবাদের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে শ্রেণিবিভক্ত সমাজ। সমাজ সাধারণত নিম্নোক্ত তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। যথা:-
(ক) যাজক শ্রেণি: সামন্ত সমাজে রাজার পরেই স্থান ছিল যাজক শ্রেণির। ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরিচালনা এবং গির্জার অধীনস্থ সম্পত্তিগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল যাজকদের উপর। এরা খুবই প্রভাবশালী হিসেবে সমাজে ভূমিকা পালন করতেন।
(খ) অভিজাত শ্রেণি: সামন্ত প্রভুগণই ছিল এ শ্রেণিভুক্ত। আর এটা ছিল বংশগত শ্রেণি। রাজা থেকে শুরু করে নাইট পর্যন্ত বিস্তৃত সকল সামন্ত প্রভুই ছিল একটি বিশেষ শ্রেণিভুক্ত। এরা একদিকে শাসন করতো অন্যদিকে চরম শোষণ ও করত। এরাই ছিল সমাজে সবচেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধাভোগী।
(গ) তৃতীয় শ্রেণি: সমাজের কৃষক, শ্রমিক, বণিক এবং দাসগণই সমাজের তৃতীয় শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। ভূমিহীন কৃষকদেরকে বলা হতো সার্ক বা ভূমিদাস। জমি হস্তান্তরের সাথে সাথে নতুন মালিকের নিকট সার্ফ বা ভূমিদাসরা ও হস্তান্তরিত হতো। এরা প্রভুর অনুমতি ছাড়া তার স্থান ত্যাগ করতে পারতো না।
৯. ম্যানর ব্যবস্থা
সামন্তবাদের এক অনন্য ও উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো ম্যানর ব্যবস্থা। জমিদারের খাস জমির সমন্বয়ে যে স্বনির্ভর আর্থ-সামাজিক কাঠামো সামন্ত কৃষি ব্যবস্থায় বিকাশ লাভ করে তাই হলো ম্যানর। সামন্ত উৎপাদনের একক ছিল ম্যানর। ম্যানরের তত্ত্বাবধানে সামন্ত প্রভুর কর্ম পরিচালিত হতো।
আরও দেখুন: রোমান সভ্যতার বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর
১০. কার্তি ব্যবস্থা
সমান্ত সমাজে কৃষকরা সর্বদাই সামন্ত প্রভুর জন্য বাধ্যতামূলকভাবে কাজ করত। ফসল উৎপাদনের জন্য যেমন কৃষকদের খাটতে হতো তেমনি সামন্ত প্রভুর জন্য বাড়তি শ্রমও দিতে হতো। সপ্তাহে দুই তিন দিন অতিরিক্ত শ্রম দিতে কৃষক বাধ্য থাকত। এ অতিরিক্ত বা বেগার শ্রমকে কার্ড বলা হয়।
১১. চার্চের প্রভাব
সামন্তবাদে চার্চ ছিল ক্ষমতার উৎস। চার্চ একাধারে ধর্মগুরু, ভূমি মালিক ও রাজনৈতিক নেতা হিসেবে সমাজে কর্তৃত্ব করতো।
অতএব, উপরোক্ত আলোচনা থেকে আপনারা সামন্তবাদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করলেন। লেখাটি থেকে উপকৃত হলে অন্যদের সাথেও শেয়ার করার অনুরোধ রইলো।