সামন্তবাদ কি বা কাকে বলে?
সামন্ততন্ত্র বা সামন্তবাদ মধ্যযুগের ইউরোপের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান বা প্রথা। মধ্যযুগে ইউরোপের তিনটি জন্ড (জার্মান জাতি গোষ্ঠীর রাজ্য শাসন পদ্ধতি, খ্রিস্টধর্ম ও সামন্ততন্ত্র) এর উপর ভিত্তি করে তাদের সমাজ ও সভ্যতার সৌধ নির্মিত হয়েছিল বলে স্বীকৃত। সেই তিনটি স্তম্ভের মধ্যে নিঃসন্দেহে সমান্ততন্ত্র বিশেষভাবে আলোচিত। কারণ ইউরোপের ইতিহাসে এতো বেশি আলোচিত যে মধ্যযুগকে অনেক সময় সামন্ততন্ত্রের যুগ বলে চিহ্নিত করা হয়।
সামন্তবাদ ছিল মূলত এক প্রকার ভূমি ব্যবস্থাপনা। এই ব্যবস্থাপনা সমগ্র মধ্যযুগ ব্যাপী অর্থাৎ নবম শতক হতে পনের শতক পর্যন্ত ইউরোপবাসীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবন এবং তাদের আচার-আচরণ ও ভাবধারার উপর বিশেষভাবে প্রভাববিস্তার করেছিল।
সামন্ততন্ত্র বিকশিত হয়েছিল তখন, যখন সম্পদ ও ক্ষমতার একমাত্র উৎস ছিল জমি। সামন্তপ্রথার উৎপাদনের কাজে সমান্তপ্রভুদের কোনো ভূমিকা থাকত না। উৎপাদনের কাজে নিয়োজিত থাকত কৃষক ও ভূমিদাসগণ অথচ উৎপাদিত ফসলের এক বিরাট অংশ পেত সামন্ত প্রভুরা। সামন্ততন্ত্র মূলক ভূমি কেন্দ্রিক এক প্রকার সরকার ব্যবস্থা, যেখানে রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় প্রশাসনের পরিবর্তে স্থানীয় ভূ-স্বামীদের মধ্যে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা বিকেন্দ্রীভূত হয়েছিল। তবে যথাযথভাবে সামন্তবাদের সংজ্ঞা দেওযা খুবই দুরূহ ব্যাপার, কেননা একক কোনো সংজ্ঞায় একে সংজ্ঞায়িত করা অনেক কঠিন। তাছাড়া ঐতিহাসিকদের মধ্যে এ নিয়ে মতভেদ আছে।
আরও দেখুন: রোমান সভ্যতার বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর
সাধারণভাবে বলা যায় যে, সামন্তবাদ হলো এমন এক ধরনের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ব্যবস্থা যেখানে শর্তসাপেক্ষে ভূমিকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হতো।
বিশেষভাবে বলা যায় যে, সামন্তবাদ বলতে এমন এক বিশেষ ব্যবস্থাকে বুঝায় যেখানে কতকগুলো প্রথা, বিধি ও ব্যবস্থার মাধ্যমে দুর্বল কর্তৃক সবলের সাহায্য গ্রহণ ও সবল কর্তৃক দুর্বলকে রক্ষা করা হয়।
সামন্তবাদের সংজ্ঞা
P.V. Myers তাঁর ‘A Short History of Ancient Medieval and Modera Times’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন,
“Feudalism is a special form of society and government based upon a peculian tenure of land, whic prevailed in Europe during the later pant of Middle ages, attaining, however, its most perfect development in the eleventh twelfth and thirteenth centuries.” অর্থাৎ, সামন্তবাদ হলো একটি বিশেষ সমাজ ও সরকার ব্যবস্থা, বিশেষ ধরনের ভূমিব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে যা মধ্যযুগের শেষ পর্বে ইউরোপকে বিকশিত করেছিল এবং যার সন্ধান উৎকর্ষতা লাভ হয়েছিল একাদশ, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীগুলোতে।
B. Bhushan তার ‘The Dictionary of Sociology’ গ্রন্থে বলেন যে, ‘Feudalism was based upon a system of land tenure in which land estates of various size (fiefs) were given to hold (not to own) by an overlord, to his vassal (kinght) in return for military service’ অর্থাৎ, সামন্ততন্ত্র হচ্ছে একটি বিশেষ ধরনের সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও সামরিক ব্যবস্থা যা বিশেষভাবে অনুশীলিত এক ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে।
ওয়ালব্যাক ও টেইলর তাঁদের ‘Civilization: Past and Present’ গ্রন্থে সামন্ততন্ত্রের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন যে, “Feudalism can be defined as a type of government in which political power exercised locally by private individuals rather than by the agents of centralized state” অর্থাৎ সামন্ততন্ত্র হচ্ছে স্থানীয় পর্যায়ের সরকার ব্যবস্থা যেখানে ব্যক্তিসত্তার উপর কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রের বিধি-বিধানগুলোকে পরিচালনা করা হয়।
আরও দেখুন: রোমান সভ্যতার পতনের কারণ কি ছিল?
অধ্যাপক এ. কে. নাজমুল করিম উল্লেখ করেছেন, ‘সামন্তবাদ এমন একটা সমাজ ও সংস্কৃতিকে বুঝায় যেখানে ভূমিই হচ্ছে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ক্ষমতার ভিত্তি।’
B.K. Gokhake -এর মতে, “It (Feudalism) was a condition of society based on the principle of protection, secured it form a noble man, who had his own army and retainers. The Needleman is return secured services and payments from those whom he protected.” অর্থাৎ, ভূমি মালিকানার ভিত্তিতে সামাজিক ও উৎপাদন সম্পর্ক (Lord-Vassal relationship) গড়ে উঠত। ক্ষমতার বণ্টনও সম্পর্ক বা ভূমি অধিকারের মাধ্যমে নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হতো।
উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সামন্তবাদ একটি বিশেষ ধরনের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা। সামন্ততন্ত্র ছিল মূলত এক প্রকার ভূমি ব্যবস্থা, যা সমগ্র মধ্যযুগব্যাপী ইউরোপবাসীর রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন এবং আচার- আচরণের উপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিল।