প্রিয় পাঠক, আজকে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় সম্পর্কে জানতে চলেছি। সেটা হলো সিন্ধু সভ্যতার অবদান তথা সিন্ধু সভ্যতার সমাজতাত্ত্বি গুরুত্ব। এর আগে আমরা সিন্ধু সভ্যতার বৈশিষ্ট্য ও সিন্ধু সভ্যতার নগর পরিকল্পনা সম্পর্কে জেনেছি। চলুন তবে শুরু করা যাক।
সিন্ধু সভ্যতার অবদান
ইতিহাসের ধারাবাহিকতা থেকে যতদূর জানা যায় তা থেকে বলা যায় যে, নদী তীরবর্তী সভ্যতা হওয়ার সুবাদে সিন্ধু সভ্যতা অত্যন্ত শক্তিশালী কৃষিভিত্তিক আর্থিক বুনিয়াদের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। সিন্ধু সভ্যতায় নাগরিকদের সমাজ জীবন যতটা না ছিল আড়ম্বরপূর্ণ তার চেয়ে বরং বেশি ছিল সুসংগঠিত। সিন্ধু সভ্যতার সুনিয়ন্ত্রিত সমাজব্যবস্থা একটি সংগঠিত প্রশাসনিক ও শক্তিশালী রাজনৈতিক অবস্থার ভিত্তি রচনা করেছিল। এছাড়াও সিন্ধু সভ্যতার সুবৃহৎ প্রাসাদ, অট্টালিকা, দূর্গ, শস্য মজুদ রাখার জন্য শস্যাগার ইত্যাদি নিদর্শন থেকে সিন্ধু সভ্যতার জীবনধারা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। সিন্ধু সভ্যতা ভারতীয় উপমহাদেশের সামাজিক কাঠামো রূপায়নে সুদূরপ্রসারী অবদান রেখেছে। নিম্নে সিন্ধু সভ্যতার অবদান তথা সমাজতাত্ত্বিক গুরুত্ব আলোচনা করা হলো-
১. সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে জানা
সিন্ধু সভ্যতায় প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রকার অলংকার, স্বর্ণ, রৌপ্য, ইলেকট্রাম প্রভৃতি মূল্যবান ধাতু এবং অপেক্ষাকৃত কম মূল্যবান ধাতু, যেমন- ব্রোঞ্জ, তামা ইত্যাদি দ্রব্য প্রমাণ করে যে, সিন্ধু সভ্যতার জনসাধারণ বিভিন্ন অর্থনৈতিক পেশায় ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিল। প্রাপ্ত নিদর্শন তাদের কৃষি, বয়নশিল্প, মৃৎপাত্র, ইট তৈরি, স্বর্ণকার, কর্মকার, কুমার প্রভৃতি পেশায় নিয়োজিত থাকার প্রমাণ দেয়।
২. সামাজিক শ্রেণি সম্পর্কে জানা
সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মাধ্যমে সেকালের সামাজিক শ্রেণিভেদ সম্পর্কে জানা যায়। খননকার্যের ফলে মহেঞ্জোদারোতে প্রাপ্ত তথ্য থেকে আমরা জানতে পারি যে, এখানে বসবাসরত মানুষ ৪টি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। যথা:
- শিক্ষিত শ্রেণি: শিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে ছিল পুরোহিত, চিকিৎসক, জ্যোতিষী এবং জাদুকর গোষ্ঠী। বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষাদান এবং নিয়ম-কানুন প্রণয়ন এ শ্রেণির দ্বারাই সম্পন্ন হতো। পরবর্তীতে বৈদিক সমাজে ব্রাহ্মণরা সেই কাজ করত।
- যোদ্ধা শ্রেণি: যোদ্ধা শ্রেণির মধ্যে ছিল দুর্গের দ্বাররক্ষী, যুদ্ধের সৈনিকগণ। জনসাধারণকে রক্ষা করাই ছিল তাদের প্রধান কাজ। এরা পরবর্তীতে ভারতীয় সমাজে ক্ষত্রিয় নামে পরিচিতি লাভ করে।
- ব্যবসায়ী ও কারিগর: ব্যবসায়ী ও কারিগর শ্রেণিতে বিভিন্ন পেশার লোক ছিল। যেমন- রাজমিস্ত্রী, লিপিকার, শাঁখারি, স্বর্ণকার, তাঁতি, ছুতার ইত্যাদি।
- শ্রমজীবী শ্রেণি: শ্রমজীবী শ্রেণির মধ্যে ছিল গৃহকর্মে নিয়োজিত শ্রমিক, চর্মকার, জেলে, কুটির শিল্পের শ্রমিক, কৃষক, মুটে ইত্যাদি। এ শ্রেণির মানুষরা পরবর্তীতে বৈদিক যুগে চতুর্থ বা শূদ্রবর্ণে রূপান্তরিত হয়।
৩. অর্থনৈতিক অবস্থা
প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা জানতে সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শনসমূহের যথেষ্ট সমাজতাত্ত্বিক গুরুত্ব রয়েছে। সিন্ধু সভ্যতার মূল বুনিয়াদ গড়ে ওঠে কৃষি ও ব্যবসায়কে কেন্দ্র করে। অধিবাসীদের জীবিকা নির্বাহের প্রধান অবলম্বন ছিল কৃষিকাজ। তারা কৃষি জমিতে গম, যব, বার্লি ইত্যাদি উৎপাদন করত। তদুপরি তারা সবজি, দুধ, মাছ, গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি ইত্যাদির মাংস খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করত। সিন্ধু সভ্যতার ব্যবসায়ীগণ মিসর, পারস্য প্রভৃতি দেশের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপন করেছিল বলেও জানা যায়।
৪. রাজনৈতিক অবস্থা
প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে সিন্ধু সভ্যতার নির্দশনসমূহের সমাজতাত্ত্বিক গুরুত্ব অপরিসীম। সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক লিপিসমূহের পাঠোদ্ধার সম্ভব হয় নি বলে তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থার সঠিক চিত্র পাওয়া যায়নি। তবে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর বিভিন্ন ঘরবাড়ি ও অট্টালিকা নির্মাণের কৌশলের মধ্যে মিল থাকায় ইতিহাসবত্তোরা মনে করেন উভয় এলাকাই এক শক্তিশালী কেন্দ্রীয় প্রশাসনের অধীনে ছিল। রাজা ছিলেন শাসন ক্ষমতার মূল কেন্দ্রবিন্দু।
৫. ব্যবসায় বাণিজ্য
সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন নিদর্শনের মাধ্যমে প্রাচীন ভারতের ব্যবসায় বাণিজ্য সম্পর্কে জানা যায়। সিন্ধু সভ্যতার কারিগরগণ বিভিন্ন দ্রব্য সামগ্রী তৈরি করত, যার চাহিদা ভারতের উত্তর প্রান্ত রাজস্থান, গুজরাট প্রভৃতি প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। সিন্ধু সভ্যতার গৌরবময় দিনগুলোতে কাথিয়াওয়া ও দাক্ষিণাত্য থেকে কয়েক প্রকার পাথর এবং ঝিনুক, পারস্য ও আফগানিস্তান থেকে রূপা, পারস্য থেকে তামা, মধ্য এশিয়া থেকে জেড পাথর আনা হতো। তিলমুন দ্বীপ ও মেসোপটেমিয়ার বন্দরগুলো দিয়ে ময়ূর, গজদন্ত, মুসা ও সিন্ধু নামে পরিচিত সুতি কাপড় রপ্তানি করা হতো আর ঐসব জায়গা থেকে রূপা, সুগন্ধি দ্রব্য, কার্পাস, মূল্যবান পাথর ও অন্যান্য জিনিস আমদানি করা হতো।
৬. বিজ্ঞান সম্পর্কে ধারণা
প্রাচীন ভারতীয়রা বিজ্ঞান সম্পর্কে কতটুকু অগ্রসর ছিল তা সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শন থেকে জানা যায়। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সভ্যতার প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় তারা পাটিগণিত সম্বন্ধে জানত। নগরীর নগর পরিকল্পনায় তথা নগরের রাস্তা, নর্দমা, দালানকোঠা তৈরির ক্ষেত্রে যে দক্ষতা দেখিয়েছে তাতে তাদের জ্যামিতির জ্ঞান ছিল বলে ধারণা করা হয়। তাম্র ও টিন মিশ্রিত করে ব্রোঞ্জ এবং স্বর্ণ ও রৌপ্য মিশ্রিত করে ইলেকট্রাম তৈরির মধ্য দিয়ে সিন্ধু সভ্যতার বিজ্ঞানীগণ ধাতু সম্পর্কিত দক্ষতার পরিচয় দেয়। এছাড়া তারা রসায়ন শাস্ত্রেও ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিল।
৭. খাদ্যাভ্যাস
সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শন আমাদের প্রাচীন সিন্ধুবাসীদের খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে ধারণা দেয়। সিন্ধুবাসীদের প্রধান খাদ্য ছিল গম। তারা বিভিন্ন পশুর মাংস খেত, যেমন- গরু, ছাগল, শূকর, হাঁস, মুরগি, কচ্ছপ ইত্যাদি। যব ও খেজুর তাদের প্রিয় খাদ্য ছিল। মাছ ছিল তাদের সাধারণ খাবার। অনুমান করা হয় যে, সিন্ধুবাসীরা বিভিন্ন ধরনের সবজি ও ফল খেত। ৮. পোশাক-পরিচ্ছদ: সিন্ধু সভ্যতার লীলাভূমি হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর লোকদের পরিহিত পোশাক-পরিচ্ছদ ঐতিহাসিক সাক্ষ্য বহন করে। এসব অঞ্চলের লোকজন পোশাক-পরিচ্ছদ তৈরিতে প্রধানত সুতা ও পশম ব্যবহার করত। তখনকার দিনে দুই পার্টবিশিষ্ট পোশাকের প্রচলনই ছিল বেশি।
৯. হরপ্পা সভ্যতা
ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতাত্ত্বিকগণ সিন্ধু সভ্যতার নতুন নামকরণ করেন হরপ্পা সভ্যতা। এর ঐতিহাসিক যুক্তি হলো সাম্প্রতিককালে ভারতের অন্তর্দেশে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলে প্রায় ১৫০টি হরপ্পার ধ্বংসাবশেষের অনুরূপ নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে।
১০. ধর্মীয় অবস্থা
সিন্ধু সভ্যতার প্রকৃত ধর্মীয় অবস্থা বা ধর্মীয় দর্শন সম্পর্কে সঠিক তথ্য তেমন পাওয়া যায়নি। তবে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় প্রাপ্ত নিদর্শন থেকে অনুমান করা যায় যে, সিন্ধু সভ্যতায় ধর্মীয় বিশ্বাস প্রচলিত ছিল। খননকার্যের ফলে প্রাপ্ত অসংখ্য টেরাকোটার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মূর্তির অধিকাংশ ছিল মহিলা। এ থেকে ধারণা করা হয় যে, সিন্ধুবাসীরা মাতৃপূজা করত। প্রাপ্ত সীলগুলোর গবেষণা চালিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিকগণ পুরুষ দেবতা শিবের অস্তিত্ব খুঁজে পান। বাঘ, মহিষ, গণ্ডার পরিবেষ্টিত উলঙ্গ ত্রিমুখী, শিংধারী ধ্যানরত পুরুষ দেবতার যে মূর্তি পাওয়া গেছে তাকে তারা পূজা করত বলে মনে করা হয়। এছাড়া সিন্ধু সভ্যতায় পশু, বৃক্ষ ও পাখি পূজাও প্রচলিত ছিল।
১১. শিল্পকলা
ভারতের প্রাচীন শিল্পকলা কীরূপ ছিল সে সম্পর্কে জানতে সিন্ধু সভ্যতার দ্বারস্থ হতে হয়। শিল্প ও চিত্রকর্মে সিন্ধু সভ্যতা বেশ অগ্রসর ছিল। সে সময়ে ষাড়, হাতি, বাঘ, গণ্ডার, কুমির, হরিণ ইত্যাদির ছবি সংবলিত অনেক সীলমোহর আবিষ্কৃত হয়েছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো সিন্ধু সভ্যতার সুরম্য ও কারুকার্য খচিত অট্টালিকা। তাছাড়া সোনা, রূপার বিভিন্ন অলংকার তৈরিতেও তারা পারদর্শী ছিল। সিন্ধু সভ্যতায় বিভিন্ন ধরনের ও বর্ণের মৃৎপাত্র তৈরি হতো। তাদের মৃৎপাত্রগুলো ছিল দু’প্রকারের। যথা: ক. পারিবারিক তৈজসপত্র ও খ. সমাধিপত্র।
১২. ভাস্কর্য
সিন্ধু সভ্যতায় পাথর ও ব্রোঞ্জের তৈরি প্রচুর ভাস্কর্য পাওয়া গেছে। তাদের পাথরের ভাস্কর্যগুলো হলো- চুনাপাথরের মূর্তি, শ্মশ্রুমণ্ডিত আবক্ষ মূর্তি, নৃত্যরত নারী মূর্তি ইত্যাদি।
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা হয় যে, বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে সিন্ধু সভ্যতা স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে আছে।
আরও পড়ুন:
প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা বর্ণনা কর।
সভ্যতা কাকে বলে? প্রাচীন গ্রীক সভ্যতা সম্পর্কে আলোচনা কর