প্রিয় পাঠক, আজকে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় সম্পর্কে জানতে চলেছি। সেটা হলো সিন্ধু সভ্যতার নগর পরিকল্পনা । আপনারা হয়তো জেনে থাকবেন, সিন্ধু সভ্যতা হলো ইতিহাসের প্রথম নগর সভ্যতা। তাই সিন্ধু সভ্যতাকে নগর সভ্যতাও বলা হয়। আপনারা সিন্ধু সভ্যতার নগর পরিকল্পনা লেখাটিকে সিন্ধু সভ্যতাকে নগর সভ্যতা কেন বলা হয়, এর উত্তর হিসেবেও দিতে পারবেন। এছাড়া সিন্ধু সভ্যতাকে হরপ্পা সভ্যতা বলা হয় কেন, সেই উত্তরও পেয়ে যাবেন এই লেখায়। চলুন তবে শুরু করা যাক।
মূল আলোচনায় যাওয়ার পূর্বে আমরা সিন্ধু সভ্যতা সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নিই।
সিন্ধু সভ্যতা
মিশরীয়, ব্যবিলনীয় ও অ্যাসেরীয় সভ্যতার সমসাময়িক এই প্রাচীন সভ্যতাটিকে অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বলা হয়ে থাকে, “India is an eption of the world”। হিমালয় পর্বতে উৎপত্তি হয়ে ইরাবতীর ধারে হরপ্পা বর্তমানে পাকিস্তানের লাহোর থেকে একশ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে পাঞ্জাবের মন্টোগোমারি জেলায় ও সিন্ধু প্রদেশে সিন্ধু নদের ধারে মহেঞ্জোদারো বর্তমান করাচি থেকে দু’শত মাইল উত্তরে লারাকানা জেলায় প্রায় ৪০০ মাইল দুটি অঞ্চলকে নিয়ে প্রায় ১,৫০০ মাইল জুড়ে তিনটি অঞ্চলে বিভক্ত হয়ে সিন্ধু সভ্যতা গড়ে উঠেছে। অঞ্চল তিনটি হচ্ছে মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা ও চানহুন্দারো। বস্তুত সিন্ধু উপত্যকায় হওয়ার কারণেই এ সভ্যতাকে সিন্ধু’ সভ্যতা বলা হয়।
আরও পড়ুন: সভ্যতা কি বা কাকে বলে?
সিন্ধু সভ্যতার ইতিহাস বিশ্লেষণে দেখা যায় এ সভ্যতা ইউরোপীয়দের সমসাময়িক আধনামে পরিচিত জনগোষ্ঠীর দ্বারাই সিন্ধু সভ্যতার সৃষ্টি বলে মনে করা হয়। অনেকে একে সিন্ধু উপত্যকাবাসী সুমেরু জাতীয় সভ্যতা, আবার অনেকে একে দ্রাবিড় সভ্যতার নিদর্শন বলে মনে করেন। ঐতিহাসিকদের বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি মতবাদ এবং Sir Jonh Marshall-এর নেতৃত্বে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজে প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত এ সভ্যতার অনেক কীর্তি ও রহস্য উন্মোচিত করেছে এবং দ্রাবিড় বলে কথিত জনগোষ্ঠীই সিন্ধু সভ্যতার স্রষ্টা এ কথার স্বীকৃতিও পাওয়া গিয়েছে। দ্রাবিড়রাই ভারতে নাগরিক জীবনের সূত্রপাতের মাধ্যমেই এই স্বর্ণ সভ্যতার সূত্রপাত করেছিল এ মতবাদটি সাময়িকভাবে গ্রহণ করা যেতে পারে।
সিন্ধু সভ্যতার স্থায়িত্বকাল চার হাজার থেকে আড়াই হাজার অব্দ। কিন্তু ১৯২৪ সালে হরপ্পা মহেঞ্জোদারো তথা সিন্ধু সভ্যতার খনন কাজে প্রাপ্ত ধ্বংসাবশেষ ও বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত আবিষ্কৃত হলে সিন্ধু সভ্যতা তথা ভারতীয় সভ্যতা সম্পর্কে বিশ্ববাসীর ধারণা পাল্টে যায় এবং এটাকে বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতা হিসেবে অভিহিত করা হয়। এর বক্তব্যের সাথে দৃঢ়কণ্ঠে একাত্মতা জানিয়ে বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক জন মার্শাল সিন্ধু সভ্যতাকে ‘প্রাচীনতম সভ্যতা’ বলে অভিহিত করেছেন। প্রখ্যাত দার্শনিক Will Durant বলেছেন, “The Indus valley civilization was older than that which flowered of the mud of the Nile.”
সিন্ধু সভ্যতার নগর পরিকল্পনা
মানব ইতিহাসে যে কয়টি নদী তীরবর্তী সভ্যতার সন্ধান পাওয়া যায়, তার মধ্যে সিন্ধু সভ্যতার নগর পরিকল্পনা বেশ উন্নত। সিন্ধু নদীর তীরে গড়ে ওঠা মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা সভ্যতাই হলো সিন্ধু সভ্যতা। উত্তর দক্ষিণে ১১০০ কি.মি. ও পূর্ব-পশ্চিমে ১৬ কি.মি. জুড়ে বিস্তৃত জনবহুল ও ঐশ্বর্যমণ্ডিত এলাকা নিয়েই সিন্ধু সভ্যতা গড়ে উঠেছিল যার মূলভিত্তি ছিল সুমেরীয় সংস্কৃতি আর এটি মূলত মহেঞ্জোদারো ও হরপ্তা নগরীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সভ্যতা। প্রাচীন জগতের নগরপরিকল্পনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর ন্যায় বিন্যাসের মাধ্যমে। এ সভ্যতার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সুশৃঙ্খল ও স্বাস্থ্যসম্মত নগর জীবন। নিম্নে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সভ্যতার নগর পরিকল্পনা ও নগর উন্নয়ন উপস্থাপন করা হলো:
১. রাস্তা
নগর দুটোর রাস্তা ছিল সোজা প্রশস্ত ও সরল রেখার মতো। উভয় নগরের রাস্তাগুলো একই মাপের প্রশস্ত ছিল। প্রধান সড়ক ১০.৬৭ মিটার চওড়া এবং ছোট গলিপথে ১.৫২ মিটার রাস্তাগুলো এমনভাবে নির্মাণ করা হতো যাতে উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিমে পরস্পরকে ছেদ করে। রাস্তাগুলো এমনভাবে নির্মাণ করার অন্যতম কারণ ছিল প্রবল বাতাসে ঘরগুলোর ক্ষতিসাধন না হওয়া। সড়ক দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য রাস্তার প্রান্তসীমার বাড়িগুলো বৃত্তাকারে তৈরি করা হতো। রাস্তার ওপর বাড়ি তৈরি করতে হলে কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের প্রয়োজন হতো।
২ পানি সরবরাহ
হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সভ্যতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো জনজীবনের জন্য পানি সরবরাহ। প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজের ফলে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর বিভিন্ন অঞ্চলে পানি সরবরাহের কূপের সন্ধান পাওয়া গেছে। শাসনগণ নগরবাসীদের জন্য রাস্তার ধারে কূপ খনন করত। তাছাড়া ব্যক্তিগত উদ্যোগেও বাড়ির সামনে কূপ খননের ব্যবস্থা ছিল। কূপগুলোর চারপাশে ইটের উঁচু গাঁথুনী দেওয়া হতো। উভয় নগরবাসীর পানীয় জল ও গৃহস্থালির কাজের জন্য এই কূপের পানি ব্যবহার করত।
৩. পয়ঃপ্রণালি
নগর জীবনের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যবস্থা হিসেবে পয়ঃপ্রণালি ব্যবস্থা ছিল। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও ব্যক্তিগত উদ্যোগের সাহায্যে পয়ঃপ্রণালি ব্যবস্থা পরিচালিত হতো। নগরের প্রতিটি বাড়ির পার্শ্ববর্তী এলাকা যাতে ময়লা আবর্জনা দ্বারা নোংরা না হয়, সেজন্য রাস্তার পাশে ড্রেন ছিল। ড্রেনগুলো ইটের তৈরি এবং ঢাকনাযুক্ত। ড্রেনগুলোর যুক্ত নদীর সাথে সংযুক্ত ছিল। রাস্তার পাশ দিয়ে যে ড্রেনগুলো ছিল তা ০.৭৬ থেকে ০.৯১ মিটার গভীরে ছিল। বাড়ি থেকে ড্রেনগুলোতে পানি বের করার জন্য পোড়া ইটের নল ব্যবহার করা হতো। সময়মতো ড্রেন ও নল পরিষ্কার করার ব্যবস্থা ছিল।
৪. ডাস্টবিনের ব্যবস্থা
নগর পরিষ্কার রাখার জন্য হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোতে ডাস্টবিনের ব্যবস্থা ছিল। এ ডাস্টবিনগুলো চারকোণা ইটের তৈরি। ডাস্টবিনগুলো পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই কর্তৃপক্ষ এগুলোকে পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করত। তাছাড়া রাস্তার পাশে গণশৌচাগারের ব্যবস্থাও ছিল।
আরও পড়ুন: প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা বর্ণনা কর।
৫. সড়ক বাতি
নাগরিক সুবিধা প্রদানের জন্য নগর কর্তৃপক্ষ রাজপথের ধারে সমান দূরত্বে ল্যাম্পপোস্ট স্থাপন করেছিল। এতে নগরবাসীদের চলাচলের সুবিধাসহ নগরে চুরি ডাকাতি, রাহাজানি, ছিনতাই প্রভৃতি অপরাধ কমে গিয়েছে।
৬. নগর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা
হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো বহিরাক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য উভয় নগরীতেই পুরু ও উঁচু প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত ছিল। উভয় নগরেরর পশ্চিম দিক ঘেঁষে দুর্গপ্রাচীর ছিল। দূর্গপ্রাচীরেই উভয় নগরীর শাসকবর্গের বাসস্থান ও প্রশাসন বিভাগীয় ভবন অবস্থিত ছিল। হরপ্পা নগরীর দূর্গটি ৬.১০ মিটার থেকে ৭.৬২ মিটার চার স্তরবিশিষ্ট মাটির প্রলেপসহ পোড়া ইটের তৈরি ইমারত নির্মিত ছিল। দূর্গের বাইরের অংশে ১.২০ মিটার পুরু পোড়ানো ইটের আরেকটি অতিরিক্ত দেয়াল ছিল। চারপাশে নজর রাখার জন্য তৈরি করা হয়েছিল সুউচ্চ পর্যবেক্ষণ ঘর। দূর্গের সীমানায় শোভাযাত্রা অনুষ্ঠানের উপযোগী বা সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজ করার জন্য বিশেষ এক ধরনের রাজপথ ছিল।
৭. সাধারণ বাড়িঘর
সিন্ধু সভ্যতায় সাধারণ বাড়ির প্রবেশ দ্বার ছিল সড়কমুখী। প্রতিটি গৃহে তিনটি কক্ষ ও একটি চত্বর ছিল। কক্ষগুলো এমনভাবে তৈরি ছিল যে, আলো বাতাস অতি সহজেই ঢুকতে পারত এবং আলো বাতাসের কখনও স্বল্পতা ছিল না। চত্বরটি ছিল উন্মুক্ত এবং এই উন্মুক্ত চত্বরের চারদিকে কুঠুরি নির্মিত হতো। দু’একটি দ্বিতল বাড়িও দেখা গেছে। কাঠ, নলখাগড়া ও কাদামাটির প্লাস্টার দিয়ে এসব দ্বিতল বাড়ির ছাদ তৈরি করা হতো।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে অতি সহজেই বোঝা যায় যে, সিন্ধু সভ্যতার নগর পরিকল্পনা ছিল বেশ উন্নত এবং নগরবাসীরা বিলাসবহুল, পরিচ্ছন্ন, পরিকল্পিত ও স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন করত। এ প্রসঙ্গে Gordon childe উল্লেখ করেছেন যে, “সিন্ধু সভ্যতার হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো আমাদের নিকট একটি পদ্ধতি সম্মত পৌর সরকারের অস্তিত্বকে প্রকাশ করে। রোমানদের পূর্বে কোনো প্রাচীন সভ্যতায় সিন্ধুবাসীদের পৌর সংস্থার ন্যায় উন্নত সংস্থা ছিল বলে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না।”
সিন্ধু সভ্যতা সম্পর্কিত কিছু প্রশ্ন ও উত্তর
সিন্ধু সভ্যতা কোন যুগের সভ্যতা?
উত্তর: সিন্ধু সভ্যতা ব্রোঞ্জ যুগের সভ্যতা (খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩০০-১৩০০)।
সিন্ধু সভ্যতা কোথায় গড়ে উঠেছিল?
উত্তর: ভারতীয় উপমহাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে সিন্ধু নদ অববাহিকায়।
সিন্ধু সভ্যতা কে আবিষ্কার করেন?
উত্তর: সিন্ধু সভ্যতার আবিষ্কারক বাঙালি প্রত্নতত্ত্ববিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ তাঁর সাথে সাথে বাহাদুর দয়ারাম সোহানী এবং স্যার জন মার্শালও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের কারণ কি ছিল?
উত্তর: কোনো নির্দিষ্ট কারণ নেই। অনেকগুলো কারণে হয়ে থাকতে পারে। এই লেখাটি পড়তে পারেন- সিন্ধু সভ্যতা পতনের কারণ কি ছিল?
সিন্ধু সভ্যতার অপর নাম কি?
উত্তর: সিন্ধু সভ্যতার অপর নাম হল হরপ্পা সভ্যতা।
2 comments
[…] […]
[…] বৈশিষ্ট্য গুলি কি কি? এর আগে আমরা সিন্ধু সভ্যতার নগর পরিকল্পনা সম্পর্কে জেনেছি। উক্ত লেখায় সিন্ধু […]
Comments are closed.