প্রিয় পাঠক, আজকে আমরা খুবই গুরত্বপূর্ণ একটি বিষয় ‘সিন্ধু সভ্যতার পতনের কারণ’ সম্পর্কে আলোচনা করবো। আপনারা হয়তো জানেন, সিন্ধু সভ্যতা তথা হরপ্পা সভ্যতা হলো ভারতীয় উপমহাদেশের একটি প্রাচীন সভ্যতা। এটি সিন্ধু নদীর অববাহিকায় গড়ে উঠেছিল বলে এর নাম হয় সিন্ধু সভ্যতা। চলুন, কথা না বাড়িয়ে মূল আলোচনাটি শুরু করি।
সিন্ধু সভ্যতার পতনের কারণ সমূহ
অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক সিন্ধু সভ্যতাকে ব্রোঞ্জযুগের সভ্যতা বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ সভ্যতার ধারক হিসেবে দ্রাবিড়দেরকে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এ সভ্যতার পতন কীভাবে হয়েছিল তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে নানান মতভেদ প্রচলিত আছে। খননকার্যের ফলে প্রাপ্ত মানুষের কংকাল দ্বারা অনুমান করা হয় বৈদেশিক শত্রুর আক্রমণে এ সভ্যতার ধ্বংস হয়েছে। আবার অনেকই মনে করেন সিন্ধু নদীর বন্যার ফলে অথবা নদীর গতিপথ পরিবর্তনের ফলে এ সভ্যতার পতন ঘটে। হুইলার সিন্ধু সভ্যতার পতনকে নিম্নোক্ত ছকে উপস্থাপন করেছেন:
নিম্নের আলোচনায় সিন্ধু সভ্যতার পতনের কারণ গুলো উপস্থাপন করা হলো:
১. প্রাকৃতিক দূর্যোগ
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ SR. Kohli তাঁর Indus valley civilization গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, সিন্ধু সভ্যতার পতনের অন্যতম কারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মহামারি। সিন্ধু নদে পানি পড়ে নদীগর্ত ভরাট হয়ে যাওয়ায় বর্ষার পানি নগরকে প্লাবিত করত। উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সিন্ধুর প্লাবন ঘন ঘন হানা দিত। ফলে বারবার প্লাবিত হওয়ার কারণে মহেঞ্জোদারো ও চানহুদারে অংশ অধিকাংশই ধ্বংস প্রাপ্ত হয়।”
আরও পড়ুন:
সিন্ধু সভ্যতার নগর পরিকল্পনা বর্ণনা কর
সিন্ধু সভ্যতার বৈশিষ্ট্য গুলি কি কি?
সিন্ধু সভ্যতার অবদান বা সিন্ধু সভ্যতার সমাজতাত্ত্বিক গুরুত্ব
২. জলবায়ুর পরিবর্তন
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অতি দ্রুত গতিতে সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের মুখে পতিত হয়। ইতিহাসবেত্তারা মনে করেন, সিন্ধু উপত্যাকা প্রথমে বনজঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। এ অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে এবং অনুকূল পরিবেশের জন্য এসব অঞ্চলের বনজঙ্গল কেটে মানুষ বসবাস শুরু করে। এভাবেই মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা নামক দুটি নগর রাষ্ট্রের বিকাশ ঘটেছে। এভাবেই সিন্ধু সভ্যতায় বনজ সম্পদ কেটে পরিবেশ ধ্বংস করা হয়। ফলে জলবায়ু পরিবর্তন ঘটে এবং বৃষ্টির স্বল্পতার জন্য সিন্ধু সভ্যতার কৃষিভূমিগুলো মরুভূমিতে পরিণত হয়।
৩. আবহাওয়ার পরির্তন
প্রখ্যাত দার্শনিক F. A. Khan উল্লেখ করেছেন, “১৮০০ খ্রি. পূর্ব অব্দের পর সমগ্র সিন্ধু অঞ্চলে আবহওয়া পরিবর্তন হতে থাকে।” এই পরিবর্তনের তিনটি কারণ রয়েছে যথা: ভূ-প্রকৃতির পরিবর্তন ও সিন্ধুনদের গতিপথ পরিবর্তন, উচ্চতা বৃদ্ধি ও বনবৃক্ষের ধ্বংস ও বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাওয়া।
৪. কৃষি ও অপরাপর অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অবনতি
কেবল প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তনই সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের প্রধান কারণ নয়। নগরকেন্দ্রিক সভ্যতায় ক্রমে কৃষির গুরুত্ব ও উৎকর্ষ হ্রাস পেতে থাকলে অর্থনৈতিক কারণ ও এ সভ্যতার ঐ সভ্যতার ধ্বংসের পথ উন্মুক্ত করেছিল।
৫. অভ্যন্তরীণ অবক্ষয়
প্রাকৃতিক কারণের সাথে সাথে অভ্যন্তরীণ অবক্ষয় ক্রিয়াশীল হওয়ায় সিন্ধু সভ্যতা দ্রুত গতিতে ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয়েছে। সিন্ধু সভ্যতার নগর পরিকল্পনা থেকে শুরু করে সামগ্রিক জীবনযাত্রায় সর্বত্র ভগ্নদশার উপস্থিতি ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। এ সভ্যতায় প্রথম দিকে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোতে বড় বড় যে দালানকোঠা ও রাস্তাঘাট তৈরি হয় তা শেষ পর্যন্ত স্থায়ী হয়নি। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পূর্বের গৌরব পরবর্তীতে ধরে রাখা যায় নি, সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে সংস্কৃতির কোনো পরিবর্তন না ঘটায় অভ্যন্তরীণ অবক্ষয় দ্রুত গতিতে সম্পন্ন হয় এবং সভ্যতার ধ্বংস অনিবার্য হয়ে ওঠে।
৬. বহিঃশত্রুর আক্রমণ
খ্রিষ্টপূর্ব ১৪০০ সালে সিন্ধু অঞ্চলের জনগণের কাছে পর্যাপ্ত অস্ত্র ছিল না। তাছাড়া এ অঞ্চলের লোকেরা যুদ্ধপ্রিয় ছিল না। ঐতিহাসিকগণ মনে করেন, উজ্জ্বল গৌরবর্ণের উন্নতনামা, সুশ্রী, ও বলিষ্ঠ আর্য-জাতির আক্রমণে খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০ বা ১৫০০ সালে এ সভ্যতার অবসান হয়।
৭. কেন্দ্রীয় শাসনের শৈথিল্য
সিন্ধু নদের বন্যা শুধু কৃষি উৎপাদন হ্রাস করেনি বরং খাজনা আদায়ের ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। ঐতিহাসিক G. Donbar তার “History of India” গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, “সিন্ধু ও তার শাখা নদীসমূহের সুশৃঙ্খলিত ও সুরক্ষিত জীবনযাত্রা ব্যাহত হলে কেন্দ্রীয় শাসন শিথিল হয়ে পড়ে এবং এর ফলশ্রুতিতে বৈদেশিক আক্রমণের পথ সুগম হয়। এভাবেই সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয়েছে।
৮. ক্রমবর্ধন জনগোষ্ঠীর স্থান পরিবর্তন
কিছু অঞ্চলের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর ক্রমাগত স্থান পরিবর্তন সিন্ধু সভ্যতার পতনের কারণ বলে অনেকে মনে করেন।
পরিশেষে বলা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দে আর্যরা উত্তর পশ্চিম অঞ্চল দিয়ে হিন্দুকুশ পর্বতমালা অতিক্রম করে পাক- ভারতীয় অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। ইতিহাসবেত্তা অনেকটা একমত যে, আর্যরা পাকভারতে হানা দিলে দ্রাবিড়েরা বীরের মতো লড়াই করে পরাজয় বরণ করেছিল। এ প্রসঙ্গে R.C. Majumder উল্লেখ করেছেন, “It was not-merely a conflict between two nations but a conflict between two types of civilization”.