৬ দফা আন্দোলন কি?
৬ দফা আন্দোলন স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ৬-দফা কর্মসূচি লাহোর কনভেনশনে উপস্থাপন করেন। পরের দিন ৭ ফেব্রুয়ারি বিষয়টি ঢাকার সংবাদপত্রে ছাপা হলে বাংলার মানুষ ৬-দফা সম্পর্কে অবগত হয়।
১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে পাকিস্তান পরাজিত হয় এবং তাসখন্দ চুক্তির মাধ্যমে এ যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। এ পরাজয় পশ্চিম পাকিস্তানিদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করে। আইয়ুব বিরোধীরা তাসখন্দ চুক্তি স্বাক্ষরের সমালোচনা করার অভিপ্রায়ে ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে এক সম্মেলন আহ্বান করেন। এ সম্মেলনে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ৭৪০ জন রাজনীতিবিদ অংশ নেন। এর মধ্যে মাত্র ২১ জন রাজনীতিবিদ ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত। পূর্ব পাকিস্তানের ২১ জনের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার দলের ৪ জন নেতা ছিলেন।
আরও দেখুন: বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব তুলে ধর
পশ্চিম পাকিস্তানিদের কাছে এই সম্মেলনে প্রধান আলোচনার বিষয় হিসেবে ছিল তাসখন্দ চুক্তি ও পাকিস্তানের অর্জন। কিন্তু আওয়ামী লীগের বলিষ্ঠ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান যিনি সে সময় পূর্ব পাকিস্তান প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে ছিলেন, তিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবিটি এ সম্মেলনে উপস্থাপনেই বেশি আগ্রহী ছিলেন। তার কাছে তাসখন্দ চুক্তিটি মুখ্য বিষয় ছিল না। প্রকৃতপক্ষে আইয়ুব সরকারের বিপর্যয়ের সময়ে উভয় অঞ্চলের সকল রাজনৈতিক মহলের চেষ্টা ছিল ছাত্র নেতাদের মাধ্যমে আইয়ুব সরকারের পতন ও সামরিক বাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে দেওয়া। এসময়ই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবিটি উপস্থাপনের যৌক্তিক সময় বলে মনে করেছেন এবং এই সম্মেলনকে প্লাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করেছেন। ন্যাপ ও এন ডি এফ এ সম্মেলনে যোগদান করেনি। ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬-দফা কর্মসূচি উপস্থাপন করলে আওয়ামী লীগের ৪ জন নেতা ব্যতীত বাকি সকলেই (৭৩৫ জন) তা নাকচ করে দেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর দল আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টিকে রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত করে দেশকে স্বাধিকারের পথে এগিয়ে নিয়ে যান।
৬ দফা আন্দোলনের পটভূমি
১. রাজনৈতিক বঞ্চনা
পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের শুরু থেকেই পূর্ববঙ্গের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ করা হয়। লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হলেও স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টিকে কখনোই আমলে আনা হয়নি। এমনকি ভাষার প্রশ্নে আন্দোলন করতে হয়। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করলেও পশ্চিম পাকিস্তানিদের চক্রান্তে সাফল্য লাভ করতে পারেনি। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখল ও সামরিক আইন জারি সংসদীয় গণতন্ত্রকে হত্যা করে।
২. আইয়ুব সরকারের কালাকানুন
আইয়ুব খান সামরিক আইন জারি করে রাজনীতি নিষিদ্ধ করেন এবং PODO ও EBDO- এর মাধ্যমে রাজনীতিবিদ ও অন্যান্য ব্যক্তিদের গ্রেফতার করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। ফলে দীর্ঘদিন রাজনীতিবিদরা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে। ১৯৫৯ সালে মৌলিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে আইয়ুব খান নিজেকে সর্বোচ্চ শক্তিশালী করে তুলেছিলেন। মৌলিক গণতন্ত্রী নির্বাচনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছিল। ১৯৬২ সালের সংবিধান আইয়ুব খানের ক্ষমতাকে আরো বৃদ্ধি করেছিল। ১৯৬০ ও ১৯৬৫ সালের নির্বাচন ছিল প্রহসনমূলক। রাজনৈতিক দল আইন করে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে দমনের সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। আইয়ুব খানের দমননীতি পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে আন্দোলনমুখি করে তোলে।
৩. ১৯৬৫ সালের পাক ভারত যুদ্ধ
১৯৬৫ সালের পাক ভারত যুদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের অধিকার আদায়ে সচেতন করে তোলে। আইয়ুব সরকারের পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক বৈষম্য দূরীকরণে অবহেলা ও কাশীর যুদ্ধের ব্যর্থতা রাজনৈতিক আন্দোলনের একটি ইস্যু তৈরি করে।
প্রথমত, ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক দুর্বলতা সকলেই উপলব্ধি করে। পূর্ব পাকিস্তানকে অরক্ষিত রেখেই আইয়ুব খান ভারতের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। প্রশাসনিক দিক থেকেও পূর্ব পাকিস্তান কেন্দ্র থেকে যুদ্ধকালীন সময়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবিটি অনিবার্য হয়ে যায়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর দল আওয়ামী লীগ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে ৬-দফা কর্মসূচি দেয়।
দ্বিতীয়ত, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে দূরত্ব এবং সুষ্ঠু যোগাযোগ ও সরবরাহ ব্যবস্থার অভাবে জনগণ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকে। এমনকি যুদ্ধকালীন সময়ে অর্থনৈতিক মন্দা পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থার অবনতি ঘটায়। এ বাস্তব অবস্থা এতদঞ্চলের মানুষকে ৬-দফা দাবির প্রতি সোচ্চার করে তোলে।
তৃতীয়ত, ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করেন। তিনি বেতারে রবীন্দ্র সঙ্গীত পরিবেশন নিষিদ্ধ করেন, ভারত থেকে কোনো প্রকার সাংস্কৃতিক উপাদান ও প্রকাশনা আমদানি নিষিদ্ধ করেন। নজরুলের গানগুলো থেকে হিন্দু শব্দগুলোর পরিবর্তে ইসলামি শব্দের ব্যবহার ইত্যাদি কর্মকাণ্ড পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ নিজেদের সংস্কৃতির প্রতি আক্রমণ বলে মনে করেন।
আপনারা পড়ছেন ৬ দফা আন্দোলন ও এ আন্দোলনের পটভূমি সম্পর্কে। আশা করি লেখাটি পড়ে অনেক উপকৃত হবেন।
৪. বৈষম্যমূলক নীতি
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকবর্গ আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণ করে। যার ফলে পূর্ব বাংলার জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা সৃষ্টি হয়। তাই ছয় দফা দাবির প্রেক্ষাপট ছিল বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণ।
৫. স্বায়ত্তশাসনের অভাব
ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই বাঙালি স্বায়ত্তশাসনের দাবি করে আসছিল। ১৯৪৭ সালে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টি হয় বটে। কিন্তু বাস্তবে পূর্ব পাকিস্তান স্বায়ত্তশাসন লাভ করে নি। আইয়ুব খানের শাসনামলে পূর্ব পাকিস্তানকে অধিক মাত্রায় শোষণ করা হয়েছিল। তাই সকল শাসন, শোষণ ও অত্যাচারের প্রতিবাদ ও স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালির প্রাণের দাবি ছয় দফা পেশ করা হয়।
৬. সংবিধানে পূর্ববাংলার জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা উপেক্ষিত
স্বাধীনতার দীর্ঘ ৯ বছর পর পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণয়ন করা হলেও তাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে নি। পরবর্তী সময়ে ১৯৬২ সালে সামরিক শাসক আইয়ুব খান যে সংবিধান প্রণয়ন করেন, তাতেও বাংলার জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা উপেক্ষিত হয়। তাই চরম নৈরাজ্যের প্রতিবাদে ১৯৬৬ সালে ছয় দফা পেশ করা হয়।
আরও দেখুন: ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা কর
৭. সামরিক শাসন জারি
ক্ষমতার উচ্চাভিলাষী সামরিক শাসক আইয়ুব খান ক্ষমতায় এসেই পাকিস্তানের সংবিধান স্থগিত করেন। রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে নেতাদের গ্রেফতার করেন। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা পেশ করেন।
৮. অগণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশ
আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারির মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক চিন্তা- চেতনার পথ রুদ্ধ হয়। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ দীর্ঘদিন ধরে গণতান্ত্রিকভাবে যে আন্দোলন করে আসছিল, তা আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারির মধ্য দিয়ে তা বন্ধ হয়ে যায়। তাই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য ঐতিহাসিক ছয় দফা পেশ করা হয়।
৯. স্বৈরাচারী শাসন
আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে পাকিস্তানে সকল রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম বন্ধ করেন। জনগণের ভোটাধিকার হরণ করে মৌলিক গণতন্ত্রের প্রবর্তন করেন। এতে তিনি স্বৈরাচারী শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তাই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ স্বৈরাচারী শাসকের বিদায় জানানোর প্রয়োজন অনুভব করলে ছয় দফা দাবি উত্থাপিত হয়।
১০. সিদ্ধান্ত গ্রহণে বঞ্চিত
পাকিস্তানের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর একচেটিয়া আধিপত্য ছিল। গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ব্যাপারে পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের কোনো মূল্যায়ন ছিল না। তাই প্রশাসনিক অবহেলার কারণেও ছয় দফা দাবি পেশ করা হয়েছিল।
১১. ন্যায্য অংশ না পাওয়া
পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ সম্পদের ন্যায্য অংশ থেকে বঞ্চিত হতো। বেশির ভাগ অর্থ খরচ করা হতো পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য। বেসামরিক প্রশাসনের অফিসার পর্যায়ে ৫% কোটা এবং প্রতিরক্ষা বিভাগে ১০% কোটা থাকলে ও তা পুরণ করা হতো না। তাই ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে ছয় দফা দাবি পেশ করেন।
উপর্যুক্ত পটভূমিতে আতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার সাহস, সততা ও নিষ্ঠার প্রতি অবিচল থেকে ঐতিহাসিক ৬-দফা কর্মসূচি উপস্থাপন করেন। সকল বাঙালি বিশেষ করে তরুণ নেতা কর্মীরা ৬-দফার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করে এবং শ্লোগান ও পোস্টারের মাধ্যমে এ দাবিকে জনগণের দাবিতে পরিণত করে। এভাবে গড়ে ওঠে ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন ।