১৯৫৪ সালের নির্বাচনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের গুরুত্ব বহুবিধ। এটা ছিল সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটের ভিত্তিতে প্রথম অবাধ নির্বাচন। পূর্ব বাংলার জনগণের মধ্যে এ নির্বাচন রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করে এবং তাদের মধ্যে বিপুল রাজনৈতিক উৎসাহ উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। সর্বোপরি এ নির্বাচন স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের গুরুত্ব নিম্নরূপ:
১. জাতীয় চেতনা জাগ্রতকরণ
যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন বাঙালি জাতিকে জাগ্রত করতে সক্ষম হয়। ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে তারা ক্ষমতাসীন লুটেরা দলকে পরাস্ত করে। এতে জাতীয়তাবোধের গভীরতা বাঙালি জাতিকে প্রলুব্ধ করে। বাঙালি জাতির আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে তারা যে ঐক্যবদ্ধ বিশেষ করে জাতীয় স্বার্থকে টিকিয়ে রাখতে হলে যে মন মানসিকতার দরকার তা পুনরায় প্রমাণ করে। বাঙালি মুক্তির সংগ্রামে তাদের ভেতর চেতনাবোধ শাণিত হতে থাকে।
আরও দেখুন: ভাষা আন্দোলনের পটভূমি ব্যাখ্যা কর
২. অসাম্প্রদায়িক চেতনার সৃষ্টি
অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়তে বাঙালি জাতির চেতনার পরিস্ফুটন হয়। ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত ২ রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটে পূর্ব বাংলার জনগণের কাছে।
৩. জোট আন্দোলনের সূচনা
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে কৌশল অবলম্বন করে নির্বাচনি জোট গঠন করে যুক্তফ্রন্ট সহজেই জয়লাভ করে। পূর্ব বাংলায় এর মাধ্যমে একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের উদ্ভব হয়। যে দলের মাধ্যমে পরবর্তী স্বাধিকার আন্দোলনের পথে বাঙালি এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
৪. মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব
এ নির্বাচনে রাজনৈতিক নেতৃত্বে গুণগত পরিবর্তন সাধিত হয়। সমাজের উঁচুস্তরের ব্যক্তিদের পরিবর্তে রাজনৈতিক নেতৃত্বে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সদস্যদের মধ্যে তরুণদের আধিক্যই প্রমাণ করে যুব সমাজ রাষ্ট্রের প্রাণশক্তি, যার প্রমাণ ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ।
৫. মুসলিম লীগের প্রভাব হ্রাস
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে পাকিস্তান মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয়। এ নির্বাচনের ফলাফল ‘তাদের হতবাক করে দেয় এবং এর প্রভাব হয় সুদূরপ্রসারী। কালক্রমে এ দলটি জনবিচ্ছিন্ন দলে পরিণত হয় এবং ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর অখণ্ড পাকিস্তানের কথা বললেও এ দলটি আর গ্রহণযোগ্যতা হারায়। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির পর মুসলিম লীগ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
৬. রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি
১৯৫৪ সালের নির্বাচন পূর্ব বাংলার জনগণ তাদের রাজনৈতিক দাবি সম্পর্কে সচেতন করে। পূর্ব বাংলার জনগণের মধ্যে সংহতি ও সচেতনতা আরো বৃদ্ধি পায়। এ রাজনৈতিক সচেতনতাই পরবর্তী সময়ে পূর্ব বাংলার জনগণকে স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতি অনুপ্রাণিত করে।
ছ. বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি আদায় করলেও পাকিস্তান সরকার তার স্বীকৃতি দেয় নি। কিন্তু ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের রায়ের পর পাকিস্তানের গণপরিষদ ১৯৫৬ সালে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ব বাংলার মাতৃভাষা রূপে স্বীকৃতি দেয়।
৭. যোগ্য নেতৃত্বের আবির্ভাব
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে পূর্ব বাংলার জনগণের মধ্যে যোগ্য নেতৃত্বের আবির্ভাব ঘটে। হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দী, এ.কে. ফজলুল হক, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো যোগ্য নেতারা জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পরবর্তীকালে এ সমস্ত নেতৃবৃন্দই স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আরও দেখুন: বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব তুলে ধর
৮. গণপরিষদে প্রতিনিধিত্ব
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে জয়ের ফলে যুক্তফ্রন্ট পাকিস্তানের গণপরিষদে পূর্ব বাংলার অংশীদারিত্ব দাবি করে। অক্টোবরে প্রথম গণপরিষদ ভেঙে দেওয়া হয়। দ্বিতীয় গণপরিষদে পূর্ব বাংলা হতে ৪০ জন ও পশ্চিম পাকিস্ত ান হতে ৪০ জনসহ মোট ৮০ জন সদস্যবিশিষ্ট গণপরিষদে ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি সংবিধান বিল পাস করে।
৯. বাংলাদেশের অভ্যুদয়
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে জয়লাভ, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা লাভের অন্যতম শক্তি হিসেবে কাজ করে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের অফুরন্ত ত্যাগ, ঐক্য ও সংহতি, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বিরাট প্রভাব ফেলে। তারই ধারাবাহিকতা ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা, ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থান, ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জয়লাভ করে। সৃষ্টি হয় স্বাধীন বাংলাদেশের। সর্বোপরি বলা যায়, ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচন এবং ২১ দফার ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্টের ব্যাপক সাফল্য বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক স্মরণীয় ঘটনা এ নির্বাচনে জয়লাভ করে পূর্ব বাংলার জনগণ অধিকার সচেতন হয়ে ওঠে এবং নিজেদের ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ে আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে ওঠে। বিশেষত এ নির্বাচনের ফলেই পাকিস্তানে গণতন্ত্রের অভিযাত্রা শুরু হয়।
অতএব, উপরোক্ত আলোচনা থেকে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের গুরুত্ব সম্পর্কে জানতে পারলেন। লেখাটি ভালো লাগলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন।