বাজারজাতকরণের মৌলিক ধারণা সমূহ
বাজারজাতকরণ বা মার্কেটিং বিষয়টি কতগুলো মৌলিক ধারনার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। বাজারজাতকরণ বিষয়টি সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান লাভ করতে হলে এর মূল ধারণাগুলো সম্পর্কে অবহিত থাকা প্রয়োজন। বাজারজাতকরণের সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে বাজারজাতকরণের মৌলিক ধারণা গুলোর সাথে পরিচিতি লাভ করা যায়।
নিচে বাজারজাতকরণের মৌলিক ধারণা সমূহ আলোচনা করা হলো-
১. প্রয়োজনবোধ (Needs)
বাজারজাতকরণের সাথে জড়িত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক ধারণা হলো প্রয়োজনবোধ। প্রয়োজনবোধ হলো কোন কিছু না পাওয়ার অনুভূতি। মানুষের বিভিন্ন রকমের প্রয়োজনবোধ রয়েছে। শারীরিক (যেমন, খাদ্য, বস্তু ও বাসস্থানের প্রয়োজন), সামাজিক (যেমন, স্নেহ-মমতার প্রয়োজন) এবং ব্যক্তিগত (যেমন, জ্ঞান আহরণ ও আত্ম- প্রকাশের প্রয়োজন)।
বাজারজাতকরণের গুরুত্ব আলোচনা কর |
২. অভাববোধ (Wants)
প্রয়োজনবোধ থেকেই অভাববোধের সৃষ্টি হয়। যেমন, খাদ্যের প্রয়োজন হলে মানুষ চাউল বা আটা পেতে চায়। ঢাউল বা আটা না পাওয়া গেলে মানুষের মধ্যে এদুটোর অভাববোধের সৃষ্টি হয়। অভাববোধ সম্পর্কে জানতে পারলেই ব্যবসায়-প্রতিষ্ঠান তদনুযায়ী পণ্য উৎপাদন করে যাতে অভাব মেটানো যায়।
৩. চাহিদা (Demand)
একজন ব্যক্তির ক্রয়-ক্ষমতার পাশাপাশি অভাব পূরণের ইচ্ছা থাকলে তার অভাববোধ চাহিদায় রূপান্তরিত হয়। কারও রাজান টিভির অভাব থাকলে এবং তার নিকট খরচ করার যোগ্যা ২০,০০০ টাকা থাকলে, তার টিভি-এর অভাববোধ চাহিদায় পরিণত হবে। পণ্য ক্রয় করার আর্থিক ক্ষমতা না থাকলে এবং ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও পণ্য কেনার ইচ্ছা না থাকলে কোন ব্যক্তির অভাবোধ চাহিদায় রূপান্তরিত হয় না।
৪. পণ্য (Products)
মানুষের প্রয়োজন ও অভাব মেটাতে সক্ষম যেকোন জিনিসই বাজারে ছাড়া হলে তা পণ্য হিসেবে পরিচিত হয়। পণ্য দৃশ্যমান কিংবা অদৃশ্যমান) হতে পারে। একটি টিভি দৃশ্যমান পণ্য। ব্যাংকের কার্যাবলি বা ডাক্তারের ডাক্তারি পরামর্শ হলো অদৃশ্যমান পণ্য, যা সেবা নামে পরিচিত।
৫. অনুধাবনকৃত মূল্য (Value)
একজন গ্রাহক কর্তৃক পণ্যের জন্য প্রদত্ত মূল্য এবং পণ্যটি ব্যবহারের ফলে পাওয়া তৃপ্তি এর দুয়ের মধ্যকার পার্থক্যকে “অনুধাবনকৃত মূল্য” বলে। এটি পণ্যের গায়ে লেখা দাম নয়। আপনি ১০০ টাকায় একটি পণ্য নিয়ে যদি মনে করেন যে, আপনি আসলে ১৫০ টাকার সমপরিমাণ তৃপ্তি পেয়েছেন অথবা পণ্যটি আপনার এত প্রয়োজনীয় যে এর দাম ১৫০ টাকা হলেও আপনি ক্রয় করতেন, তাহলে ৫০ টাকা (১৫০-১০০) হবে অনুধাবনকৃত মূল্য |
৬. গ্রাহকের সন্তুষ্টি বা তৃপ্তি (Customer satisfaction)
গ্রাহকের প্রত্যাশার সাথে পণ্যের পারফরমেন্স কতটুকু মিলে গেছে তার উপর গ্রাহকের সন্তুষ্টি নির্ভর করে। গ্রাহকের প্রত্যাশার চেয়ে পণ্যের পারফরমেন্স কম হলে গ্রাহক অসন্তুষ্ট হলে প্রত্যাশার সাথে পারফরমেন্স সমান সমান হলে গ্রাহক সন্তুষ্ট হয়। আর প্রত্যশার চেয়ে পণ্যের পারফরমেন্স বেশি হলে গ্রাহক উল্লসিত হয়। স্মার্ট কোম্পানিগুলো সব সময় গ্রাহকদের সন্তুষ্ট ও উল্লসিত করতে চায়।
৭. গুণাগুণ (Quality)
গ্রাহকের সন্তুষ্টির সাথে পণ্যের গুণাগুণের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তাই ইদানিংকালে বহু প্রতিষ্ঠানে “সার্বিক গুণাগুণ ব্যবস্থাপনা”-এর মাধ্যমে তাদের পণ্য, সেবা ও বিপণন প্রক্রিয়ার গুণ সার্বক্ষণিকভাবে বৃদ্ধির প্রয়াস চালাচ্ছে। কোয়ালিটি বলতে কোন কোন কোম্পানি মনে করে পণ্য বা সেবার ত্রুটিমুক্ততা; আবার কেউ কেউ কোয়ালিটিকে গ্রাহক-সন্তুষ্টি সমার্থক মনে করে। অর্থাৎ পণ্য ব্যবহারের মাধ্যমে গ্রাহক সন্তুষ্ট হলে সে পণ্যকে কোয়ালিটি-পণ্য হিসেবে গণ্য করা হয়।
৮. বিনিময় (Exchange)
অন্যের নিকট থেকে প্রতিদানের মাধ্যমে কিছু গ্রহণ করার প্রক্রিয়াই হলো বিনিময়। বিনিময়ের মাধ্যমে আপন প্রয়োজন ও অভাব মেটানোর জন্য মানুষ সিদ্ধান্ত নিলেই বিপণনের উদ্ভব হয়।
৯. লেনদেন (Transaction)
বিনিময়ের মাধ্যমেই লেনদেন হয়। লেনদেনের জন্য থাকতে হবে দুটি পক্ষ যারা কোন কিছু বিনিময় করবে। এক পক্ষ একটি পণ্য দিলে এবং অন্য পক্ষ তার বিনিময়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিলে তা হবে আর্থিক লেনদেন। আবার একটি পণ্যের (যথা- পুরনো টিভি সেট) বিনিময়ে অন্য পক্ষের নিকট থেকে আরেকটি পণ্য (যথা- পুরনো রিফ্রিজারেটর) গ্রহণ করলে তা হবে দ্রব্য-লেনদেন।
বাজারজাতকরণ মিশ্রণের উপাদান গুলো বর্ণনা কর |
১০. সম্পর্ক (Relationships)
আজকাল বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান/উৎপাদকের সাথে গ্রাহক, পরিবেশক, ডিলার সরবরাহকারীদের সম্পর্কের উপর জোর দেয়া হচ্ছে। (প্রকৃতপক্ষে, ডিলার এবং পরিবেশকও গ্রাহক) গ্রাহক ও সরবরাহকারীর সাথে প্রতিষ্ঠানের সুসম্পর্ক স্থাপন ও তা সমৃদ্ধশালীকরণের প্রক্রিয়া ‘সম্পর্কগত বিপণন’) নামে পরিচিত।
১১. বাজার (Markets)
বাজার কোন স্থান নয়। বাজার হলো বর্তমান ও ভবিষ্যতের গ্রাহকদের সমষ্টি। এসব গ্রাহকদের একইরূপ প্রয়োজনবোধ ও অভাববোধ থাকে যা পণ্যের বিনিময়ের মাধ্যমে পরিতৃপ্ত করা যায়।
পরিশেষে আমরা সংক্ষেপে বলতে পারি যে, বিপণন হলো বিনিময়ের মাধ্যমে মানুষের প্রয়োজন ও অভাব মেটানোর উদ্দেশ্যে বাজারের ব্যবস্থাপনাকরণ।