বাংলাদেশের সেবা খাত সমূহ
বাংলাদেশে সেবা খাত এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। তবে বর্তমানে বাংলাদেশের সেবা খাত দ্রুত বিকশিত হচ্ছে। নিম্নে বাংলাদেশের সেবা খাত সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
১১. শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান
সরকারি ও বেসরকারি প্রচুর প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে শিক্ষা বিস্তারে কাজ করছে। সরকারি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বেসরকারি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। অনেক এনজিও বয়স্ক শিক্ষা, নারী শিক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে কাজ করছে। যেমন- ব্র্যাক। ব্র্যাক দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে “ব্র্যাক স্কুলের” মাধ্যমে শিক্ষা দিচ্ছে।
২. স্বাস্থ্য সেবা
সরকারি হাসপাতালে দরিদ্র রোগীরা বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে চিকিৎসা সেবা লাভ করছে। প্রত্যেক জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে সরকারি হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে। এছাড়া অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও জনগণকে অব্যবসায়িক লক্ষ্যে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে। যেমন- জীবনতরী, লাইফবয় ফ্রেন্ডশীপ হাসপাতাল প্রভৃতি। বেসরকারি ক্লিনিক, নার্সিং হোম, ডায়াগনোস্টিক সেন্টার প্রভৃতিও বাংলাদেশে বিকশিত হচ্ছে।
সেবা কি বা কাকে বলে? সেবার বৈশিষ্ট্য কি কি? |
৩. পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি
বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান জাতীয় সমস্যা হচ্ছে বিশাল জনসংখ্যা এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির উচ্চহার। বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি অনেক সেবামূলক প্রতিষ্ঠান এক্ষেত্রে কাজ করছে। যেমন- সবুজ ছাতা, সূর্যের হাসি, ব্লু-স্টার চিহ্নিত পারিবারিক স্বাস্থ্য ক্লিনিক প্রভৃতি। এছাড়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রাড্ডা, ওজিএসসি প্রভৃতিও এক্ষেত্রে কাজ করছে।
৪. সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠান
সরকারি বিভিন্ন সেবা প্রতিষ্ঠানও অব্যবসায়িক উদ্দেশে জনগণকে বিভিন্ন সেবা দিয়ে থাকে। যেমন- ডাক বিভাগ, টি এন্ড টি, ওয়াসা প্রভৃতি। এসব প্রতিষ্ঠান সেবা প্রদানের বিনিময়ে অর্থ নিলেও এদের ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য থাকে না। এছাড়াও বিদ্যুৎ, গ্যাস প্রভৃতি ক্ষেত্রে সরকার জনগণকে সেবা দিচ্ছে। সম্প্রতি টি এন্ড টি মোবাইল চালু করেছে।
৫. প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান
বাংলাদেশে বেকার যুবশক্তিকে প্রশিক্ষণ, প্রদানের ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এক্ষেত্রে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। এ প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন বিষয়ে বেকার যুবক ও যুবমহিলাকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানও নামমাত্র বা বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।
৬. সিটি কর্পোরেশন
সিটি কর্পোরেশনগুলো জনকল্যাণমূলক বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে। যেমন- আবর্জনা পরিষ্কার, মশা নিধন প্রভৃতি। এছাড়া শহরে পৌরসভা এবং গ্রাম পর্যায়ে ইউনিয়ন পরিষদও এ ধরনের কল্যাণমূলক কার্যক্রম সম্পাদন করে।
৭. এন জি ও (NGO)
দেশী-বিদেশী সহায়তায় পরিচালিত বিভিন্ন এন জি ও দেশের আর্ত-সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপকভাবে কাজ করছে। নিরক্ষরতা দূরীকরণ, বয়স্ক শিক্ষা, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, আর্সেনিকমুক্ত পানি পান, ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে স্বাবলম্বন, বিভিন্ন সচেতনতা সৃষ্টি প্রভৃতি ক্ষেত্রে অসংখ্য এন জি ও কাজ করছে। এর মধ্যে ব্রাক, আশা, কারিতাস প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
৮. পরিবহন খাত
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে পরিবহন খাতে যথেষ্ট অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। ঢাকা শহরে নতুন নতুন বাস সার্ভিস চালু হয়েছে। মহিলাদের জন্য আলাদা বাস সার্ভিস শুরু হয়েছে। রেলওয়ে কিছু কিছু রুট বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ছেড়ে দিয়েছে। বেসরকারি বিমান সংস্থা যাত্রী আনা-নেয়া করছে।
৯. যোগাযোগ খাত
যোগাযোগের ক্ষেত্রে মোবাইল ফোন যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে। সরকারি ও বেসরকারি দুই ধরনের মোবাইল ফোনই বাংলাদেশে রয়েছে। ফ্যাক্স, কুরিয়ার সার্ভিস, ই-মেইল, ইন্টারনেট প্রভৃতির ব্যাপক প্রসার ঘটেছে।
১০. আর্থিক খাত
ব্যাংক, বিমা ও বিভিন্ন ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে দ্রুত বিকশিত হচ্ছে। বেসরকারি ও বিদেশী ব্যাংকগুলো দক্ষতার সাথে সেবা দিয়ে মানুষের আস্থা অর্জন করছে। এসব ব্যাংক ক্রেডিট কার্ড, এটিএম কার্ড, ট্রাভেলার চেক প্রভৃতির মাধ্যমে সেবাকে মানুষের হাতের নাগালে নিয়ে এসেছে। দেশে এখন বহু দেশী-বিদেশী বিমা কোম্পানি কাজ করছে। গাড়ি, বাড়ি প্রভৃতি ক্ষেত্রে ঋণ প্রদানের লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।
১১. পর্যটন ও বিনোদন
সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বাংলাদেশে পর্যটন ও বিনোদন সুবিধা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন এর পাশাপাশি অসংখ্য টুরিজম কোম্পানি এখানে গড়ে উঠেছে। এদের প্যাকেজ ট্যুর স্বল্প আয়ের মানুষকে সহজেই আকৃষ্ট করছে। বিনোদনে সরকারি পার্ক, চিড়িয়াখানার বাইরে ফ্যান্টাসি কিংডম, নন্দন-কানন মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
১২. এইডস্ নিয়ন্ত্রণ
মরণব্যাধি এইডস্ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন ও এইডস্রে বিস্তার রোধে বাংলাদেশে অনেক অব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এসব প্রতিষ্ঠান স্বামী-স্ত্রী ছাড়া অন্য নারী-পুরুষের সাথে দৈহিক সম্পর্ক না করা, রক্ত দেয়া-নেয়ায় সতর্ক হওয়া ও ইনজেকশনের একই সিরিঞ্জ বার বার ব্যবহার না করার পরামর্শ দিচ্ছে।
১৩. এসিড নিয়ন্ত্রণ
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে এসিড নিক্ষেপ একটি আলোচিত বিষয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এসিড বিরোধী জনমত তৈরি করছে। এছাড়া এসিড আক্রান্তদের চিকিৎসা, পুনর্বাসন, আইনি সহায়তা প্রদানে অনেক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এসিড সারভাইবারস ফাউন্ডেশন এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে।
১৪. মাদক বিরোধী কর্মসূচি
মাদক বাংলাদেশের যুব সমাজের জন্য একটি মারাত্মক অভিশাপ। মাদকের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা, মাদকাসক্তদের চিকিৎসা প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এক্ষেত্রে সরকারি বিভিন্ন উদ্যোগও লক্ষণীয়।
১৫. পথকলি ট্রাস্ট
রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো ছিন্নমূল শিশুদের সংগ্রহ ও লেখাপড়ার ব্যবস্থা করে পথকলি ট্রাস্ট এসব শিশুদের কল্যাণে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখছে। কর্মমুখী শিক্ষা ও কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদান করার ফলে এ শিশুরা ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। ছিন্নমূল শিশুদের কল্যাণে অনেক প্রতিষ্ঠান কাজ করে যাচ্ছে।
১৬. আবাসন
বাংলাদেশে হোটেল, মোটেল, ফ্ল্যাট, বাড়ি প্রভৃতি দ্রুত বিকশিত হচ্ছে। পর্যটন সেবা জনপ্রিয় হবার সাথে সাথে হোটেল, মোটেল উন্নত হচ্ছে। কক্সবাজারে অনেক উন্নতমানের হোটেল রয়েছে। দ্রুত শহরায়নের ফলে এবং শহরমুখী প্রবণতার কারণে ফ্ল্যাট, বাড়ি প্রভৃতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। সম্প্রতি অসংখ্য হাউজিং কোম্পানি বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে।
পণ্যের জীবন চক্র কি? পণ্যের জীবন চক্র বলতে কি বুঝায়? |
১৭. ব্যক্তিগত পরিচর্যা
বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তিগত পরিচর্যা সেবাও বাংলাদেশে সম্প্রসারিত হচ্ছে। লন্ড্রি, সেলুন, বিউটি পার্লার, ব্যায়ামাগার প্রভৃতি গড়ে উঠেছে। এখন ছেলেদের জন্যও বিউটি পার্লার চালু হয়েছে। স্বাস্থ্য সচেতনতার কারণে ব্যায়ামাগার জনপ্রিয় হচ্ছে।
১৮. ব্যবসায় ও পেশাগত সেবা
বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায় ও পেশাগত সেবার মধ্যে উকিলের পরামর্শ, ব্যবস্থাপনা পরামর্শ, হিসাব নিরীক্ষা, বাজারজাতকরণ গবেষণা, বিজ্ঞাপনী সংস্থার সেবা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। সাম্প্রতিক সময়ে এ সব সেবা বাংলাদেশে যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছে।
১৯. অন্যান্য সেবা
উপরিউক্ত সেবার বাইরে বাংলাদেশে আরও বিভিন্ন ধরনের সেবা রয়েছে। যেমন- পুলিশ, আনসার, র্যাব, বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থা, মেরামত সেবা (ফ্রিজ, এসি, টেলিভিশন প্রভৃতি), পরিচ্ছন্নতা সেবা, সেলাই (পোশাক, জুতা প্রভৃতি), মিডিয়া সেন্টার, হোম-ডেলিভারি সার্ভিস, অগ্নি-নির্বাপন, আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম, সি এন্ড এফ এজেন্ট প্রভৃতি।
উপরিউক্ত আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের সেবাখাত সম্পর্কে একটি ধারণা দেয়া হলো। তবে এর বাইরে আরও বিভিন্ন ধরনের সেবা থাকতে পারে। সময়ের সাথে সাথে চিরাচরিত সেবার পাশাপাশি নতুন নতুন সেবা বাংলাদেশে বিকশিত হচ্ছে। তবে এর জন্য প্রয়োজন সময়োপযোগী সরকারি নীতিমালা ও সহযোগিতা।