নিরীক্ষা কি একটি পেশা – এই প্রশ্নটি অনেকেই করে থাকেন। নেট বা বই ঘেঁটেও অনেকে হয়তো এর সদুত্তর পান না। তাদের জন্যই আজকের এই লেখাটি। এই লেখার মাধ্যমে নিরীক্ষা কি একটি পেশা এই প্রশ্নের উত্তর পাবেন বিস্তারিতভাবে। চলুন তাহলে শুরু করা যাক।
নিরীক্ষা কি একটি পেশা
নিরীক্ষা পেশা কিনা সে প্রশ্নের অবতারণা করার পূর্বে পেশার অর্থ ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। পেশা শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। এখন পর্যন্ত পেশা সর্বজন স্বীকৃতি প্রাপ্ত হিসাবে সংজ্ঞায়িত হয়নি। তবে সাধারণ অর্থে পেশা বলতে বোঝায় সে রকম একটি বৃত্তিমূলক সেবাকর্মকে যা থেকে ব্যক্তি তাঁর জীবিকা অর্জন করতে পারে। যেমন- ডাক্তারের ডাক্তারি, উকিলের ওকালতি ইত্যাদি।
পেশার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে ব্যবস্থাপনা চিন্তাবিদদের মধ্যে মত পার্থক্য দেখা যায়। যাহোক, পেশা বলতে এমন এক বৃত্তিমূলক সেবাকর্মকে বোঝায় যার জন্য প্রয়োজন হয় বিশেষ জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ; যেটা ব্যক্তির আত্মতুষ্টির জন্য নয়, সমাজের বৃহত্তর স্বার্থেও ব্যবহৃত হয় এবং যার সাফল্য কেবল আর্থিক মানদন্ডে নয়, সামাজিক মানদন্ডেও পরিমাপ করা হয়।
আরও পড়ুন: পেশা কি? পেশার বৈশিষ্ট্য কি কি?
কোন কাজ বা বৃত্তিকে পেশা বলতে গেলে প্রধানত তার কয়েকটি বৈশিষ্ট্য থাকা প্রয়োজন। তাই আমাদের দেশে নিরীক্ষা পেশা বলা যাবে কিনা সে আলোচনা আমরা পেশার বৈশিষ্ট্যগুলো উল্লেখপূর্বক নিম্নলিখিতভাবে করতে পারি-
১) বিশেষ জ্ঞান
বিশেষ কোন বিষয়ে পেশাদার হতে হলে ঐ বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান থাকা আবশ্যক। বিশেষ ঐ জ্ঞান লাভ করতে হলে সুপরিচিত প্রথায় সরকার কর্তৃক অনুমোদিত কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নেওয়া প্রয়োজন। যেমন- ওকালতি করতে হলে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আইন বিষয়ে পড়াশুনা করতে হয়, ডাক্তারি করতে হলে স্বীকৃত কোন মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি বিষয়ে পড়াশুনা করতে হয়। হিসাব পরীক্ষার ক্ষেত্রেও আমাদের দেশে বিধিবদ্ধ হিসাবপরীক্ষককে ১৯৭৩ সালের বাংলাদেশ চার্টার্ড একাউন্ট্যান্টসি পড়াশুনা করতে হয় বা প্রয়োজন অনুযায়ী উৎপাদন ব্যয় হিসাব পরীক্ষা করার জন্য ১৯৭৭ সালের কষ্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট একাউন্ট্যান্টস আদেশ অনুসারে প্রতিষ্ঠিত ইনষ্টিটিউট অব কষ্ট এন্ড ম্যানেজমেন্ট একাউন্ট্যান্টস নামক প্রতিষ্ঠানে কষ্ট একাউন্ট্যান্টসি পড়াশুনা করতে হয়।
২) ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জন
পেশাদার ব্যক্তি হিসাবে পুঁথিগত জ্ঞান লাভের যেমন প্রয়োজনীয়তা রয়েছে তেমনি ব্যবহারিক জ্ঞানেরও সমান প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তাই ডাক্তার হতে যেমন প্রথম কয়েকবছর পড়াশুনার সঙ্গে হাউস স্টাফ হিসাবে ডাক্তারি জগতে বাস্তব অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়, তেমনি আমাদের যারা চার্টার্ড একাউন্ট্যান্টসি পড়াশুনা করেন তাদেরকে অন্ততপক্ষে তিন বছর কোন চার্টার্ড একাউন্ট্যান্টসি ফার্মে আর্টিকেল ক্লার্ক হিসেবে ব্যবহারিক জ্ঞান লাভ করতে হয়।
৩) ব্যবহারিক জ্ঞানের প্রয়োগ
পেশাদার হওয়ার জন্য কেবলমাত্র বিশেষ জ্ঞানলাভ করলেই চলবে না, ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে অর্জিত ঐ জ্ঞান যাতে উপকারে আসে তার সুযোগ থাকা চাই। যেমন- ডাক্তারি পাস করে ডাক্তারকে অসুস্থ মানুষের সেবা করতে হয়, উকিলকে মামলা-মোকদ্দমার সুরাহা করতে হয়, শিক্ষক-শিক্ষিকাগণকে পড়াশুনার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র-ছাত্রীদের নীতিগত শিক্ষা, চরিত্র গঠন, মানসিক উন্নতি বিধানে ভূমিকা পালন করতে হয়। অবশ্য যদিও বর্তমানের সমাজ ও শিক্ষা ব্যবস্থায় ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে একটা ব্যবধান লক্ষ্য করা যাচ্ছে, শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ ছাত্র-ছাত্রীদের অনেকাংশে অন্তর দিয়ে ভালবাসে না, ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের শ্রদ্ধা করে না, বাবা-মায়েরা তাদের দায়িত্ব পালন করেন না ইত্যাদি। যাহোক ডাক্তারি পাস করে যদি হাসপাতালের স্টোরকিপার হতে হয়, উকিলকে যদি ওকালতি না করে সাধারন এক কেরানি হতে হয়, পড়ানোর জন্য শিক্ষক-শিক্ষিকাদের যদি সুযোগ না দেয়া হয় তা হলে তাদের আর পেশা বজায় থাকে না। অবশ্য আমাদের দেশে পুথিগত জ্ঞান ও ব্যবহারিক জ্ঞান লাভের পর চার্টার্ড একাউন্ট্যান্টদের হিসাবপরীক্ষা কাজের সুযোগ রয়েছে।
৪) কাজের স্বাধীনতা
পেশায় গুণগত মান বজায় রাখার জন্য কাজ করার স্বাধীনতা থাকা প্রয়োজন। যেমন- ডাক্তারী পেশায় একজন ডাক্তার স্বাধীনভাবে এবং মনোযোগের সাথে রোগীর চিকিৎসা করেন। তেমনি একজন নিরীক্ষক হিসাব নিরীক্ষার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ কাজ করার সুযোগ পান।
৫) নৈতিক মান
প্রতিটি পেশায় নির্দিষ্টমানের কিছু নৈতিক নির্দেশ দেয়া হয় এবং নির্ধারিত ঐ নৈতিক জ্ঞান পেশাদার ব্যক্তিগণ মেনে চলবেন সেটাই আশা করা হয়। নৈতিক আচরণবিধি মেনে চললে ব্যক্তি ও সমাজের স্বার্থ সুরক্ষিত হয়, সমাজের মানুষকে পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করা যায়। অবশ্য যদিও ডাক্তার, উকিল, শিক্ষক-শিক্ষিকা প্রভৃতি পেশাজীবী মানুষরা কতটা তাদের নৈতিক আচরণবিধি মেনে চলছেন সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা করতে হয়। অনুরূপভাবে আমাদের দেশে ১৯৭৩ সালের চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট আদেশে চার্টার্ড একাউন্ট্যান্টদের পেশাগত আচরণবিধির নির্দেশ রয়েছে।
৬) প্রতিনিধিত্বমূলক সমিতি
বিভিন্ন পেশার পেশাদারদের একটি করে প্রতিনিধিত্বমূলক সংস্থা থাকে। যেমন- ডাক্তারদের বাংলাদেশ মেডিকেল কাউন্সিল, উকিলদের বাংলাদেশ বার কাউন্সিল ইত্যাদি। এই সকল সংস্থার কাজ হল সংস্থার অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি সদস্যকে পেশায় নিযুক্ত হওয়ার পূর্বে অনুজ্ঞাপত্র প্রদান করা। কেবলমাত্র অনুজ্ঞাপত্র প্রদান নয়, সংস্থার প্রতিটি সদস্যদের স্বার্থ যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে তা দেখা এবং নির্ধারিত আচরণ বিধিগুলো যাতে যথাযথভাবে মেনে চলা হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখাও এর কাজ।
৭) সামাজিক দায়িত্বপালন
পেশায় নিযুক্ত প্রতিটি ব্যক্তিকে সমাজের প্রতি তার দায়িত্ব পালন করতে হয়। তার বিনিময়ে তাদের পারিশ্রমিকও নিতে হয়। যদিও সেবার বিনিময়ে ঐ পারিশ্রমিক কোন কোন ক্ষেত্রে ন্যায্য নয় বা আর্থিক মানদন্ডে বিচার করা যায় না। আমাদের দেশে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন ক্ষেত্রে চার্টার্ড একাউন্ট্যান্টস ও কষ্ট এন্ড ম্যানেজমেন্ট একাউন্ট্যান্টসরা সমাজের প্রতি তাদের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। হিসাবপরীক্ষার ব্যবস্থা না থাকলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে ভুল-জুয়াচুরি প্রচুর পরিমাণে বেড়ে যেত সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকে না। বর্তমানে সামাজিক দায়িত্ব পূরণের নিরীক্ষা করার ব্যবস্থা প্রবর্তন হতে চলেছে। তাই যদি হয় তাহলে ভবিষ্যতে পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধ কল্পে সমাজের প্রতি নিরীক্ষকদের দায়-দায়িত্ব যথেষ্ট পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।
অতএব, উপরের আলোচনা থেকে সহজেই অনুমেয় যে, বাংলাদেশে নিরীক্ষাকে অনেকাংশে পেশাভিত্তিক বলে ধরা যায়। তাই পেশাগত আচরণবিধি ও অসদাচরণ বিষয়ে ১৯৭৩ সালের চার্টার্ড একাউন্ট্যান্টস আদেশে নির্দিষ্ট কিছু বিধির নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।