Home » বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব তুলে ধর।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব

বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব তুলে ধর।

by Susmi
0 comment

Table of Contents

বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ভাষা আন্দোলন

১৯৪৭ সালে শুরু হওয়া ভাষা আন্দোলন ১৯৫২ সালে চূড়ান্তরূপ রূপ লাভ করে। বাংলার ইতিহাসে এ আন্দোলনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কেননা পাকিস্তান শাসন শোষণের বিরুদ্ধে এটা ছিল বাঙালি জাতির প্রথম বিদ্রোহ। এ আন্দোলনের সিঁড়ি বেয়ে বাঙালির জীবনে আসে ৫৪-এর নির্বাচন, ৬৬-এর ৬ দফা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান সর্বোপরি আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ। এ আন্দোলন বাঙালিদের এক নব জাগরণে দীক্ষিত করে এবং পরবর্তী সকল আন্দোলনের অনুপ্রেরণা জোগায়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই সর্বপ্রথম বাঙালি জাতীয়তাবাদ চেতনা সৃষ্টি হয়। ভাষার জন্য আত্মদানের ফলে বিশ্ববাসীর নিকট বাংলার মর্যাদা বৃদ্ধি পায় এবং বিশ্ববাসী এ ভাষা সম্পর্কে জানার অবকাশ পায়। ভাষার জন্য প্রথম নির্মিত হয় শহিদ মিনার, যা বিশ্ববাসীকে অবাক করে দেয়। এটি পরিণত হয় জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীকে। সর্বশেষ জাতিসংঘ কর্তৃক বাংলা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা মর্যাদা লাভ করে যা কেবল আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের কারণে সম্ভবপর হয়েছে।

নিচে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:

১. বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ (Development of Bangali Nationalism)

ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালি জাতির জীবনে এমন একটি অধ্যায় যার মধ্য দিয়েই বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই বাঙালিরা এই সর্বপ্রথম নিজেদের একটি স্বতন্ত্র সত্তা, স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে ভাবতে শুরু করে। ভাষার প্রশ্নে তারা সকলে একাত্ম হয়ে যান। ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদ চেতনা আরও বিকশিত হয়ে ওঠে।

আরও দেখুন:   ভাষা আন্দোলনের পটভূমি ব্যাখ্যা কর

২. স্বাতন্ত্র্যবোধের চেতনা (Individualism consciousness)

পাকিস্তান সৃষ্টির পর বাঙালিরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করল যে, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সবসময় তাদের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ করে আসছে। তারা ভাইয়ের নামে, ধর্মের নামে বাঙালিদের শোষণের নানা কৌশল প্রয়োগ করছে। এ আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালিদের মধ্যে এমন ধারণা জন্য লাভ করে যে, বাঙালিরা পাকিস্তানের অপর অংশ বসবাসরত জনসমাজ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সামাজিক সাংস্কৃতিক অভিধানেও বাঙালিদের আলাদা জাতিসত্তা। এমনকি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী বিচারেও বাঙালিদের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানিদের কোনো মিল নেই।

১০০১ মুসলিম আবিষ্কার (মুসলিম সভ্যতার অনন্য গৌরবগাথা): সেলিম টি এস আল-হাসসানি - 1001 Muslim Abishkar: Salim T.S. Al-Hassani

TK. 1,200 TK. 840

৩. সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অবসান (To remove communal politics)

১৯৪৭ সালে রাজনৈতিক কোনো দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে সম্পূর্ণরূপে সাম্প্রদায়িক মনোভাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। তাই শুরুতেই এ রাষ্ট্রের সদস্যরা সাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণ করে তাদের কর্মকাণ্ড এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালান। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অবসান ঘটে। বিশেষ করে উর্দু ভাষাভাষীরা ভাষা আন্দোলনের পর রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ে। পূর্ববাংলার ক্রমশ অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পথ প্রশস্ত হয় এবং পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম পরিচালনা করে।

৪. জাতীয় চেতনার সূচক (Indicator of national consciousness)

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বাঙালির জাতীয় চেতনার সূচক হিসেবে বিবেচিত। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে বাঙালিরা ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন, ১৯৬২-র শিক্ষা কমিশন আন্দোলন, ‘৬৬-র ছয় দফা কর্মসূচি’, ৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলন ও সশস্ত্র সংগ্রামে ছড়িয়ে পড়ার ফলে জাতীয় চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। বাঙালিরা এ চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে ১৯৭১ সালে একটি সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে নিজেদের আলাদা জাতিসত্তার পরিচয় খুঁজে পায়।

৫. মধ্যবিত্ত বাঙালিদের রাজনৈতিক অবস্থান সৃষ্টিকারী (Political position of Bengali Middle class)

১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর লক্ষ করা যায় যে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান উভয় অঞ্চলেই সমাজের বিত্তশালী ও উঁচু শ্রেণির লোকেরা প্রতিনিধিত্ব করত। পাকিস্তানের রাজনীতির শুরুতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ছিল অবহেলিত কিংবা অনেক সময় তারা উচ্চবিত্ত রাজনীতিবিদের সহযোগী হয়ে কাজ করত। কিন্তু ভাষা আন্দোলনেই ফলে ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সবকটি আন্দোলনেই নেতৃত্বের রশি থাকে মধ্যবিত্ত শ্রেণির হাতে।

৬. গণতান্ত্রিক চেতনা সৃষ্টিয় সহায়ক (Democratic consciousness)

বাংলা ভাষা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ভাষা হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার স্বীকৃতি দেয় যা ছিল গণতন্ত্রের পরিপন্থি। কিন্তু বাঙালিরা এক নবচেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ভাষার দাবিতে এক গণতান্ত্রিক চেতনা নিয়ে অগ্রসর হয় যার দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে বিরল।

৭. ছাত্র-সমাজের গুরুত্ব বৃদ্ধি (Increase the importance of students-society)

পৃথিবীর অনেক দেশেই জাতীয় মুক্তির আন্দোলনে মূল নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। অনুরূপভাবে ৫২-র ভাষা আন্দোলন এদেশের ছাত্র সমাজের সংগ্রামী ভূমিকা ও আত্মদান তাদের নেতৃত্বের আসনে প্রতিষ্ঠা করে। যার প্রতিফলন আমরা পরবর্তী প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে লক্ষ করে থাকি।

৮. সুসংগঠিত রাজনৈতিক একক সৃষ্টি (Organized political unit)

ভাষা আন্দোলন বাঙালিদের একটি একক রাজনৈতিক প্লাটফরমের অধীনে একত্রিত করে এবং পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর অন্যায়, অত্যাচার ও উৎপীড়নের বিরুদ্ধে নিজেদের অধিকার আদায়ের মন্ত্রে দীক্ষিত করে সুসংগঠিত রাজনৈতিক একক শক্তি সৃষ্টি করে।

৯. ঐক্যজোট গঠনের রীতি (Formation of unity)

ভাষা আন্দোলন ছাত্র সমাজকে একটি প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করে এবং ছাত্র, বুদ্ধিজীবী ও পেশাদার শ্রেণির ঐক্যজোট গঠনের রীতির সূত্রপাত হয়। স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে বাঙালিরা ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন সংগ্রাম পরিচালনা করে আসছে। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, কৃষক-প্রজা পার্টি, নেজামে ইসলাম এর সমন্বয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়।

১০. অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলন (Movement of economic freedom)

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন শুধু ভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলন ছিল না। বরং এ আন্দোলনটি বাঙালি জাতির অর্থনৈতিক মুক্তির পেছনে অসামান্য অবদান রেখেছে। বাঙালিরা যখন অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়াস পেয়েছে তখনই তারা ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে মূলমন্ত্র হিসেবে কাজে লাগিয়ে পাকিস্তানি শাসকদের অন্যায় কাজের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

১১. স্বাধীনতা আন্দোলনের পথ প্রশস্ত (Liberation movement)

ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজবপন করে। এ আন্দোলনের পর বাঙালিরা আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায়ের মূলমন্ত্রে দীক্ষিত হয়। এ আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই পরবর্তীকালের আন্দোলনসমূহ পরিচালিত হয়। যার চূড়ান্ত পরিণতি ১৯৭১ সালের ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভ করে বাঙালি অর্জন করে স্বাধীনতা।

১২. সর্বজনীন সংগ্রামী মনোভাব সৃষ্টি (To create universal struggle attitude)

উপমহাদেশে ব্রিটিশ বিরোধী বহু আন্দোলন সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু তা কোনো সময়ই সর্বজনীন রূপ লাভ করতে সক্ষম হয়নি। গুটিকয়েক স্বার্থান্বেষী মুসলিম লীগ নেতা ছাড়া সমগ্র পূর্ব বাংলার জনগণ ভাষার প্রশ্নে একাত্মতা পোষণ করে। ভাষা আন্দোলনই হলো প্রথম আন্দোলন যেটি সমগ্র বাংলাদেশের গণমানুষের আন্দোলনে পরিণত হয়।

১৩. সচেতনতা সৃষ্টি (Creation of consciousness)

ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতিকে সচেতন করে তোলে। তারা এর মাধ্যমে নিজেদের অধিকার সম্পর্কে শিক্ষা লাভ করতে পারে। তারা উপলব্ধি করতে পারে যে, দাবি আদায়ের জন্য কোনো জাতির আত্মদান কখনো বিফলে যেতে পারে না। বাঙালিরা পরবর্তী সকল আন্দোলন সংগ্রামের ভাষা আন্দোলনকে তাদের অনুপ্রেরণার কেন্দ্রস্থল হিসেবে ব্যবহার করে আসছে।

আরও দেখুন:   বাঙালি জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ও বিকাশধারা আলোচনা

১৪. বাংলার মর্যাদা লাভ (Status of Bangla)

বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য এদেশের মানুষ নিজদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছে। তাদের এ আত্মদান বৃথা যায়নি। ১৯৫৬ সালের সংবিধান শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। এমনকি ১৯৬২ সালের সংবিধানেও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দান করা হয়। আর ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে আইন পরিষদের ভাষা হিসেবে ব্যবহারের স্বীকৃতি প্রদান করা হয়।

১৫. বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভ (International status of Bangla)

বাংলা ভাষা আজ নিজস্ব গৌরবে দীপ্তিমান। জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইউনেস্কো কর্তৃক ২০০০ সালে বাংলাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পালিত হয়। সমগ্র বিশ্ববাসী আজ বাঙালি জাতির আত্মত্যাগের মহিমার কথা বিদিত হয়েছে। এমন কি আফ্রিকান দেশ সিয়েরালিওন তাদের দেশে বাংলাকে দ্বিতীয় ভাষার মর্যাদা দান করেছে।

১৬. পরবর্তী সকল রাজনৈতিক আন্দোলনের পথিকৃৎ (Pioneer of political movement)

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন পরবর্তী সকল রাজনৈতিক আন্দোলন পথিকৃৎ হিসেবে বিবেচিত। কারণ এ আন্দোলন পরবর্তী সময় পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যত আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে তার সবগুলোতে আন্দোলনকারীদের প্রেরণা যুগিয়েছে ভাষা। তাছাড়া ভাষার আন্দোলনের স্মৃতির শহিদ মিনার পরিণত হয়েছে বাঙালি জাতির আশা-ভরসার কেন্দ্রস্থলে। যে কোনো প্রতিবাদী সংগ্রামের আজ জাতি সব সময়ই শহিদ মিনারে সমবেত হয়।

উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে বলা যায়, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার জনসাধারণের ভেতর ক্ষোভ প্রচণ্ডভাবে ধূমায়িত হচ্ছিল, সেই ধূমায়িত ক্ষোভ ভাষা আন্দোলনের সময় আরো ব্যাপক রূপ নেয়। ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ভাবনার ভিত্তিতে স্বাতন্ত্র্যবোধ, নিয়তচেতনা ও আর্থ-সামাজিক স্বার্থবোধ অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখে ভাষা আন্দোলন। বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়গুলো থেকে শুরু করে বাংলা ভাষা-সাহিত্য ও স্বাধিকার আন্দোলনের পথিকৃৎ হিসেবে মূলত ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ এর প্রথম সরব প্রকাশ।

Related Posts