বাজার বিভক্তিকরণ কি ?
বাজারের সকল ভোক্তার চাহিদা, পছন্দ, ক্রয়ক্ষমতা এক রকম নয়। আর একজন বাজারজাতকারীর পক্ষে সকল ভোক্তা প্রয়োজন মিটানোও সম্ভ্য নয়। বাজারজাতকরণ মতবাদের প্রয়োগ ঘটিয়ে ভোক্তাদের সর্বাধিক সন্তুষ্টি বিধানের জন্য বাজারজাতকারী তার সামর্থ্য ও যোগ্যতা অনুযায়ী বাজারকে বিভিন্ন উপবিভাগে ভাগ করে এক বা একাধিক উপবিভাগ বেছে নেয়। এরপর সব উপবিভাগের ভোক্তাদের চাহিদা, পছন্দ, ক্রয়ক্ষমতা অনুযায়ী পণ্য উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণ করে। কোনো একটি পণ্যের বাজারকে কতিপয় বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে কয়েকটি উপবিভাগে বিভক্ত করাকে বাজার বিভক্তিকরণ বলে। যেমন, একটি পোশাক প্রস্তুতকারক কোম্পানি তার বাজারকে বয়স এবং আয়ের ভিত্তিতে বিভক্ত করেছে। এ কারণে কোম্পানি বিভিন্ন বয়সী মানুষের জন্য বিভিন্ন দামের পোশাক উৎপাদন করে।
বাজার বিভক্তিকরণের সংজ্ঞা
বিভিন্ন লেখক বিভিন্নভাবে বাজার বিভক্তিকরণের সংজ্ঞা দিয়েছেন। নিম্নে কয়েকটি সংজ্ঞা তুলে ধরা হলো-
- Philip Kotler এবং Gary Armstrong বাজার বিভক্তিকরণের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, বাজার বিভক্তিকরণ হচ্ছে প্রয়োজন, বৈশিষ্ট্য বা আচরণের ভিত্তিতে একটি বাজারকে সমজাতীয় ক্রেতা দলে বিভক্ত করা যাদের পৃথক পণ্য বা বাজারজাতকরণ মিশ্রণ প্রয়োজন হতে পারে।
- Skinner এ প্রসঙ্গে বলেন, বাজার বিভক্তিকরণ হচ্ছে সামগ্রিক বাজারকে ক্রেতাদলে বিভক্ত করার প্রক্রিয়া যাদের অপেক্ষাকৃত সমজাতীয় পণ্য প্রয়োজন।
- Lamb, Hair এবং McDaniel এর মতে, বাজার বিভক্তিকরণ হচ্ছে বাজারকে অর্থপূর্ণ, তুলনামূলক সমজাতীয় এবং শনাক্তকরণযোগ্য বিভাগ বা দলে বিভক্ত করার প্রক্রিয়া।
- Henry Assael এ প্রসঙ্গে বলেন, বাজার বিভক্তিকরণ হচ্ছে একটি বাজারকে সমজাতীয় প্রয়োজন সম্পন্ন ভোক্তাদলে ভাগ করা এবং বাজারজাতকরণ প্রচেষ্টা দ্বারা সেসব প্রয়োজন মেটানোর কৌশল।
বাজার বিভক্তিকরণের বৈশিষ্ট্য
উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বাজার বিভক্তিকরণের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। যেমন-
১. বাজার বিভক্তিকরণে মোট বাজারকে কয়েকটি উপবিভাগে ভাগ করা যায়:
২. একই উপবিভাগের অন্তর্গত ক্রেতাদের বুচি, পছন্দ, প্রয়োজন একই রকম হয়;
৩. এতে প্রত্যেক উপবিভাগের জন্য ভিন্ন ভিন্ন বাজারজাতকরণ মিশ্রণ উন্নয়ন ও প্রয়োগ করা সহজ হয়।
ভোক্তা বাজার কি? ভোক্তার বাজারের বৈশিষ্ট্য সমূহ আলোচনা কর। |
সামগ্রিক আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাজার বিভক্তিকরণ হচ্ছে এমন একটি কৌশল বা প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে কোনো পণ্য বা দেবার অসমজাতীয় সমগ্র বাজারকে সমজাতীয় বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে কতিপয় উপবাজার বা উপবিভাগে বিভক্ত করা হয়, যাতে প্রতিষ্ঠানের সামর্থ্য অনুযায়ী এক বা একাধিক উপবিভাগ বা উপবাজারের ভোক্তাদের সর্বাধিক সন্তুষ্টি প্রদানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জন করা যায়।
বাজার বিভক্তিকরণের সুবিধা
বাজার বিভক্তিকরণের মাধ্যমে কোনো একটি পণ্য বা সেবার অসমজাতীয় সামগ্রিক বাজারকে কতিপয় সমজাতীয় বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে কতকগুলো উপবিভাগে ভাগ করা হয়। ভোক্তাদের রুচি, চাহিদা, ক্রয়ক্ষমতা প্রভৃতির সাথে সামঞ্জস্য বিধান করে বাজারজাতকরণ পরিকল্পনা গ্রহণ ও প্রতিষ্ঠানের সামর্থ্য অনুযায়ী ভোক্তাদের সর্বাধিক সুবিধা দেওয়ার জন্য বাজার বিভক্তিকরণ করা হয়। বাজার বিভক্তিকরণে একটি প্রতিষ্ঠান বিভিন্নভাবে সুবিধা/উপকার পেতে পারে। নিম্নে বাজার বিভক্তিকরণের সুবিধা/উপকারিতা/উদ্দেশ্য আলোচনা করা হলো-
১. বিক্রয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি: বাজার বিভক্তিকরণের মাধ্যমে সমজাতীয় চাহিদা, বুচি, ক্রয়ক্ষমতা সম্পন্ন ভোক্তাদের একই বাজার বিভাগে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ফলে প্রত্যেকটি উপবিভাগের ভোক্তাদের চাহিদা, পছন্দ, ক্রয়ক্ষমতা অনুযায়ী পণ্য উৎপাদন করা এবং ভোক্তাদের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বাজারজাতকরণ কৌশল গ্রহণ করা সম্ব হয়। এতে অবিভক্ত বাজার কৌশলের চেয়ে তুলনামূলকভাবে বিক্রয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
২. বাজারজাতকরণ বাজেট তৈরিতে সহায়তা: বাজার বিভক্তিকরণের পর যে এক বা একাধিক উপবিভাগ বাজারজাতকারী তার পণ্য বা সেবা বাজারজাতকরণের জন্য নির্ধারণ করে তার মোট ক্রেতার সংখ্যা, চাহিদার পরিমাণ ইত্যাদি নির্ণয় করা সম্ভব হয়। ফলে বাজারের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ ও বাজারজাতকরণ কৌশল প্রয়োগ করে নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য কী পরিমাণ মূলধন প্রয়োজন হবে এবং বাজারজাতকরণ মিশ্রণের কোন খাতে কত অর্থ বরাদ্দ করতে হবে তা বাজারজাতকারী * বুঝতে পারে। ফলে বাস্তবভিত্তিক বাজেট প্রণয়ন করা সম্ভব হয়।
৩. বাজার সুযোগ ও হুমকি বিশ্লেষণ: বাজার বিভক্তিকরণের ফলে প্রত্যেকটি উপবিভাগে কতজন ভোক্তা, তাদের ক্রয়ক্ষমতা, বাজারের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা, প্রতিযোগীর সংখ্যা, প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা, অর্থাৎ বাজারের সুযোগ ও হুমকিসমূহ চিহ্নিত করা সম্ভব হয়। ফলে বাজারজাতকারী সুযোগ ও হুমকির ভিত্তিতে বিভিন্ন উপবিভাগকে বিশ্লেষণ করে তুলনামূলক বেশি সুযোগ ও কম হুমকিসম্পন্ন বাজার বিভাগ বেছে নিতে পারে।
৪. সম্পদের দক্ষ ব্যবহার: বাজার বিভক্তিকরণের মাধ্যমে এক বা একাধিক বাজার বেছে নেয়া হয় বলে বাজারের যাবতীয় বিষয় বাজারজাতকারীর জানা থাকে। ফলে সঠিক বাজারে সঠিক কর্মসূচি প্রয়োগ করা যায়। এতে সম্পদের বাস্তবমুখী ব্যবহার হয়। যেমন- বাজারের মোট চাহিদা, প্রতিযোগীর সংখ্যা, ক্রেতাদের ক্রয় অভ্যাস ইত্যাদি জানা থাকে বলে অতিরিক্ত পণ্য উৎপাদন করে সম্পদের অপচয় করতে হয় না।
৫. সঠিক প্রসার কৌশল প্রয়োগ: যেহেতু বাজার বিভক্তিকরণের মাধ্যমে বেছে নেয়া বাজারের ক্রেতাদের শিক্ষার স্তর, ক্রয় অভ্যাস ইত্যাদি সম্পর্কে বাজারজাতকারীর ধারণা থাকে, তাই সঠিক প্রসার কৌশল প্রয়োগ করা সম্ব হয়। যেমন- এক্ষেত্রে বিজ্ঞাপন কার্যকর হবে না বিক্রয় প্রসার বা ব্যক্তিক বিক্রয়িকতা ফলপ্রসূ তা বুঝা যায়। আবার, ক্রেতাদের শিক্ষার স্তর উঁচু হলে ম্যাগাজিন, পত্রিকা, ওয়েবসাইটে বিজ্ঞাপন দেয়া যাবে। অন্যদিকে, ক্রেতারা অশিক্ষিত বা অল্পশিক্ষিত হলে টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন দেয়া শ্রেয়।
৬. ছোট প্রতিষ্ঠানের জন্য দক্ষতার সাথে কাজ করা সহজ: একটি পণ্যের সমগ্র বাজারে বাজারজাতকরণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে গেলে প্রচুর অর্থ, কর্মী ও দক্ষতার প্রয়োজন হয়। এজন্য ছোট প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সমগ্র বাজারে কাজ করা সম্ভব হয় না। এ অবস্থায় ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো বাজার বিভক্তিকরণ করে সামর্থ্য অনুযায়ী এক বা একাধিক বাজার বিভাগ বেছে নিয়ে স্বহ ‘ সম্পদের সাহায্যে দক্ষতার সাথে কাজ করতে পারে।
৭. বাজার সুযোগ বৃদ্ধি: বাজার বিভক্তিকরণের মাধ্যমে বাজারজাতকারী তার অভীষ্ট বাজারের ভোক্তাদের কাছাকাছি অবস্থান করে। এতে তার পক্ষে প্রতিনিয়ত ভোক্তাদের চাহিদা, পছন্দ, ক্রয়ক্রয়তা, ক্রয় অভ্যাস পর্যবেক্ষণ করা সম্ব হয়। এসব ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন চোখে পড়লে সে দ্রুত পরিবর্তনের সাথে নিজের কৌশলকে খাপ খাওয়াতে পারে।
৮. আধুনিক বাজারজাতকরণ মতবাদের প্রয়োগ: আধুনিক বাজারজাতকরণ মতবাদের মূল বক্তব্য হচ্ছে ভোক্তার সন্তুষ্টির মাধ্যমে মুনাফা অর্জন। ভোক্তার সন্তুষ্টি বিধান করতে হলে ভোক্তাদের পছন্দ, প্রয়োজন চিহ্নিত করতে হবে। বাজার বিভক্তিকরণে যেহেতু সমজাতীয় বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ক্রেতাদের আলাদাভাবে ভাগ করা হয়, তাই প্রত্যেক উপবাজারের প্রয়োজন, পছন্দ সঠিকভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব হয়। আর এভাবেই ভোক্তাদের সন্তুষ্টি বিধান করে আধুনিক বাজারজাতকরণ মতবাদের প্রয়োগ করা সম্ভব।
৯. অলাভজনক বাজার বিভাগ পরিহার: বাজার বিভক্তিকরণ করা হলো কোন বাজার বিভাগটি লাভজন, কোনটি অলাভজনক তা চিহ্নিত করা সম্ভব হয়। এতে বাজারজাতকারী অলাভজনক বাজার বিভাগ পরিহার করে লাভজনক বিভাগে অধিক মনোযোগ দিতে পারে যা তার সামগ্রিক কর্মকান্ডে দক্ষতা বৃদ্ধি করে। বাজার বিভক্তিকরণ করা না হলে প্রতিষ্ঠানের লোকসান হলেও ঠিক কোন বিভাগের জন্য লোকসান হচ্ছে তা চিহ্নিত করা যায় না।
১০. সঠিক পণ্য উন্নয়ন: বাজার বিভক্তিকরণের মাধ্যমে যেহেতু ভোক্তাদের চাহিদা, ক্রয়ক্ষমতা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব হয়, তাই এক্ষেত্রে চাহিদা, ক্রয়ক্ষমতার সাথে সামঞ্জস্য বিধান করে সঠিক পণ্য উন্নয়ন করা সম্ভব হয়। যেমন- একটি কোম্পানি যদি রিকশা চালকদের অভীষ্ট বাজার হিসেবে বেছে নেয়, তাহলে তাদের ক্রয়ক্ষমতা বিবেচনা করে সে ছোট ও কমদামি টুথপেস্ট বা টুথ পাউডার তৈরি করবে। এতে তার উৎপাদিত পণ্য অবিক্রীত থাকার সম্ভাবনা কমে যায়।
ভোক্তা বাজার কি? ভোক্তার বাজারের বৈশিষ্ট্য সমূহ আলোচনা কর। |
১১. বাজারজাতকরণ গবেষণা পরিচালনা সহজ: বাজারের আয়তন যত বড় বাজারজাতকরণ গবেষণা পরিচালনা তত জটিল, ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ হয়। বাজার বিভক্তিকরণের মাধ্যমে যেহেতু বাজারের ছোট অংশকে অভীষ্ট হিসেবে বেছে নেয়া হয়, তাই বাজারজাতকরণ গবেষণা পরিচালনা করা সহজ হয়। আয়তন ছোট হওয়ায় গবেষণালব্ধ ফলাফলের সঠিকতার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
১২. নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা: একটি প্রতিষ্ঠানের সমগ্র বাজার নিয়ন্ত্রণ করা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না। বাজার বিভক্তিকরণ করে প্রতিষ্ঠান তার সামর্থ্য ও দক্ষতা অনুযায়ী এক বা একাধিক বাজার বিভাগ বেছে নিয়ে তাতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
১৩. ভোক্তাদের সন্তুষ্টি বিধান: বাজার বিভক্তিকরণের মাধ্যমে নির্বাচিত এক বা একাধিক বাজার বিভাগের ভোক্তাদের রুচি, পছন্দ, চাহিদা, ক্ষয়ক্ষমতা অনুসারে বাজারজাতকরণ মিশ্রণ উন্নয়ন করা যায়। এতে ভোক্তারা সন্তুষ্ট হয়। এছাড়া ভোক্তাদের সন্তুষ্টি বৃদ্ধির জন্য ছোট বাজার বিভাগে গবেষণা চালিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়।
১৪. সম্পর্ক স্থাপন: আধুনিক বাজারজাতকরণে ভোক্তাদের সাথে দীর্ঘমেয়াদি লাভজনক সম্পর্ক তৈরির উপর গুরুত্ব দেয়া হয়। বৃহৎ বাজারের ভোক্তাদের সাথে গভীর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ব হয় না। ছোট বাজার বিভাগ সম্পর্ক স্থাপন ও উন্নয়নের খুবই সহায়ক। প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি ও পরিবর্তনশীল পরিবেশের কারণে বাজার বিভক্তিকরণ ছাড়া সমগ্র বাজারের জন্য বাজারজাতকরণ কর্মসূচি প্রণয়ন চোখ বাঁধা অবস্থায় গুলি ছোড়ার মতোই ব্যাপার। তাই প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশে দক্ষতার সাথে কাজ করতে হলে বাজারজাতকরণ ব্যবস্থাপনাকে অবশ্যই তার সমগ্র বাজারকে বিভিন্ন উপবিভাগে ভাগ করে অভীষ্ট বাজার বেছে নিতে হবে।