মুজিবনগর সরকারের অধীনে আঞ্চলিক প্রশাসনসহ বিভিন্ন বিভাগীয় কার্যক্রম চালু ছিল। যার ভিত্তি ছিল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং মূল লক্ষ্য ছিল যুদ্ধে নিয়োজিত সেক্টর কমান্ড ও মুক্তিবাহিনীকে সর্বাত্মক সাহায্য সহযোগিতা করা। এ লক্ষ্যে ১১টি সেক্টরের সাথে ১১টি জোনাল কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ কাউন্সিলগুলোতে নির্দিষ্ট এলাকার নির্বাচিত এমএনএ/এমপিএ এবং অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সদস্য হিসেবে ছিলেন। তাঁদের মধ্য থেকেই আবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়। এ কাউন্সিলকে প্রশাসনিক সাহায্য দেওয়ার জন্য একজন করে জোনাল এডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার নিয়োগ দেওয়া হয়। আঞ্চলিক প্রশাসকগণ প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রত্যেক আঞ্চলিক চেয়ারম্যান তাঁর অধীনস্থ রাজনৈতিক এলাকার সুষ্ঠু সমন্বয়ের জন্য উপঅঞ্চলে উপদেষ্টা বা উপ-আঞ্চলিক চেয়ারম্যান নিয়োগ করার অধিকারী ছিলেন। এটি সম্পূর্ণভাবে স্থানীয় ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচিত ছিল।
মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা
মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। মুজিবনগর সরকারের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গুলো নিম্নরূপ:
১. প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ছিলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী। প্রধান সেনাপতি ছিলেন কর্নেল এম.এ.জি. ওসমানী, সেনাপ্রধান ছিলেন লে. কর্নেল আবদুর রব, উপ-প্রধান ও বিমান বাহিনীর প্রধান ছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ.কে. খন্দকার। মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয় এবং পরবর্তী সময়ে তিনটি ব্রিগেড গঠিত হয়। এ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমেই সার্বিক মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে।
আরও দেখুন: মুজিবনগর সরকার সম্পর্কে সংক্ষেপে লিখ
২. পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
খন্দকার মেশতাক আহমদ ছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী। এ মন্ত্রণালয়ের কাজ ছিল বিদেশে মিশন স্থাপন, বিদেশে কূটনৈতিক তৎপরতা পরিচালনা করা। এ মন্ত্রণালয়ের তৎপরতার কারণেই প্রবাসী বাঙালিরা সংঘবদ্ধ হয়। যার ফলে বিদেশেও মুক্তিযুদ্ধের স্ব-পক্ষে জনমত গড়ে ওঠে।
৩. স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে একজন পূর্ণ সচিব নিযুক্ত ছিল, এ মন্ত্রণালয়ের প্রধান কাজ ছিল তথ্য সংগ্রহ ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার নিকট সেগুলো প্রচার করা। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ৪টি রেঞ্জের জন্য ৪ জন ডিআইজি এবং প্রতিটি জেলার জন্য একজন এসপি নিয়োগ করা হয়। তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আঞ্চলিক প্রশাসনিক কাউন্সিলসমূহের দায়িত্ব পালন করতেন।
৪. সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়
পররাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রী সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় দেখাশুনা করতেন। এ বিভাগ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমস্যা সমাধানে দায়িত্ব পালন করত।
৫. অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়
বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটসমূহের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাজেট প্রণয়ন ও আয়-ব্যয়ের হিসাব সংরক্ষণ, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ও অন্যান্য উৎস থেকে সংগৃহীত সম্পদের হিসাব প্রস্তুত, বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তিবর্গকে অর্থ প্রদানের দায়িত্ব পালন ও বিধিমালা, আর্থিক শৃঙ্খলা প্রবর্তন, রাজস্ব ও শুল্ক আদায়, আর্থিক অনিয়ম তদন্তের জন্য কমিটি গঠন ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রহণ করত এ মন্ত্রণালয়।
৬. তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়
বাংলাদেশ সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক ইউনিট ছিল তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়। মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন রণাঙ্গণে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধের খবর এবং পাকবাহিনীকে হত্যা ও অত্যাচারের কাহিনী প্রচার, ব্যঙ্গ চিত্রমূলক অনুষ্ঠান ইত্যাদি প্রচারে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র সাহসী ভূমিকা পালন করে।
৭. মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয়
অভ্যন্তরীণ প্রশাসনের মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং তার অধীনে অল্পসংখ্যক কর্মকর্তা, কর্মচারীর সমন্বয়ে গঠিত হয় মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি মন্ত্রিপরিষদের নিকট পেশ করা, মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণ, আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় সাধন ইত্যাদি দায়িত্ব ছিল এ সচিবালয়ের।
৮. আঞ্চলিক প্রশাসন
আঞ্চলিক প্রশাসন সৃষ্টি মুজিবনগর সরকারের অভ্যন্তরীণ প্রশাসন ব্যবস্থার ইতিহাসে এক স্মরণীয় অধ্যায়। শরণার্থী সমস্যা, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক, সামরিক, বেসরকারি বিষয়াবলি সুষ্ঠু সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণ এই প্রশাসনিক অঞ্চলগুলোর ওপর ন্যস্ত ছিল। এছাড়া ১৮টি জেলায় ১৮জন প্রশাসনিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।
আরও দেখুন: ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের কারণ ও গুরুত্ব
১. স্বাস্থ্য ও কল্যাণ বিভাগ
প্রাথমিকভাবে একজন মহাপরিচালকের অধীনে গঠন করা হয় স্বাস্থ্য ও কল্যাণ বিভাগ। পরে মহাপরিচালককে সরকারের সচিবের মর্যাদা প্রদান করা হয়। এ বিভাগের কার্যাবলি দুটি পৃথক বাহিনীর স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা এবং বেসামরিক ক্ষেত্রে চিকিৎসা ও কল্যাণ।
১০. ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিভাগ
ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিভাগ রিলিফ কমিটির অধীনে সংগঠিত একটি বিভাগ। এ বিভাগ স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পূর্নবাসন মন্ত্রীর অধীনে কাজ করত। ত্রাণের জন্য গৃহীত আবেদনপত্র যাচাই-বাচাই করা শিক্ষকদের রিলিফের ব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয়াদি সংক্রান্ত কাজ করতেন এ বিভাগ।
১১. কৃষি বিভাগ
কৃষি বিভাগ পুরোপুরি সংগঠিত ছিল না। এ বিভাগে শুধুমাত্র একজন সচিব নিয়োগ করা হয়েছিল। সচিব মহোদয় স্বাধীন বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়নের নকশা ও পরিকল্পনা তৈরি করার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।
পরিশেষে বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রচণ্ড প্রতিকূলতার মধ্যে গঠিত বাংলাদেশ সরকার স্বল্পতম সময়ের মধ্যে একদিকে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব অন্যদিকে এক কোটির উপর শরণার্থীর জন্য ত্রাণের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়। এছাড়াও দেশের অভ্যন্তর থেকে লক্ষ লক্ষ মুক্তিপাগল ছাত্র-যুবকদের যুব প্রশিক্ষণ শিবিরে পাঠানো, স্বাধীন বাংলা বেতারের মাধ্যমে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা এবং সারাবিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি-এসবই ছিল বাংলাদেশ সরকারের অবিস্মরণীয় কীর্তি। চূড়ান্ত বিজয়ের দিন, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বা কোথাও কোথাও এর আগেই সকল জেলা প্রশাসক/পুলিশ সুপার ও অন্যান্য কর্মকর্তা স্ব-স্ব পদে যোগদান করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের শাসনভার গ্রহণ করার পূর্ব পর্যন্ত এ প্রশাসনিক কাঠামোই কার্যকর ছিল। সমকালীন ইতিহাসের বিচারে যা অতুলনীয়। বস্তুতঃ এ প্রশাসন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সাফল্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মূল দায়িত্ব পালন করেছিল। যার ফলে অতি সংক্ষিপ্ত সময়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করতে সক্ষম হয়।