সামাজিক ইতিহাসের উৎস সমূহ
“Social History is the history of society” অর্থাৎ সামাজিক ইতিহাস হচ্ছে সমাজের ইতিহাস। সমাজের সকল উপাদান থেকে অতীত সমাজ সম্পর্কে তথ্যাদি সংগ্রহ করা যায় তাকে সামাজিক ইতিহাসের উৎস বা উপাদান হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। “International Encyclopedia of Social Science” গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সামাজিক ইতিহাসের উৎস বহুমুখী। বস্তুত কোনো সমাজের ইতিহাস জানতে হলে সে সমাজের আদিম অবস্থা থেকে বর্তমান অবস্থায় উত্তোরণের সকল তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সঠিক ইতিহাসের বর্ণনা করতে হয়। আর এসব উৎস থেকেই ঐ সমাজের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়সহ সকল অবস্থা সম্পর্কে সম্মক ধারণা লাভ করা যায়। নিম্নের আলোচনায় সামাজিক ইতিহাসের উৎস বা উপাদানসমূহের বর্ণনা উপস্থাপন করা হলো:
প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার (Archeological Inovation)
ঐতিহাসিক যুগের পূর্ববর্তী সময়ে মানুষ লিখন পদ্ধতি আবিষ্কার করতে পারেনি। কাজেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষের লিখিত কোনো তথ্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষের ব্যবহৃত বিভিন্ন পাথরের অস্ত্র, গুহাচিত্র, কুমারের ঢাকা, মাটির পাত্র, জীবাশ্য প্রকৃতি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের ওপর ভিত্তি করে ইতিহাস রচিত হয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন যেগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে আবিষ্কার করা হয়েছে রাজ প্রাসাদ, মন্দির, শিলালিপি, মুদ্রা, বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি এবং এপিটাফ অন্যতম। আবিষ্কৃত নিদর্শনসমূহ থেকে সামাজিক ইতিহাস রচনার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। নিম্নে এগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হলো।
১. মুদ্রা-শিলালিপি: মুদ্রা ও শিলালিপি সমকালীন যুগের সামাজিক ইতিহাস রচনার জন্য একটি নির্ভরযোগ্য উৎস। মুদ্রার মাধ্যমে শাসকদের ব্যক্তিগত রুচি, তাদের ধর্ম এবং সম-সাময়িককালের সংস্কৃতি ও সভ্যতা সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করা যায়। এটির সাহায্যে সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি, রাজবংশের তালিকা প্রণয়ন ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলির সময়কাল নির্ণয় করা সম্ভব হয়। অনেক সময় তাম্র পত্র কিংবা শিলালিপির ওপর শাসকগণ তাদের বিভিন্ন অনুশাসন এবং অনুজ্ঞা খোদাই করে রাখতেন। এগুলোর মাধ্যমে ঐতিহাসিক তথ্য ও ঘটনাবলির সঠিক তারিখ উদ্ধার করা সম্ভব হয়।
২. স্মৃতিসৌধ ও অট্টালিকা: স্মৃতিসৌধ, অট্টালিকা ও বিভিন্ন প্রকার শিল্প নিদর্শন দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অবস্থার ওপর প্রভৃত আলোকপাত করে। এসকল নিদর্শন থেকে মানুষের শিল্পানুরাগ, রুচিবোধ ও জীবন প্রণালির ধরন সম্পর্কে অনেক ঐতিহাসিক তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়। কাজেই সামাজিক ইতিহাসের উপাদান হিসেবে স্মৃতিসৌধ ও অট্টালিকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
৩. বিভিন্ন মূর্তি-প্রতিচ্ছবি: প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে বিভিন্ন ধরনের মূর্তি এবং প্রতিচ্ছবি সামাজিক ইতিহাসের একটি বিশেষ উপাদান হিসেবে কাজ করে থাকে। মূর্তি থেকে সে যুগের মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধ ও চেতনার প্রকাশ ঘটে। তাছাড়াও বিভিন্ন প্রতিচ্ছবি সম-সাময়িক কালের মানুষের শৈল্পিক নিপুণতার আভাস পাওয়া যায়। মানুষের ক্রম বিবর্তনের ধারা এবং জীবন প্রণালি এ সকল প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
৪. হাতিয়ার ও আসবাবপত্র: বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের হাতিয়ার ও আসবাবপত্রের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়েছে। একেক সময়ের হাতিয়ার ও আসবাবপত্র দেখে একেকটা যুগকে চিহ্নিত করা হয়েছে। যেমন- প্রস্তরযুগ, লৌহ ও তাম্র যুগ ও ব্রোঞ্জ যুগ ইত্যাদি। এসব যুগের মানুষ যেসব হাতিয়ার ও আসবাবপত্র ব্যবহার করত তা নির্মিত হতো পাথর, কাঠ, জীবজন্তুর হাড়, শিং ও দাঁত এবং বিভিন্ন ধাতুর মাধ্যমে। মানবসমাজের পরিবর্তনের ইতিহাসকে জানার জন্য বিভিন্ন সময়ে ব্যবহৃত হাতিয়ার ও আসবাবপত্র একটি উল্লেখযোগ্য উপাদান বা উৎস হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।
৫. এপিটাফ (স্মৃতিফলক): স্মৃতিফলকের মাধ্যমেও মানবজীবনের বিভিন্ন চিত্র খুঁজে পাওয়া যায়। সমাজবিজ্ঞানী ব্রাউন উল্লেখ করেছেন, “স্মৃতিফলক জীবনধারার সাক্ষী। স্মৃতিফলক সমাজচিত্রের সমাজ দর্শন এবং স্মৃতিফলকের মাধ্যমেই কোনো অঞ্চল সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণা লাভ করা সম্ভব।” সেজন্যই ইতিহাসবিদগণ সামাজিক ইতিহাসের উৎস বা উপাদান হিসেবে স্মৃতিফলককে গুরুত্ব দিয়ে অনুধাবন করেছেন। এ প্রসঙ্গে মিশরীয় এপিটাফের কথা উল্লেখ করা যায়। মিশরীয় এপিটাফ বেশ বিস্তৃত আকারে লেখা হতো। যার ফলে মৃত ব্যক্তির নাম, বংশ পরিচয়, পদ মর্যাদা সব কিছু সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যেত।
আরও পড়ুন:
সামাজিক ইতিহাসের প্রকৃতি আলোচনা কর
সামাজিক ইতিহাসের পরিধি আলোচনা কর
প্রাচীন পৌরাণিক লোককাহিনি (Ancient Folklore and Myth)
সমাজ, সংস্কৃতি ও নীতিবোধের বিবর্তন ধারায় লোককাহিনির যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। বিভিন্ন জাতি তাদের লোককাহিনিকে অবলম্বন করে বিশ্বের দরবারে পরিচিতি লাভ করেছে। সমাজবিজ্ঞানী ও ঐতিহাসিকরা Folklore-কে মানবসভ্যতার ইতিহাস রচনার উপকরণ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এ প্রেক্ষিতে ঐতিহাসিক সাহিত্য সামাজিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উৎস।
প্রাচীন কালের লিখিত ও অলিখিত সাহিত্য, পৌরাণিক ও লোককাহিনির মাধ্যমে সামাজিক ইতিহাসের অনেক মূল্যবান তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ যেমন- বৌদ্ধ, ঋগবেদ, উপনিষদ, হিন্দু পুরান, মহাকাব্য ও জৈনদের ধর্মগ্রন্থ এবং বিভিন্ন ধরনের সাহিত্য সামাজিক ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য উপাদান হিসেবে কাজ করেছে।
মধ্যযুগের ইতিহাসেও আমরা লক্ষ করি শাহানামা, আলিফ লায়লা ও হাতেম তাই-এর গল্প সাহিত্যের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। তেমনিভাবে গ্রিক কবি হোমার এবং তাঁর কাব্য ইলিয়াড ও ওডেসি: দার্শনিক সক্রেটিস, প্লেটো ও কনফুসিয়াস এবং তাদের তত্ত্বাবলি সামাজিক ইতিহাসকে গতিশীল করেছেন। একইভাবে গণিতবিদ ইউক্লিড, জ্যোতির্বিদ হিপার্কাস, বৈজ্ঞানিক আর্কিমিডিস ও তাঁদের আবিষ্কার সামাজিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে অনেক রসদ জুগিয়েছে।
ভারত উপমহাদেশে রামায়ণ ও মহাভারত এবং কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র মানুষের ধর্মীয় চিন্তা-ভাবনা ও সামাজিক মূল্যবোধকে জাত করেছে। এসব কারণেই সমসাময়িককালের লোককাহিনি, পৌরাণিক কাহিনি, সাহিত্য, পুথি প্রভৃতি সামাজিক ইতিহাসের অফুরন্ত ভাণ্ডার হিসেবে কাজ করেছে।
বিদেশি পরিব্রাজকদের বিবরণী (Accounts of the Foreign travellers)
সামাজিক ইতিহাসের উৎস হিসেবে পরিব্রাজকদের বিবরণী খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যুগে যুগে বিভিন্ন পরিব্রাজক পৃথিবীকে জানবার জন্য বিভিন্ন স্থান ভ্রমণ করেছেন। এই সকল মহান ব্যক্তি পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেও তাদের ভ্রমণকাহিনি থেকে অনেক মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায় যা সামাজিক ইতিহাস রচনায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তাঁদের ভ্রমণকাহিনিতে ঐ স্থানের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনের সকল দিক পরিস্ফুটিত হয়। প্রাচীন কালের উল্লেখযোগ্য পরিব্রাজকদের মধ্যে মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের সভায় আগত গ্রীক রাষ্ট্রদূত মেগাস্থিনিশ, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের আমলে আগত চীনা পরিব্রাজক ফা-হিয়েন, হর্ষবর্ধনের আমলে আগত চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং-এর নাম উল্লেখযোগ্য। মুসলিম শাসনামলে পাক-ভারত বাংলা উপমহাদেশের সমাজ, অর্থনীতি ও প্রশাসন সম্পর্কেও কতিপয় বিদেশি পর্যটকদের বর্ণনা খুবই ঐতিহাসিক দলিল। চতুর্দশ শতকে আফ্রিকান পর্যটক ইবনে বতুতার বর্ণনায় এ অঞ্চলের ইতিহাস ও সমাজ সম্পর্কে জানতে পারা যায়। কাজেই সমাজ ইতিহাস রচনায় বিদেশি পর্যটকদের বর্ণনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে ঐতিহাসিকরা মত প্রকাশ করেছেন।
সরকারি দলিলপত্র (Government’s Record)
সমাজে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনাবলির তথ্য সরকারি অফিসসমূহে রক্ষিত থাকে। বিভিন্ন সময়ে এসকল সংরক্ষিত দলিলপত্র থেকে তদানীন্তন সমাজের প্রয়োজনীয় অনেক তথ্যই সংগ্রহ করা সম্ভব। নিঃসন্দেহে এ সকল তথ্য সামাজিক ইতিহাস রচনায় সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।
সভ্যতার ইতিহাস (History of World Civilization)
সভ্যতার উত্থান, বিকাশ ও পতনের ইতিহাস থেকে সামাজিক ইতিহাসের অনেক তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়। আদিম মানুষের জীবনপ্রণালি এবং সমাজ ও সভ্যতা, সুমেরীয় সভ্যতা, মিশরীয় সভ্যতা, গ্রিক সভ্যতা, রোমান সভ্যতা ও সিন্ধু সভ্যতাসহ বিভিন্ন সভ্যতার ইতিহাস থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের সমাজের চিত্র সঙ্কাহ করা যায়। তাই প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাসের ভাঙার থেকে সামাজিক ইতিহাসের জন্য অনেক মূল্যবান তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব।
অন্যান্য উৎস (Others Sources)
উল্লিখিত উৎসসমূহ ছাড়াও বিভিন্ন অফিসিয়াল প্রতিবেদন, সাময়িকী, সংবাদপত্র, সাহিত্যকর্ম, শিল্পকলা, দেশের আদমশুমারি, গবেষণা প্রতিবেদন, বাক্তিগত ডায়েরি ও ঐতিহাসিক চিঠিপত্র ইত্যাদি সামাজিক ইতিহাস রচনার উৎস বা উপাদান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।