জনমত গঠনের বাহন সমূহ
আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনমতের গুরুত্ব বা ভূমিকা অনস্বীকার্য। কারণ সুষ্ঠু জনমত গঠন ও প্রচারের ওপরই গণতান্ত্রিক সরকারের সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করে। কীভাবে এ জনমত গঠন করা যায় তা জানা একান্ত আবশ্যক। বস্তুত জনমত গঠনের জন্য কতকগুলো বাহন বা মাধ্যম রয়েছে। নিচে এগুলো আলোচনা করা হলো:
১. সংবাদপত্র
সংবাদপত্র জনমত গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। সংবাদপত্র শুধু যে সংবাদ পরিবেশন করে তা নয়, এটি জাতীয় সমস্যাদির ওপর মতামত ব্যক্ত করে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এটি দেশের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে শিক্ষাবিদ ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের অভিমত জনসমক্ষে তুলে ধরে জনগণকে সচেতন করে তোলে। সংবাদপত্রকে তাই সরকারের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ হতে মুক্ত থেকে সংবাদ পরিবেশন করতে হবে।
২. সভা-সমিতি
জনগণকে রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে সুষ্ঠু জনমত গঠন করার জন্য সভা-সমিতির গুরুত্ব অপরিসীম। সভা-সমিতির মাধ্যমে বিভিন্ন দলের বক্তারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাদি সম্পর্কে জনগণকে অবহিত ও সচেতন করে তোলেন। সমস্যা সমাধানের পথও বিভিন্ন বক্তাদের বক্তৃতা হতে পাওয়া যায়। তাছাড়া একদল অপর দলের দোষ-ত্রুটি বক্তৃতার মাধ্যমে তুলে ধরে সঠিক জনমত গঠনে বিশেষ সহায়তা করে।
৩. বেতার, চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন
জনমত গঠন, প্রকাশ ও বিকাশের ক্ষেত্রে বেতার, চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতার যুগে জনমত গঠনে এ সকল বাহনের গুরুত্ব বেড়েই চলেছে। বিভিন্ন প্রকার গঠনমূলক আলোচনা, চিত্র প্রদর্শনী এবং চেতনা ও আদর্শমূলক ছায়াছবি প্রদর্শনের মাধ্যমে বেতার, চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন জনমতকে প্রকাশিত ও সংগঠিত করার প্রয়াস পায়। তদুপরি বেতার ও টেলিভিশনের মাধ্যমে প্রচারিত বক্তৃতা অতি অল্প সময়ের মধ্যেই সমগ্র দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। এ বক্তৃতা হতে জনগণ দেশের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে অবগত হতে পারে। বর্তমানে এফএম রেডিও, স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলের কল্যাণে মানুষ যখনকার সংবাদ তখনই জানতে পারছে।
জনমতের সংজ্ঞা দাও | জনমত কি বা জনমত কাকে বলে |
৪. পুস্তক-পুস্তিকা ও সাহিত্য
বিভিন্ন প্রকার পুস্তক-পুস্তিকা, সাহিত্য জনমত গঠনের উত্তম বাহন বলে আধুনিককালে বিশেষভাবে স্বীকৃত। এগুলোর মাধ্যমে বিভিন্ন মতাদর্শ, নীতিমালা ও কর্মসূচি জনগণের নিকট উপস্থাপিত হয়ে থাকে। একটি শিক্ষিত ও উন্নত সমাজে এ মাধ্যম বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
৫. পরিবার
পিতামাতা ও পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের মতামত ও ধ্যান-ধারণা শিশু ও কিশোর মনকে প্রভাবিত করে। পরিবারের মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি সদস্যদের বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। এ প্রভাব ভবিষ্যতে রাজনৈতিক মতামত গঠনের ক্ষেত্রে কার্যকর হয়।
৬. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ
দেশে বিদ্যমান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ জনমত গঠনের ভিত্তিস্বরূপ। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীরা বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান লাভ করে এবং সমস্যা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করতে শিখে। এ শিক্ষা তাদের পরবর্তীকালে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। সুতরাং সুষ্ঠু, সুসংহত, নিরপেক্ষ জনমত গঠনের ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
৭. আইনসভা
আইনসভাকে জনমত গঠনের একটি উত্তম মাধ্যম বলে মনে করা হয়। আইনসভায় যে মতামত প্রকাশিত হয় তা প্রকৃতপক্ষে জনগণেরই মতামত ও চিন্তা-ভাবনা। কারণ জনপ্রতিনিধিরাই এতে দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করেন। জনগণ এ আলোচনা হতে নানাবিধ তথ্য লাভ করতে পারে এবং এ তথ্য ও আলোচনা তাদের মতামত গঠনে সাহায্য করে।
৮. রাজনৈতিক দল
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলই জনমত গঠন ও প্রচারের শ্রেষ্ঠতম বাহন বলে স্বীকৃত। বস্তুত রাজনৈতিক দলকে জনমত গঠনের শিক্ষাক্ষেত্র বলা যায়। রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রের নানাবিধ সমস্যা জনগণের সম্মুখে তুলে ধরে এবং এ সকল ব্যাপারে জনমত গড়ে তোলে। তাছাড়া রাজনৈতিক দল বিভিন্ন সভা-সমিতি এবং সংবাদপত্রের মাধ্যমে বক্তৃতা-বিবৃতি প্রদান করে এবং দলীয় পুস্তক-পত্রিকার মাধ্যমে প্রচারকার্য পরিচালনা করে জনমত গঠন করে। বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স ব্যবহারের পক্ষে জনমত গঠন করেছিল রাজনৈতিক দলগুলো।
৯. নির্বাচন
আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তাবিদগণ মনে করেন, নির্বাচনের মাধ্যমেও জনমত গঠিত হয়ে থাকে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বহুদলীয় ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকায় নির্বাচনকে ঘিরে বিভিন্ন দলের মধ্যে দলীয় আদর্শ ও কর্মসূচিভিত্তিক প্রচার ও প্রচারণা বেড়ে যায়, যা জনমত গঠনে খুবই কার্যকর ভূমিকা রাখে।
১০. প্রতিবেশী ও বন্ধুগোষ্ঠী
বয়স বাড়ার সাথে সাথে প্রতিবেশী ও বন্ধু-বান্ধবের সাথে আলাপ-আলোচনা ও তর্ক- বিতর্কের মাধ্যমে ব্যক্তি সাময়িক সমস্যা ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি সম্পর্কে মতামত গঠন করে। প্রতিবেশী ও বন্ধুগোষ্ঠীর সাথে সবাই খোলামনে ও স্বাধীনভাবে আলাপ-আলোচনা ও তর্ক-বিতর্ক করে। এভাবে পারস্পরিক মতবিনিময় ঘটে।
১১. পেশাগত সমিতি ও সংস্কৃতি গোষ্ঠী
ক্লাব, ইউনিয়ন ও অন্যান্য পেশাগত সমিতি এবং সাংস্কৃতিক সংগঠন বিভিন্ন বিষয়ে মতামত গঠনে সাহায্য করে। পেশাগত সমিতিগুলো সদস্যদের অর্থনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করে। এর ফলে সদস্যদের রাজনৈতিক চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রভাবিত হয়। তাছাড়া এসব পেশাগত সংগঠনগুলো অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে যোগাযোগ রেখে চলে। এভাবে সমিতির সদস্যদের মতামত প্রভাবিত হয়।
১২. ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা
বিভিন্ন প্রকার ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা জমায়েত এবং পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেও জনমত গঠিত ও বিকশিত হতে পারে। সুষ্ঠু, বলিষ্ঠ, সুসংহত এবং সুস্থ জনমত গঠনে এসবের গুরুত্ব অপরিসীম। যেকোনো সমাজেই ধর্ম ও নৈতিকতার প্রভাব অনস্বীকার্য। এমনকি ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রেও এর প্রভাব উপেক্ষা করা যায় না।
১৩. গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থাদি
বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থাদিও জনমত গঠনে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। কেননা গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থাদিতে এমন সব তথ্য ও তত্ত্বের সন্নিবেশ ঘটে যা পাঠককে অনেক বিষয়ে সচেতন করে তোলে। বস্তুত এ সকল গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থাদি পাঠের মাধ্যমে পাঠককে তার মতামত প্রকাশে সহায়তা করে।
১৪. পোস্টার
জনমত গঠনে পোস্টারও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশের বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তাদের মতাদর্শ সংবলিত পোস্টার শহর-বন্দর-গ্রামে দেওয়ালে লাগিয়ে দেন। ভ্রাম্যমাণ জনগণ বিভিন্ন মতাদর্শ ও জাতীয় সমস্যাদি পোস্টারের মাধ্যমে অবগত হন, যা জনমত গঠনে সহায়ক।
জনমতের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো |
১৫. দেওয়াল লিখন
বর্তমানে দেওয়াল লিখনও জনমত গঠনের অন্যতম বাহন হিসেবে কাজ করে। যেকোনো ইস্যুকে কেন্দ্র করে জনমত সৃষ্টির জন্য এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে।
১৬. ব্যঙ্গচিত্র ও কার্টুন
ব্যঙ্গচিত্র ও কার্টুন পরিবেশনার মাধ্যমে জনগণের মতামতকে প্রভাবিত করা সম্ভব। এসব কার্টুন- ও ব্যঙ্গচিত্র জনগণ অত্যন্ত আগ্রহসহকারে দেখে বলেই এগুলোর দ্বারা জনমত গঠন সম্ভব। বর্তমানে প্রায় সব ধরনের পত্র-পত্রিকায়ই ব্যঙ্গচিত্র ও কার্টুন পরিলক্ষিত হয়।
১৭. জনসংযোগ ও মতবিনিময় সভা
বর্তমানে বিভিন্ন সংগঠন ও রাজনৈতিক দল জনমত গঠনের জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জনসংযোগ ও মতবিনিময় সভার আশ্রয় গ্রহণ করছে, যা জনমত গঠনে কার্যকর ও ফলপ্রসূ বলে বর্তমানে জনপ্রিয়। সুতরাং জনসংযোগ ও মতবিনিময় সভাও জনমত গঠনের অন্যতম মাধ্যম।
১৮. পথনাটক ও গণসঙ্গীত
বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো পথনাটক প্রদর্শনের মাধ্যমে জনমত গড়ে তোলে। পাশাপাশি জনমত গঠনে গণসঙ্গীতও ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে জনমত গঠন ও মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করতে গণসঙ্গীত ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছিল।
১৯. ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম
বর্তমান তরুণ প্রজন্মের কাছে ইন্টারনেট অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি মাধ্যম। বিশেষ করে ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার, অরকুট, ইউটিউব প্রভৃতির মাধ্যমে জনমত গড়ে তোলা বর্তমান প্রেক্ষাপটে যথেষ্ট সহজসাধ্য।
২০. চাপসৃষ্টিকারী ও স্বার্থবাদী গোষ্ঠী
চাপসৃষ্টিকারী ও স্বার্থবাদী গোষ্ঠীসমূহ নিজেদের স্বার্থে জনমতকে কাজে লাগায়। তারা তাদের দাবির পক্ষে জনমত সৃষ্টির প্রয়াস পায় এবং একটা পর্যায়ে চাপ প্রয়োগ করে সরকারের কাছ থেকে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করে।
সুতরাং বলা যায়, জনমত গঠনের জন্য উপরের মাধ্যমসমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এসব মাধ্যম ব্যতীত জনমত গঠন অসম্ভব। বর্তমানে যোগাযোগ প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সাথে সাথে নতুন মাধ্যম জনমত গঠনে ব্যবহৃত হচ্ছে। জনগণ ও সরকারকে প্রভাবিত করার জন্য এসব মাধ্যমের ভূমিকা অনন্য।