পৃথিবীর উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার হলো শিল্প। দ্রুত শিল্পায়নই এসব দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করেছে।
বাংলাদেশে শিল্পায়নের সমস্যা সমূহ
শিল্পক্ষেত্রে বাংলাদেশ অত্যন্ত অনগ্রসর। কতকগুলো বাধা বা প্রতিবন্ধকতার কারণে এদেশ শিল্পক্ষেত্রে অনগ্রসর রয়েছে। নিচে বাংলাদেশের শিল্পায়নের সমস্যাগুলো আলোচনা করা হলো-
১. স্বাধীনতা-পূর্ব সরকারের অবহেলা
ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশ ছিল পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ। তখনকার কোনো সরকারই বাংলাদেশ অঞ্চলে শিল্প কারখানা গড়ে তোলার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। ফলে এদেশ শিল্পক্ষেত্রে অনগ্রসর রয়ে গেছে।
বাংলাদেশের কৃষির সমস্যা বা অনগ্রসরতার কারণ গুলো গুলো কি কি? |
২. মূলধনের অভাব
বাংলাদেশের অধিকাংশ লোক দরিদ্র। তাদের মাথাপিছু আয় কম এবং সঞ্চয় নগণ্য। ফলে তারা শিল্পোন্নতির জন্য মূলধন সরবরাহ করতে পারে না। তাই মূলধনের অপর্যাপ্ততা বাংলাদেশে শিল্পের অনগ্রসরতার অন্যতম কারণ।
৩. খনিজ সম্পদের অভাব
যে কোনো দেশের শিল্পোন্নয়নে খনিজ সম্পদের অবদান সর্বাধিক। কিন্তু বাংলাদেশ খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ নয়। গ্যাস, চুনাপাথর, কঠিন শিলা, সিলিকা প্রভৃতি খনিজ ব্যতীত অন্য কোনো খনিজ বাংলাদেশে নেই বললেই চলে। তাই খনিজ সম্পদের অভাবে এদেশের শিল্পোন্নতি ব্যাহত হচ্ছে।
৪. শক্তি সম্পদের অভাব
শক্তির প্রধান দুটি উৎস কয়লা ও খনিজ তেল বাংলাদেশে নেই বললেই চলে। এদেশে পানি-বিদ্যুৎ ও প্রাকৃতিক গ্যাস শক্তির প্রধান উৎস। তবে পর্যাপ্ত নয়। তাই শক্তি সম্পদের স্বল্পতা বাংলাদেশে শিল্পের অনগ্রসরতার অন্যতম কারণ।
৫. দক্ষ শ্রমিকের অভাব
জনবহুল দেশ হওয়া সত্ত্বেও এদেশের অধিকাংশ শ্রমিক অশিক্ষিত, অদক্ষ ও অনভিজ্ঞ। দক্ষ শ্রমিকের অভাবে বাংলাদেশের শিল্পোন্নতি ত্বরান্বিত হচ্ছে না।
৬. উদ্যোক্তার অভাব
শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য যথেষ্ট সংখ্যক উদ্যোক্তার প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে উদ্যোক্তার অভাব রয়েছে।
৭. বৈদেশিক মুদ্রার অভাব
দেশে শিল্প উন্নতির জন্য বিদেশ হতে প্রচুর পরিমাণ যন্ত্রপাতি ও কলকজা আমদানি করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষমতা সীমিত বিধায় এদেশ শিল্পোন্নয়নের জন্য বিদেশ হতে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও কলকজা আমদানি করতে পারে না।
৮. বিদেশের ওপর নির্ভরশীলতা
বাংলাদেশের বিভিন্ন শিল্পের প্রায় সকল উপকরণই বিদেশ হতে আমদানি করতে হয়। অনেক সময় নানাবিধ জটিলতায় উপকরণাদি সময়মত সঠিক পরিমাণে আমদানি সম্ভব হয় না। ফলে শিল্পোন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে।
৯. বাজারজাতকরণ সমস্যা
বাংলাদেশের শিল্প কারখানায় উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর মান খুব নিম্ন হলেও পণ্যের মূল্য খুব বেশি হয়। অধিকন্তু এদেশের জনগণের ক্রয়ক্ষমতা খুবই সীমিত। এসকল কারণে এদেশের শিল্পজাত পণ্যসামগ্রী বাজারজাতকরণে সমস্যা দেখা দেয়।
১০. শ্রমিক আন্দোলন
বাংলাদেশের শিল্প কারখানাতে শ্রমিক অসন্তোষ লেগেই আছে। ঘন ঘন শ্রমিক ধর্মঘট ও তালাবন্ধের জন্য এদেশের শিল্পের উৎপাদন তথা শিল্পোন্নতি বিঘ্নিত হচ্ছে।
১১. সুষ্ঠু সরকারি নীতির অভাব
দেশের শিল্পোন্নয়নের জন্য সুষ্ঠু সরকারি নীতি অনুসৃত হয় না বলে শিল্পায়ন ব্যাহত হচ্ছে।
১২. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা
বাংলাদেশে শিল্পের অনগ্রসরতার অন্যমত প্রধান কারণ হলো রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। ঘন ঘন সরকার পরিবর্তন হলে শিল্পোন্নয়ন হয় না।
বাংলাদেশের শিল্পায়নের সমস্যাগুলোর সমাধান
বাংলাদেশের শিল্পের সমস্যাসমূহের সমাধানের জন্য নিম্নমলিখিত উপায়গুলো অবলম্বন করা যেতে পারে-
১. মূলধন বৃদ্ধি
দেশে মূলধন বৃদ্ধির ব্যবস্থা করতে হবে। শিল্প উদ্যোক্তাগণ যাতে অল্প সুদে মূলধন পায়, সেজন্য মূলধন সরবরাহকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহে গড়ে তুলতে হবে।
২. শক্তি সম্পদ বৃদ্ধি
বাংলাদেশে শক্তি সম্পদ খুব সীমিত। তাই শক্তি সম্পদ বৃদ্ধির জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
৩. যোগাযোগ ও পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নতি
শিল্পোন্নয়নের জন্য বাংলাদেশের যোগাযোগ ও পরিবহণ ব্যবস্থা আরও উন্নতি ও সম্প্রসারিত করতে হবে।
অর্থকরী ফসল কাকে বলে? বাংলাদেশের অর্থকরী ফসল কি কি? |
৪. কৃষির উন্নতি
শিল্পের উন্নতিতে কৃষি উন্নয়নও অপরিহার্য। বাংলাদেশের অধিকাংশ শিল্পের কাঁচামাল যোগান দেয় কৃষি। তাই কৃষির উন্নতি সাধিত হলে দেশে শিল্পের প্রসার ঘটবে।
৫. দক্ষ শ্রমিক তৈরি
দেশে সুদক্ষ শ্রমিক তৈরির উদ্দেশ্যে কারিগরি শিক্ষা কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়াতে হবে। ফলে দক্ষ শ্রমিক তৈরি হবে।
৬. সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা
বাংলাদেশে উদ্যোক্তা ও মূলধনের অভাব বিদ্যমান। তাই শিল্পোন্নয়নের জন্য সরকারকেই সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে।
৭. সুষ্ঠু পরিকল্পনা
দেশে দ্রুত শিল্পোন্নয়নের জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা অপরিহার্য। সুতরাং শিল্পোন্নয়নের জন্য সরকারকে সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।
৮. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা
দেশে দ্রুত শিল্পোন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা অত্যাবশ্যক। এ উদ্দেশ্যে স্থায়ী ও শক্তিশালী সরকার গঠন করতে হবে।
৯. বেসরকারি উদ্যোক্তাগণকে উৎসাহ দান
দেশে বিভিন্ন ধরনের কলকারখানা স্থাপনের জন্য বেসরকারি উদ্যোক্তাগণকে সব ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান করতে হবে। উদ্যোক্তাদের পুঁজি বিনিয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করে এদের নিরাপত্তা বিধান করতে হবে।
১০. সুষ্ঠু করনীতি
দেশে শিল্পোন্নতির গতিবেগ বৃদ্ধিকল্পে সুষ্ঠু করনীতি ঘোষণা ও বাস্তবায়ন করা আবশ্যক। করনীতি এমন হওয়া উচিত যাতে বেসরকারি পুঁজি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত না হয়।
১১. শ্রমিক সমস্যার সমাধান
দেশে বর্তমান শ্রমিক অসন্তোষের কারণ নির্ণয়ে শ্রমিকদের সমস্যার সমাধানের মাধ্যমেও শিল্পোন্নয়ন দ্রুততর করা যায়।
উপসংহার
বাংলাদেশের শিল্পায়নের বিরাজমান সমস্যাগুলো সমাধানের মাধ্যমে দেশকে দ্রুত শিল্পায়িত করতে হলে উপরিউক্ত ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ ও পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। আর এজন্য সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়ে সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন।