Home » বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কিভাবে রক্ষা করা যায়? – বিস্তারিত আলোচনা
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কিভাবে রক্ষা যায়

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কিভাবে রক্ষা করা যায়? – বিস্তারিত আলোচনা

by Susmi
0 comment

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার উপায়

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংরক্ষণ একটি গুরুদায়িত্ব। আর এ গুরুদায়িত্ব পূরণে বেশ কিছু শর্তাবলি মানতে হয়। নিচে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার উপায় সমূহ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:

১. সুষ্ঠুভাবে বিচারকার্য সম্পাদনের জন্য উপযুক্ত বিচারপতি একান্তভাবে প্রয়োজন। দলীয় রাজনীতির উর্ধ্বে সৎ, সাহসী ও যথার্থ আইনজ্ঞ ব্যক্তিগণ বিচারপতি পদে আসীন হলে ন্যায়বিচারের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। বিচারপতি নিয়োগের ব্যাপারে প্রার্থীদের গুণগত যোগ্যতা সতর্কভাবে বিচার-বিবেচনা করা দরকার। বিচারপতিগণ অবশ্যই বিজ্ঞ, স্বাধীনচেতা ও নিরপেক্ষ হবেন। শাসন বিভাগের কোনো ব্যক্তিকে বিচারক পদে নিযুক্ত করা উচিত নয়। তেমনি বিচারপতিদেরকেও কোনো রাজনৈতিক পদে নিযুক্ত করা অনুচিত। কারণ, এ রকম পদ লাভের আশায় বিচার কার্য সম্পাদনের ক্ষেত্রে বিচারপতিগণ শাসন বিভাগের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করতে পারেন।

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলতে কি বুঝ | বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রয়োজন কেন

২. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বিচারকদের নিয়োগ পদ্ধতির ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। বিচারপতিদের সাধারণত তিনটি পদ্ধতিতে নিয়োগ করা যায়। যেমন:

ক. জনগণের মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে বিচারক নিয়োগ পদ্ধতি। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে এবং সুইজারল্যান্ডের কয়েকটি ক্যান্টনে এ পদ্ধতি প্রচলিত আছে। তবে এ পদ্ধতি বিভিন্ন দোষে দুষ্ট। অধ্যাপক লাস্কির (Prof. Laski) মতে, ‘জনগণের নির্বাচনের মাধ্যমে বিচারপতি নিয়োগ একটি নিকৃষ্ট পদ্ধতি।’ এর কারণ হলো-

  • নির্বাচনের সাফল্য যোগ্যতা অপেক্ষা জনপ্রিয়তার ওপর অধিক নির্ভরশীল।
  • জনগণের মাধ্যমে বিচারক নিয়োগের ব্যবস্থা করলে বিচারকগণ জনসমর্থন লাভের আশায় সততার চেয়ে জনগণের সন্তুষ্টি বিধানে আত্মনিয়োগ করবেন।
  • নির্বাচনে দলপ্রথার প্রভাব পড়বে।
  • বিচারপতি পদে উপযুক্ত ব্যক্তিকে নির্বাচন করার প্রয়োজনীয় বিচার-বুদ্ধি বা যোগ্যতা জনসাধারণের থাকে না।

খ. আইনসভার মাধ্যমেও বিচারপতি নিয়োগ করা যায় আইনসভার মাধ্যমে বিচারপতি নিয়োগ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে এবং সুইজারল্যান্ডের যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতে বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রচলিত আছে। লাস্কির (Laski) মতে, ‘আইনসভার মাধ্যমে বিচারক মনোনয়ন একটি অপ্রত্যাশিত ব্যবস্থা।’ এর ফলে দলীয় স্বার্থ ও আইনসভার কর্তৃত্ব প্রাধান্য পায় এবং বিচারের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়।

গ. বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই শাসন বিভাগ কর্তৃক বিচারপতি নিয়োগের পদ্ধতিটি প্রচলিত আছে। শাসন বিভাগ কর্তৃক বিচারপতি নিয়োগের পদ্ধতি বর্তমানে অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে কাম্য বিবেচিত হয়। বলা হয় যে, এভাবে বিচারপতিরা নিযুক্ত হলে রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী বা জনমতের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে ন্যায়বিচার সম্পাদন করতে পারেন। উর্ধ্বতন বিচারপতিদের সাধারণত রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত করেন। অধস্তন বিচারপতিগণ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে নিযুক্ত হন। ব্রিটেন ও কানাডায় শাসন বিভাগের মাধ্যমে বিচারপতি নিযুক্ত হন।

৩. বিচারপতিদের কার্যকালের স্থায়িত্বের ওপরও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বিশেষভাবে নির্ভরশীল। কার্যকালের স্থায়িত্ব না থাকলে নিষ্ঠার সাথে বিচারকার্য সম্পাদন করা বিচারকদের পক্ষে সম্ভব হয় না। আবার কার্যকাল স্বল্পস্থায়ী হলেও বিচারপতিদের পদের অপব্যবহারের আশঙ্কা থাকে। কার্যকাল বৃদ্ধির জন্যে বিচারপতিদের নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে সন্তুষ্ট রাখার ব্যাপারে অধিক আগ্রহী দেখা যায়। এর ফলে বিচারকার্যে অবহেলা দেখা দেয়। দুর্নীতি প্রশ্রয় পায়। বিচারপতিদের কার্যকাল স্থায়ী হলে তারা নির্ভীক ও নিরপেক্ষভাবে ন্যায়বিচার করতে পারেন।

৪. বিচারকগণের অপসারণের পদ্ধতির ওপরও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নির্ভরশীল। অকারণে বা সামান্য কারণে অপসারণের ভয় বা আশঙ্কা থাকলে বিচারকদের পক্ষে ন্যায়বিচার করা সম্ভব হয় না। তাই কোনো বিচারককে যাতে সামান্য কারণে পদচ্যুত হতে না হয় তার জন্যে উপযুক্ত ব্যবস্থা থাকা দরকার। প্রমাণিত দুর্নীতি ও গুরুতর অপরাধের অভিযোগের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট কার্যকাল শেষ হওয়ার আগেই বিচারপতিগণ পদচ্যুত হতে পারেন। এক্ষেত্রে বিশেষ পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে।

৫. বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সাথে বিচারকদের বেতন এবং ভাতারও সম্পর্ক আছে। স্বল্প বেতনভোগী বিচারপতিদের দুর্নীতিপরায়ণ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। শ্রেষ্ঠ যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে বিচারক পদে আকৃষ্ট করার জন্যে বিচারপতিদের বেতন পর্যাপ্ত হওয়া দরকার। পর্যাপ্ত বেতন ও ভাতা না দিলে কোনো অভিজ্ঞ আইনজ্ঞ বিচারক হিসেবে কাজ করতে রাজি হবেন না। তাছাড়া তাদের বেতন ও ভাতা পদমর্যাদা রক্ষার উপযোগী হওয়া বাঞ্ছনীয়।

বিচার বিভাগের ক্ষমতা ও কার্যাবলী আলোচনা কর

৬. বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য আইন ও শাসন বিভাগ থেকে তার স্বতন্ত্রীকরণ অপরিহার্য। প্রাচীনকালে রাজা বা রাজকর্মচারীরাই আইন প্রণয়ন, শাসন ও বিচারকার্য সম্পাদন করতেন। আগে শাসনকার্য ও বিচারকার্যের মধ্যে কোনো পার্থক্য করা হতো না। এ ব্যবস্থা স্বৈরাচারের সুযোগ করে দেয়। ইতিহাসে এর সমর্থন পাওয়া যায়। বর্তমানে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির আংশিক প্রয়োগ বলতে বিচার বিভাগের স্বতন্ত্রীকরণকে বোঝায়। অধ্যাপক লাস্কির মতে, ‘The independence of the judiciary is essential to freedom. In that sense, the doctrine of separation of powers enshrines a permanent truth.’ বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতা সংরক্ষণের জন্য অধিকাংশ দেশে শাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথক করা হয়েছে।

৭. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষার জন্য জনগণের সচেতনতা ও সমর্থন থাকতে হবে। প্রয়োজনবোধে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণকে শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে চাপ প্রয়োগ ও আন্দোলন করতে হবে। তাহলেই কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বিচার বিভাগের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না।

৮. বিচার বিভাগের কার্যক্রমে নিযুক্ত ব্যক্তিবর্গের যদি সামাজিক মর্যাদা উচ্চে থাকে তাহলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সহজ এবং বিচারকগণ দৃঢ়তা অবলম্বনে ব্রতী হতে পারেন।

৯. বিচার বিভাগকে আইন বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত রাখতে পারলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অর্জন করা সম্ভব। সাধারণভাবে মনে করা হয়, আইনসভার কাজ আইন প্রণয়ন করা আর বিচার বিভাগের কাজ ক্ষেত্রবিশেষে প্রচলিত আইনের প্রয়োগ নির্দেশ করা।

১০. বিচারকদের চাকরির নিরাপত্তার জন্য যথাযথ সাংবিধানিক নিশ্চয়তা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অন্যতম রক্ষাকবচ। অকারণে বা সামান্য কারণে পদচ্যুতির আশঙ্কায় বিচারকগণ ন্যায়বিচার করতে পারেন না। নিজের চাকরি রক্ষা করার জন্যেই ব্যস্ত থেকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা ভুলে যান। এতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষিত হয় না।

১১. বিচারপতিদের দৃষ্টিভঙ্গি ও শ্রেণিচেতনার ওপর বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা অনেকাংশে নির্ভরশীল। বিচারকদের সামাজিক ও পারিবারিক অবস্থান, অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত প্রেক্ষাপট, রাজনৈতিক চেতনা প্রভৃতির ছাপ তাদের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর পড়ে। বিচারকদের শ্রেণিচরিত্রের মাধ্যমে তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার, মানসিক গঠন প্রভৃতি নিয়ন্ত্রিত হয়।

১২. বিচারকদের কর্মক্ষমতা নির্ভর করে তাদের কর্ম সম্পাদনের ওপর। এ কর্ম সম্পাদনের ইচ্ছা আবার অনেকাংশে নির্ভর করে পদোন্নতির আশার ওপর। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে এক বিচারপতি দীর্ঘদিন যাবৎ পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হওয়ায় বিচারপতির আসন থেকে পদত্যাগ করেছেন যা পদোন্নতি নিয়ে বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা সম্পর্কে সচেতন মহলকে হতাশ করেছে। কাজেই বিচারকদের পদোন্নতির বিষয়টি অতি যত্নের সাথে বিবেচনা করা উচিত।

১৩. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্যে বিচারকদের পূর্ণ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ নিরাপত্তার অভাবে অনেক সময় বিচারকগণ ন্যায্য রায় প্রদান করতে ব্যর্থ হন।

১৪. বিচারকদের উচ্চতর প্রশিক্ষণ ও গবেষণার সুযোগ দিতে হবে। এতে একদিকে তারা যোগ্যতা ও দক্ষতার উৎকর্ষ সাধন করতে পারবেন। অন্যদিকে আর্থিকভাবেও লাভবান হবেন। যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্যে অন্যতম সহায়ক।

১৫. সংবিধান হলো দেশের মৌলিক আইন যা রাষ্ট্রের শাসনপ্রণালি নির্ধারণ করে। বিচারকরা লিখিত সংবিধানের ধারা অনুযায়ী রায় দিলে জনগণের মধ্যে রায় সম্পর্কে ভুল বোঝাবুঝি থাকবে না। তাই লিখিত সংবিধানও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সাথে সম্পৃক্ত।

১৬. সুরক্ষিত আদালত ভবন এবং নিরাপত্তার সাথে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রসঙ্গটি জড়িত। তাই আদালত ভবন থাকবে সুপ্রশস্ত ও সুরক্ষিত এবং সেখানে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বিরাজ করবে। ফলে বিচারকগণও তাদের কাজে স্বস্তিবোধ করতে পারবেন।

বিচার বিভাগ কি, গঠন ও বিচারক নিয়োগ পদ্ধতি

১৭. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও কর্মদক্ষতা অর্জনের জন্যে প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডব্লিও এফ উইলোবি (W. F. Willoughby) তিনটি প্রধান শর্তের কথা উল্লেখ করেছেন। যথা:

ক. বিচারের জন্য অপরাধীদের তাদের সম্মুখে আনয়ন করার অধিকার বিচারকদের থাকতে হবে।

খ. আদালতের যাবতীয় বিষয়াদির গুরুত্ব যাতে বিচারকগণ জনসাধারণকে উপলব্ধি করাতে সক্ষম হন, তার সুযোগ থাকতে হবে।

গ. বিচারপতিদের আদেশ ও রায়কে কার্যকর করার পর্যাপ্ত ক্ষমতা প্রদান করা আবশ্যক।

আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতানুসারে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংরক্ষণের ক্ষেত্রে গৃহীত ব্যবস্থা যথেষ্ট নয়। বিচারপতিগণ সাধারণত রাষ্ট্রের প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য অনুসারে পরিচালিত হয়। সে কারণে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা দেশের প্রচলিত রাজনৈতিক ব্যবস্থার কাঠামো ও চরিত্রের ওপর নির্ভরশীল। কেননা সমাজের স্বরূপ ও রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য অনুসারে আইন প্রণীত হয় এবং বিচারপতিগণ সেই আইন প্রয়োগ করেন। তবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বহুলাংশে নির্ভর করে বিচারকের চারিত্রিক মনোবল, নিরপেক্ষতা ও দৃঢ় মনোভাবের ওপর।

অতএব, উপরের আলোচনা থেকে আপনারা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কিভাবে রক্ষা করা যায় তা জানতে পারলেন। লেখাটি থেকে উপকৃত হলে অবশ্যই অন্যদের সাথেও শেয়ার করবেন।

Related Posts