Home » সভ্যতা কাকে বলে? প্রাচীন গ্রীক সভ্যতা সম্পর্কে আলোচনা কর
সভ্যতা কাকে বলে গ্রীক সভ্যতা সম্পর্কে আলোচনা

সভ্যতা কাকে বলে? প্রাচীন গ্রীক সভ্যতা সম্পর্কে আলোচনা কর

by Susmi
1 comment

সভ্যতা কাকে বলে ? 

সৃষ্টির শুরু থেকে যাযাবর মানুষের সংগ্রামী জীবন যাত্রাকে গঠনমূলক রূপ দিতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সভ্যতার উদ্ভব হয়েছিল। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক Arnold Toynbeeএর মতে পৃথিবীর ইতিহাস, বিভিন্ন কৃষ্টির ক্রম বিকাশ আর কৃষ্টির সমন্বয়ে সভ্যতার সৃষ্টি। মানব ইতিহাসের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন অঞ্চলে যে বিশেষ বিশেষ কৃষ্টির উদ্ভব হয়েছিল তাকেই সাধারণত প্রাচীন সভ্যতা বলা হয়।

মানব ইতিহাসের ক্রমবিকাশ ও বিবর্তনের সে স্তরকেই সভ্যতা গণ্য করা হয়, যখন আবিষ্কৃত হয়েছে লিখন পদ্ধতির, উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে শিল্প ও বিজ্ঞানের, উন্নতি সাধিত হয়েছে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থার। প্রাগৈতিহাসিক যুগের অবসানের মাধ্যমেই সভ্য যুগের উদ্ভব ঘটে।

খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০ অব্দ থেকে বিশ্ব সভ্যতার যাত্রা শুরু হয় বলে ধারণা করা হয়। পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া যায় মেসোপটেমিয়ার ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রীস নদী, মিশরের নীল নদ, ভারতের সিন্ধু নদ, চীনের হোয়াংহো ও  ইয়াংহো ও ইয়াং সিকিয়াং নদীর অববাহিকায়। এ সকল নদীবিধৌত অঞ্চলে নিয়মিত  পানি সরবরাহ, উর্বর ভূমি, যানবাহনের সুযোগ, মৎস্য সম্পদ, বনজ সম্পদ ইত্যাদির কারণে সভ্যতার বিকাশ সম্ভব হয়েছিল। প্রাচীন সভ্যতায় যথাক্রমে- শিরীয়, সুমেরীয়, হিব্রু, পারসিক, গ্রীক ও রোমান সভ্যতার আবির্ভাব ঘটে ও পরবর্তীতে বিলুপ্ত হয়।

গ্রীক সভ্যতার ইতিহাস

প্রাচীন গ্রীসের অধিবাসীদের গ্রীক জাতি বলা হয়। এ জাতির পূর্ব পুরুষ ছিল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষায় কথা বলা এক মেষপালক আর্য গোষ্ঠী। খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ অব্দে জনসংখ্যা তুলনামূলক ভাবে বেশি বৃদ্ধি পাওয়ায় আর্য জাতির এ বংশধরেরা তাদের আদি নিবাস দানিয়ুব নদীর তীরে অবস্থিত তৃণভূমি অঞ্চল থেকে ইজিয়ান অঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। তারা কালক্রমে ডোরীয়, আওনীয়, ইওনীয় এবং এচিত্ত নামে পরিচিত হয় এবং ইজিয়ান অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে বসতি গড়ে তোলে।

আরও পড়ুন:   রোমান সভ্যতার অবদান সম্পর্কে আলোচনা কর

মানব সভ্যতায় গ্রীকদের অবদান

প্রায় ১০০ বছর পূর্বে প্রাচীন গ্রীক জাতি সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের জ্ঞান সীমাবদ্ধ ছিল। ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কার্যের ফলে গ্রীক জাতির ইতিহাস উন্মোচিত হয়। প্রাচীন গ্রীক কবি হোমার রচিত ইলিয়াদ এবং ওডিসি দুই মহাকাব্যে বর্ণিত ঘটনাবলী অনুমান করে খনন কার্য পরিচালিত হয়। তাতে করে মহাকাব্যে বর্ণিত অনেক তথ্য যথার্থ বলে জানা যায়। নিম্নে বিশ্ব সভ্যতায় গ্রীকদের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করা হল-

১. দর্শন

গ্রীক সভ্যতা এর অন্যতম অবদান ছিল দর্শনে। পৃথিবীর সৃষ্টি, এর পরিভ্রমণ, সূর্যগ্রহণ ইত্যাদির কারণ খুঁজতে গিয়ে গ্রীসে দর্শন চর্চার সূত্রপাত ঘটে। প্রাচীন গ্রীসে কয়েকজন বিখ্যাত যুক্তিবাদী দার্শনিক ছিলেন। যুক্তিবাদী দার্শনিকদেরকে বলা হত সফিষ্ট। সুশাসক পেরিক্লিস সফিষ্টদের অনুসারী ছিলেন। সক্রেটিস ছিলেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক। অন্যায় শাসনের প্রতিবাদ, আদর্শ রাষ্ট্র, সৎ নাগরিক সম্বন্ধে তাঁর বক্তৃতা তরুণদের আকর্ষণ করে। এতে শাসক শ্রেণী ভীত হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে তরুণদের বিপথে পরিচালনার অভিযোগ আনে। অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে বিচারে তাকে হেমলক বিষচ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। সক্রেটিসের ছাত্র প্লেটো আদর্শ রাষ্ট্রের স্বাপ্নিক ছিলেন। তাঁর রচিত ”রিপাবলিকচ” গ্রন্থে আদর্শ রাষ্ট্রের ধ্যান ধারণা পাওয়া যায়। তিনি তাঁর শিক্ষক সক্রেটিসের বক্তৃতামালা নিয়ে ”ডায়ালগস অব সক্রেটিস” নামে অপর এক গ্রন্থ রচনা করেন।

২. ইতিহাস ও সাহিত্য

গ্রীকরা স্মরণীয় অবদান রেখে গেছে ইতিহাস রচনায়। প্রাচীন গ্রীক ঐতিহাসিক হেরোডোটাস-কে ইতিহাসের জনক বলা হয়। থুগিডাইডস প্রাচীন গ্রীসের একজন খ্যাতিমান ঐতিহাসিক ছিলেন। সাহিত্য ক্ষেত্রেও গ্রীকদের অসামান্য অবদান রয়েছে। অন্ধ কবি হোমারের ইলিয়াড ওডিসি মহাকাব্য বিশ্ব সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। গ্রীক জাতির ঐতিহ্য এবং বীরদের দুঃসাহসিক অভিযানের অপূর্ব বর্ণনা দেখা যায় এ দুই মহাকাব্যে। কবি গেসিয়াড, সাম্পো, পিন্ডার গ্রীক যুগের বাস্তববাদী সাহিত্যিক কবি ছিলেন। প্রাচীন সংস্কৃতির ক্ষেত্রে গ্রীকদের অন্যতম অবদান ছিল রঙ্গমঞ্চ তৈরি ও নাটক করা।

খোলা আকাশের নিচে বৃত্তাকার রঙ্গমঞ্চ প্রথম তৈরি হয়েছিল গ্রীস দেশে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত উৎসবের সময়ে মঞ্চে অভিনয় হত। গ্রীসের বিখ্যাত ও জনপ্রিয় নাট্যকার ছিলেন এসকাইলাস বা এক্সিলাস। তাঁর অন্যতম রচনা ট্রাজেডি নাটক বন্দী প্রমিথিউস্থু মহান গ্রীক নাট্যকার সফোক্লিসের আন্তিগোনে একটি উল্লেখযোগ্য ট্রাজিক নাটক ছিল। তিনি প্রায় একশতেরও বেশি নাটক রচনা করেন।

৩. অলিম্পিক খেলা

প্রাচীন বিশ্ব সভ্যতার সংস্কৃতির ক্ষেত্রে গ্রীকদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবদান অলিম্পিক খেলা প্রবর্তন। যা এখনও পৃথিবীতে প্রচলিত আছে। প্রাচীন গ্রীসে বিভিন্ন নগররাষ্ট্রের মধ্যে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি এবং ঐক্য স্থাপনের প্রচেষ্টা হিসেবে অলিম্পিক খেলা ৭৭৬ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে শুরু করা হয়। প্রতি চার বছর অন্তর গ্রীসের অলিম্পিয়া শহরে এ খেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। গ্রীসের বিভিন্ন নগররাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ ক্রীড়া কুশলীরা দৌড়, ঝাপ, মল্লযুদ্ধ, চাকতি নিক্ষেপ, বর্শা ছোঁড়া ও মুষ্টিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করত। অলিম্পিক খেলার মাসকে পবিত্র বলে মনে করা হত। এ মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ ছিল।

৪. বিজ্ঞান

বিজ্ঞান সাধনার ক্ষেত্রে গ্রীকরা উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গেছে। প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ ও পৃথিবীর জন্ম রহস্যের উদঘাটনে তারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন। এথেনীয় মহাবিজ্ঞানী ডেমোক্রিতাস প্রকৃতি বিজ্ঞান সম্বন্ধে প্রচুর গবেষণা করেছেন। আমাদের এ বিশ্ব যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অণু দ্বারা গঠিত এ ধারণা তিনিই প্রথম দিয়ে গিয়েছিলেন। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকের গ্রীক পনি্‌ডত এরিস্টটল সর্ব বিষয়ে অসাধারণ পান্ডিত্যের পরিচয় দিয়ে গেছেন। গ্রীক গণিতবিদ পীথাগোরাস খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন।

৫. ভাস্কর্য, স্থাপত্য ও শিল্পকলা

স্থাপত্য ও ভাস্কর্যে গ্রীকরা অপূর্ব শিল্প নৈপূণ্য ও দক্ষতার চিহ্ন রেখে গেছেন। মন্দির ও প্রস্তর মূর্তি নির্মাণে, পুস্পাধারে অঙ্কিত চিত্র কলায় গ্রীকদের অসাধারণ প্রতিভার বিকাশ লাভ ঘটে। অপূর্ব কারুকার্যমন্ডিত স্তম্ভের ওপর তারা প্রাসাদ নির্মাণ করত। এথেন্সের পার্থেনয় মন্দির তাদের স্থাপত্যের উৎকৃষ্ট নিদর্শন। দেব-দেবী, বীর ও সমকালীন লোকজনের মূর্তি গ্রীক ভাস্করগণ এমনভাবে তৈরি করতেন যে তাতে অপূর্ব সৌন্দর্য ফুটে উঠত। ফিদিয়াস, মাইরন, প্রাকসিটেলেস খ্যাতিমান ভাস্কর ছিলেন।

৬. শিক্ষা ও সঙ্গীত

হোমারীয় যুগের শেষভাগে ফিনিসীয়দের লিপির সাথে গ্রীকদের পরিচয় ‍ঘটে। ব্যঞ্জন বর্ণের সাথে স্বরবর্ণ যুক্ত করে গ্রীকরা মোট ২৪টি অক্ষরের বর্ণমালা উদ্ভাবন করে। গ্রীকরা পাপিরাসের ওপর এবং মাটির পেণ্ঢটে লিখত। গ্রীকের অধিবাসীগণ বই পড়া খুব ভালবাসত। গ্রীকবাসীর সন্তানেরা সাত বছর বয়স থেকে পাঠশালায় যাওয়া আসা করত। কৃষক ও কারিগরের সন্তানেরা প্রাথমিক শিক্ষা পেত। দাসদের ছেলেদের জন্য বিদ্যালয়ের দ্বার বন্ধ ছিল। ছবি আঁকা, নাচ গান এবং লিরা বাদ্যযন্ত্র বাজানো শেখানো হত তরুণদের। ধর্মীয় উৎসবে গান গাওয়ার প্রয়োজনে গ্রীকদের সঙ্গীতের বিকাশ ঘটে এবং বাদ্যযন্ত্র নির্মাণে তারা দক্ষ হয়ে উঠে। মানব সভ্যতার ক্রম-বিকাশে গ্রীক সভ্যতা দর্শন, ইতিহাস ও সাহিত্য, বিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞান, ভাস্কর্য স্থাপত্য ও শিল্পকলা এবং শিক্ষা সঙ্গীতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছে।

Related Posts

1 comment

রেনেসাঁ কি? রেনেসাঁর কারণ গুলো কি কি? November 25, 2023 - 2:22 pm

[…] আরও পড়ুন:   সভ্যতা কাকে বলে? প্রাচীন গ্রীক সভ্যতা … […]

Comments are closed.