প্রতিষ্ঠানের কার্য সাধনে সমন্বয় একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর অভাবে প্রতিষ্ঠান তার লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হতে পারে। আজ জানবো, সমন্বয় কাকে বলে বা সমন্বয় কি এবং সমন্বয়ের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা।
সমন্বয় কাকে বলে ?
সমন্বয়ের অর্থ হচ্ছে সংযোগ, বণ্টন এবং সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা। অর্থাৎ কাজের বিভিন্ন অংশর মধ্যে সংযোগ বিধানের প্রক্রিয়াকে সমন্বয় বলা হয়। সমন্বয় হলো, একই লক্ষ্য অর্জনে নিয়োজিত বিভিন্ন ব্যক্তিদের মধ্যে সমঝোতা ও সহযোগিতার মনোভাব সৃষ্টি করে তাদের সম্পাদিত কর্মকাণ্ডের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের প্রক্রিয়া।
অন্যভাবে বলা যায়, প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্যার্জনের নিমিত্তে প্রতিষ্ঠানের নিয়োজিত বিভিন্ন ব্যক্তি ও বিভাগের প্রচেষ্টাবলিকে একস্থানে গ্রথিত, সংযুক্ত ও সুসংহত করার প্রক্রিয়াকে সমন্বয় বলে।
এছাড়া সমন্বয় কাকে বলে সে সম্পর্কে অনেক বিশেষজ্ঞ অনেক সংজ্ঞা দিয়েছেন। তাদের মধ্যে দুটি নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
Prof. G. R. Terry-এর মতে, “সমন্বয় হচ্ছে প্রতিষ্ঠানে ঐ সকল কার্যের সমষ্টি যা শান্তিপূর্ণ ও ঐক্যবদ্ধ উপায়ে উদ্দেশ্য অর্জনের নিমিত্তে প্রয়োজনীয় অর্থ, সময় এবং সঠিক নির্দেশনার ব্যবস্থা করে।”
Dalton E. Mc Farland-এর মতে, “সমন্বয় এমন একটি প্রক্রিয়া যেক্ষেত্রে নির্বাহী তার অধস্তনদের দলীয় প্রচেষ্টার সুশৃঙ্খলা ও নিয়মতান্ত্রিক ধাঁচ বা প্যাটার্ন সৃষ্টি করেন এবং কার্যাদির মধ্যে ঐক্য ও ভারসাম্য আনয়ন করেন।”
মোটকথা, প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য এর বিভিন্ন বিভাগ, উপবিভাগ ও সকল ব্যক্তিক প্রচেষ্টাকে ঐক্যবদ্ধ ও সংহত করে দলীয় প্রচেষ্টা জোরদার ও শৃঙ্খলা বিধানের কাজকেই সমন্বয় বলে।
সমন্বয়ের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত প্রতিটি কর্মীর কার্য স্পৃহা বৃদ্ধি করে দলীয় ঐক্য ও পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সমন্বয় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। তাছাড়া সমন্বয় কর্মসূচী কোন প্রতিষ্ঠান গ্রহণ করলে কর্মীদের মনোবল উন্নত হয় এবং স্বেচ্ছা প্রণোদিতভাবে কার্যসম্পাদনে তৎপর থাকে। নিচে প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমন্বয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা উপস্থাপন করা হলো-
১. কাজের মধ্যে একতা বিধান
বৃহদায়তন ও প্রযুক্তি নির্ভর কারবারি পরিবেশে বর্তমানে শ্রমবিভাগের মাধ্যমে উৎপাদনের বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়। তাই শ্রমবিভাগের আওতায় শিল্প-কারখানায় হাজার হাজার শ্রমিক কাজ করতে দেখা যায়। কিন্তু প্রতিটি শ্রমিকের কাজের মধ্যে পারস্পরিক সংহতি, ঐক্য ও ভারসাম্য আনয়ন করা না গেলে প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করা অসম্ভবপর হয়ে পড়বে। এমতাবস্থায় সমন্বয় কর্মসূচী গ্রহণ করে প্রতিষ্ঠান সহজে পারস্পরিক ঐক্য, সংহতি ও ভারসাম্য আনয়নের পথ সহজতর করতে পারে। ফলে প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সফলতার সাথে উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করা সম্ভবপর হয়।
২. মনোবল উন্নয়ন
সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের শৃঙখলাবোধ তৈরি হয়। ফলে কোন শ্রমিক-কর্মী বিশৃংখলা পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে না। তাছাড়া এক্ষেত্রে প্রত্যেকে সু-শৃঙ্খলভাবে কাজ করে দলীয় মর্যাদা রক্ষা করতে উৎসাহ বোধ করে। এতে কর্মীদের মনোবল বৃদ্ধি পায়।
আরও পড়ুন: নেতৃত্ব কি? ব্যবস্থাপনায় নেতৃত্বের গুরুত্ব আলোচনা কর।
৩. কাজের গুণগতমান বৃদ্ধি
সমন্বয়ের আওতায় প্রতিষ্ঠানে সু-শৃঙ্খল পরিবেশ বিরাজ করে। এরূপ সু-শৃঙ্খল পরিবেশে প্রতিটি কর্মী তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব দক্ষতার সাথে সম্পাদন করতে সক্ষম হয়। ফলে কাজের গুণগতমান বৃদ্ধি পায়।
৪. মতবিরোধের অবসান
পারস্পরিক মতবিরোধ ও মতানৈক্যের অবসান ঘটিয়ে সমঝোতার ভিত্তিতে প্রতিটি কর্মীর উপর অর্পিত দায়িত্ব সম্পাদন করা সমন্বয়ের অন্যতম নীতি। তাই কোন প্রতিষ্ঠানে সমন্বয় কর্মসূচী গ্রহণ করা হলে কর্মীদিগকে এরূপ নীতির আওতায় কার্যাবলি সম্পাদন করতে হয়। ফলে প্রত্যেকেই সহযোগিতামূলক মনোভাব নিয়ে কার্যাবলি সম্পাদন করে। এতে পারস্পরিক মতবিরোধ, দ্বন্দ্ব ওমতানৈক্যের অবসান ঘটে।
৫. দক্ষতার সাথে কার্যসম্পাদন
সমন্বয়ের ফলে প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত প্রত্যেকটি কর্মীকে তার উপর অর্পিত দায়িত্ব-কর্তব্য নির্দিষ্ট সময়ে সম্পাদন করতে হয়। ফলে কার্যসম্পাদনে কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।
৬. আদর্শ কর্মী সৃষ্টি
সমন্বয়ের ফলে প্রতিষ্ঠানের সু-শৃঙ্খল পরিবেশ বিরাজ করে। এতে প্রত্যেকটি কর্মী স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠানের প্রতি সেবা প্রদান করতে উদ্বুদ্ধ হয। তাছাড়া দক্ষ ও আদর্শবান কর্মী শৃঙ্খলার সাথে সম্মানিত পরিবেশে কাজ করতে পছন্দ করে। অধিকন্তু এরূপ পরিস্থিতিতে শ্রম ঘূর্ণায়মানতার হারও হ্রাস পায়। ফলে আদর্শ কর্মী সৃষ্টি করা সম্ভবপর হয়।
৭. উত্তম কার্য পরিবেশ সৃষ্টি
সমন্বয় কারবার প্রতিষ্ঠান কিংবা শিল্প কারখানায় মতবিরোধ, অসমতা, অসংহতি ও বিশৃঙ্খলা দূর করে। ফলে প্রতিষ্ঠানে উত্তম, সু-শৃঙ্খল ও নিয়মতান্ত্রিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
৮. ব্যয় হ্রাস
সমন্বয়ের ফলশ্রুতিতে সৃষ্ট উত্তম কার্য পরিবেশ কর্মীদের মনোবল উন্নয়ন ও দক্ষতা বৃদ্ধি করে। ফলে প্রতিষ্ঠানের সকল কাজকর্ম মিতব্যয়িতার সাথে সম্পাদিত হয়। তাছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে অবাঞ্ছিত অপচয় সমন্বয় দূরীভূত করে। এতে সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা ব্যয় হ্রাস পায়।
৯. ব্যবস্থাপনার অন্যান্য কাজে সহযোগিতা
অনেক বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি সমন্বয়কে ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন কার্যসম্পাদনের চাবিকাঠি হিসেবে বর্ণনা করেন। তাদের মতে, সমন্বয় ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন কাজ যেমন- পরিকল্পনা, নির্দেশনা ও নিয়ন্ত্রণ কার্যাবলি একে অপরের সাথে শক্তিশালীভাবে সম্পর্কযুক্ত করে থাকে। এতে ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন কার্যাবলির মধ্যে সহযোগিতামূলক ভাব সৃষ্টি হয়। ফলে ব্যবস্থাপনার অন্যান্য কার্যাবলি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা সম্ভবপর হয়।
১০. একই নির্দেশ অনুসরণ
সমন্বয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন বিভাগের কাজের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই সকলে একই নির্দেশনা অনুসরণ করে একই ধারায় কাজ করতে পারে।
১১. মিতব্যয়িতা অর্জন
সমন্বয়ের ফলে কর্মীদের দক্ষতা বাড়ে। এতে প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বিভাগের অপচয় ও অপব্যয় হ্রাস পায়। ফলে মিতব্যয়িতার সাথে গুণগত মানের পণ্য উৎপাদন করা সম্ভবপর হয়।
১২. গতিশীলতা বৃদ্ধি
সমন্বয়ের ফলে কর্মীদের মধ্যে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে প্রত্যেকে স্বতঃস্ফূর্ত কর্মস্পৃহা নিয়ে কাজ করে। ফলে প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বিভাগের কাজের মধ্যে গতি সঞ্চারিত হয়।
১৩. সামগ্রিক উদ্দেশ্যার্জন
বিভিন্ন বিভাগ বা শাখায় নিয়োজিত প্রত্যেকের কাজের গড়িমিল সমন্বয় অপসারণ করে। এতে প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্যের দিকে সকলের প্রচেষ্টা পরিচালিত হয়। ফলে সাফল্যের সাথে উদ্দেশ্যার্জন করা সম্ভবপর হয়।
অতএব, উল্লেখিত আলোচনা প্রেক্ষিতে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, কোন প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য সফলতার সাথে বাস্তবায়নের নেপথ্যে সমন্বয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কেননা প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত প্রতিটি কর্মীর দায়িত্ব এবং বিভিন্ন বিভাগের কার্যাবলির মধ্যে সমন্বয় সেতুবন্ধন রচনা করে। ফলে সকল বিভাগ ও বিভাগের কার্যাবলির মধ্যে ঐক্য ও সংহতি স্থাপনপূর্বক প্রতিষ্ঠান কাংখিত লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হয়।
আশা করি সমন্বয় কাকে বলে এবং সমন্বয় কেন গুরুত্বপূর্ণ সে সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পেরেছেন। এরকম আরও বিভিন্ন লেখা পেতে ব্লগটির সাথেই থাকুন।
ব্লগের ফেসবুক পেজ: Gurugriho – গুরুগৃহ