১৯৬৯ সালের গণঅভ্যূত্থান
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাংলার জনগণ নিগৃহীত হতে শুরু করে। পাকিস্তান সরকার লাহোর প্রস্তাবকে পাশ কাটিয়ে বাংলার জনগণের ইচ্ছাকে দমিয়ে বাংলাকে উপনিবেশে পরিণত করে। ১৯৫৬ সালের সংবিধান পূর্ব বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তান নাম দেয়। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে ও ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে মৌলিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৬২ সালের সংবিধানে সংসদীয় গণতন্ত্রকে উচ্ছেদ করা হয়। সংবিধানে প্রেসিডেন্ট হিসেবে আইয়ুব খানকে অপ্রতিহত ক্ষমতা প্রদান করা হয়। বাঙালি ১১ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আইয়ুব খানের বৈষম্য নীতির বিরুদ্ধে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাস থেকে গণআন্দোলন শুরু হয়। সর্বস্তরের মানুষের গণ আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়।
আরও দেখুন: ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা কর।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের কারণ
১. সামরিক শাসন
১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক আইন জারি করে গণতান্ত্রিক পথ রুদ্ধ করেছিলেন। তিনি বিভিন্ন অধ্যাদেশের মাধ্যমে রাজনীতি ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করেছিলেন। PODO, EBDO-র মাধ্যমে রাজনীতিবিদদের ও অন্যান্য উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের কারারুদ্ধ করে সকল প্রকার আন্দোলন বন্ধ করতে ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন। বাংলা ভাষা, বাংলা বর্ণ, রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীত ইত্যাদির উপর আঘাত হেনে বাংলাকে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ কোনো দিনই এ অন্যায় আচরণ মেনে নেয়নি।
২. মৌলিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা
সার্বজনীন ভোটাধিকারের পরিবর্তে মৌলিক গণতন্ত্রীদের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন হয় না। এর ফলে মৌলিক গণতন্ত্রীদের ক্ষমতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং জনগণের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এমতাবস্থায় সর্বত্র জনগণ পরিবর্তনের জন্য সোচ্চার হয় এবং জনগণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ গণঅভ্যুত্থান ঘটায়।
৩. সকল স্তরে বৈষম্যনীতি
আইয়ুব সরকারের উন্নয়নের দশক দুই অঞ্চলের বৈষম্যনীতি দেশি-বিদেশি বিশিষ্ট জনের কাছে প্রকট হয়ে ধরা পড়ে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সূচনা থেকেই এই বৈষম্য চলতে থাকে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের সময় রাজধানী ছিল করাচী। তার উন্নয়নের জন্য ব্যয় করা হয়েছিল ২০০ কোটি টাকা। আইয়ুব সরকার রাজধানী স্থানান্তর করেন ইসলামাবাদে। তার উন্নয়নের জন্য ব্যয় করা হয়েছিল ২০ কোটি টাকা। আর পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাজধানী ঢাকার উন্নয়নের জন্য ২ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছিল। শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য বজায় ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানে এত বেশি সংখ্যক স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, ছাত্রসংখ্যা ২০ বছরে (১৯৪৭-৪৮-১৯৬৮-৬৯) প্রায় ত্রিশ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং পূর্ব পাকিস্তানে বৃদ্ধি পেয়েছিল পাঁচ গুণ। অথচ ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসংখ্যা পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বিগুণ ছিল। কৃষি, চিকিৎসা, বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা কেন্দ্রের ১৬টির মধ্যে ১৩টি পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল। বিদেশে অধ্যয়ন ও প্রশিক্ষণের জন্য যে বৃত্তি দেওয়া হতো তার অধিকাংশ পশ্চিম পাকিস্তানিদের জন্য বরাদ্দ ছিল। চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রেও উভয় অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য ছিল।
সম্পদ পাচারের ক্ষেত্রে ১৯৪৮-১৯৬৯ সাল পর্যন্ত ২১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানে উৎপন্ন পণ্যের বাজার ছিল পূর্ব পাকিস্তান। এভাবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সকল ক্ষেত্রে যে বিরাট বৈষম্য সৃষ্টি করেছিলতা পূর্ব পাকিস্তানিদের সরকার বিরোধী আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
আরও দেখুন: ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলনের গুরুত্ব | বাঙালির মুক্তির সনদ
৪. স্বায়ত্তশাসনের দাবি
১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ চলাকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারে পাকিস্তান সরকার যে ঔদাসীন্য দেখিয়েছিল তার ফলশ্রুতিতেই স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপিত হয়েছিল। ৬-দফা দাবিতে স্বায়ত্তশাসন আর যেসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল তা মেনে নিলে পাকিস্তান সরকারের ক্ষমতা সঙ্কুচিত হয়ে যায়। কিন্তু এ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সৃষ্টি হয়।
৫. আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা
১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলনের কারণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আটককৃত অবস্থায় আবার ১৯৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁকে ১ নম্বর আসামি হিসেবে মামলা করা হয়। এমতাবস্থায় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ অচিরেই সরকারের দুরভিসন্ধি সম্পর্কে অবগত হয়। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী এ মামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। হরতাল, বিক্ষোভ, আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানকে উত্তাল করে তোলে।
৬. আসাদুজ্জামান, সার্জেন্ট জহরুল হক ও শামসুজ্জোহার মৃত্যু
১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে আসাদুজ্জামান নামে ছাত্র ইউনিয়ন নেতার মৃত্যু হলে আন্দোলন প্রকট আকার ধারণ করে ও সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তারপর ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে আগরতলা মামলার আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে হত্যা করা হলে আন্দোলনের ব্যাপ্তি ও তীব্রতা বেড়ে যায়। এরপর ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা সেনাবাহিনীর বেয়নেট চার্জে মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাস থেকে আন্দোলনের গতি বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং পাকিস্তান সরকার নির্যাতন, নিপীড়নের মাধ্যমে আন্দোলন রুদ্ধ করতে যেয়ে তার গতি আরো তীব্র করে তোলে। ফলে গণঅভ্যুত্থান ছিল অনিবার্য।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এর গুরুত্ব
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ছিল আমাদের স্বাধিকার আদায়ের চূড়ান্ত পরিণতির নিকট ধাপ। খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এ আন্দোলনের গুরুত্ব নিচে তুলে ধরা হলো:
(১) আগরতলা মামলা প্রত্যাহার
গণআন্দোলনের চাপে আইয়ুব খান ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিলাভ করলে ২৩ ফেব্রুয়ারি এক সংবর্ধনা সভায় তাঁকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
(২) ২১ ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটি
৯ ফেব্রুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ পল্টন ময়দানের জনসভায় ২১ ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটি ঘোষণার দাবি জানায় এবং ঐ দিন সকল স্থানে কালো পতাকা উত্তোলন ও দিনটি যথাযথভাবে পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। ৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ২১ ফেব্রুয়ারি ছুটি দিবস ঘোষণা করলেও সামরিক আইন জারির পর তা বাতিল করা হয়েছিল। অবশেষে পূর্ব পাকিস্তান সরকার ২১ ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী সরকারি ছুটি দিবসরূপে ঘোষণা করে।
আরও দেখুন: ৬ দফা আন্দোলন কি? ৬ দফা আন্দোলনের পটভূমি আলোচনা কর
(৩) আইয়ুব খানের পতন
গণঅভ্যুত্থানের ফলে আইয়ুব খানের পতন ঘটে। যদিও তিনি নিজের পতন ঠেকানোর জন্য পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানকে বরখাস্ত করেন, তিনি পুনরায় প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হবেন না বলে ঘোষণা দেন। তথাপি জনগণ তার প্রতি আর বিশ্বাস রাখতে পারে নি। আইয়ুব খানের পতন অনেকগুলো সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয়।
(৪) এক ইউনিট বাতিল
১৯৫৬ সালের সংবিধানে পাঞ্জাব, সিন্ধু, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তান নিয়ে যে এক ইউনিট পশ্চিম পাকিস্তান করা হয়েছিল তা বাতিল করা হয়।
(৫) নির্বাচন
অভ্যুত্থানের ফলেই জনগণ ভোটাধিকার ফিরে পায় এবং নির্বাচন অর্থবহ হয়। সর্বজনীন প্রত্যক্ষ ভোটে ১৯৭০ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
(৬) স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়
আইয়ুব খানের দমন পীড়ন বাঙালিকে স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করে। জাতির জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে ছিল এবং তারা ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচন পরবর্তী ঘটনাগুলোকে একযোগে প্রতিরোধ করে বাংলাকে মুক্ত করে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছিল।
সর্বোপরি বলা যায়, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের ফলে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক শোষণ ও বঞ্চনা থেকে বাঙালি জাতির মুক্তির পথ রচিত হয়। এ আন্দোলনকে আইয়ুব সরকার দমন করতে চেয়েছিলেন কিন্তু ততদিনে সরকারের ভিত নড়বড়ে হয়ে যায়। তীব্র আন্দোলনের মুখে অবশেষে পাকিস্তানের লৌহ মানব খ্যাত আইয়ুব খানের পতন ঘটে। এ আন্দোলনের মাধ্যমেই পূর্ব বাংলার জনগণ নিজেদের স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে সংগ্রাম করে এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটায়।