Home » ন্যায় দর্শন কি? ন্যায় দর্শনে কার্যকারণ তত্ত্ব আলোচনা কর

ন্যায় দর্শন কি? ন্যায় দর্শনে কার্যকারণ তত্ত্ব আলোচনা কর

by Susmi
0 comment

ন্যায় দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা মহর্ষি গৌতম। তাঁর আরেক নাম ছিল অক্ষপাদ। তাই ন্যায় দর্শনকে “অক্ষপাদ দর্শন “ বলা হয়। কোন কোন নিয়ম অনুসরণ করলে আমাদের চিন্তা বা তর্ক ফলপ্রদ হয় এবং কি কি উপায় অবলম্বন করলে যথাযথ জ্ঞানলাভ করা যায়, এই সকল নির্দেশ দেয় বলে “ন্যায়দর্শনকে” তর্কশাস্ত্র ন্যায়বিদ্যা বলা হয়। প্রত্যক্ষ বা শ্রুতির সাহায্যে যা জানা যায়, তার সম্পর্কে পরে মনন বা আলোচনা করার নাম অন্বীক্ষা। ন্যায় দর্শন এই অন্বীক্ষার সমাধা করে বলে এটিকে প্রমাণশাস্ত্র বলা হয়। প্রদীপ যেমন সকল বন্ধুকে আলোকিত করে, তেমনি ন্যায় দর্শন  সর্বশাস্ত্রকে নির্ভুলভাবে প্রতিভাত হতে সাহায্য করে। তাই ন্যায়দর্শনকে অনেকেই “সর্ববিদ্যার প্রদীপ” বলে অভিহিত করেছেন।

ন্যায় দর্শন

ন্যায় দর্শন বস্তুর জ্ঞান নিরপেক্ষ স্বাধীন সত্তায় বিশ্বাসী, তাই এটি বস্তুবাদী দর্শন। এটি বেদকে প্রামাণ্য বলে স্বীকার করে বলে ন্যায়দর্শনকে আস্তিক দর্শন বলা হয়৷ তবে ন্যায় দর্শন বেদকে প্রামাণ্য বলে মেনে নিলে এটির মতবাদ স্বাধীন চিন্তা বিচারের উপর প্রতিষ্ঠিত। ন্যায় দর্শনে যুক্তিতর্ক এবং জ্ঞানতত্ত্বের আলোচনা প্রাধান্য লাভ করলেও এই আলোচনা ন্যায়দর্শনের চরম উদ্দেশ্য নয়। ভারতের অন্যান্য দার্শনিক সম্প্রদায়ের মত ন্যায়দর্শন মোক্ষকে জীবনের পরম পুরুষার্থ বলে মনে করেন, এবং কিভাবে এই চরম পুরুষার্থ বা মোক্ষকে লাভ করা যায়, সেই সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করে। সুতরাং ন্যায়দর্শন কেবল তর্কশাস্ত্র এবং প্রমাণশাস্ত্র নয়, এটি মোক্ষশাস্ত্র বটে।

আরও পড়ুন:   নববৈপল্য সূত্র কি? এর সংক্ষিপ্ত বিবরন দাও।

ন্যায়দর্শনে কার্যকারণ তত্ত্ব

ন্যায়দর্শনকে বস্তুবাদী দর্শন বা জাগতিক পরিবর্তন তত্ত্ব বলা হলেও কার্যকারণ তত্ত্বই এর অপর নাম। জগতের যে সকল বস্তু বা ঘটনা উদ্ভূত হয় তার প্রত্যেকটি কারন আছে। বিনা কারনে কোন বস্তু বা ঘটনা উদ্ভূত হতে পারে না। একটির অস্তিত্ব অপরটির অস্তিত্বের উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ একটি ঘটলে অপরটি ঘটে, তবে তাদের সম্বন্ধকে কার্যকারণ সমন্ধ বলে। কার্যকারণ সূত্রে আবদ্ধ বস্তু বা ঘটনা দুইটির পূর্ববর্তীকে বলা হয় কারণ এবং পরবর্তীটিকে বলা হয় কার্য। যেমন, মশার কামড়ের পর ম্যালেরিয়া রোগ দেখা দিল। এখানে মশার কামড় হল কারণ এবং ম্যালেরিয়া রোগ হল কার্য। নিম্নে কার্যকারণ বাদের বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হল।

অব্যবহিত অপরিবর্তনীয়: নৈয়ায়িকদের মতে, কারণ হল অব্যবহিত, শর্তান্তরহীন, অপরিবর্তনীয় পূর্ববর্তী ঘটনা। তাঁরা বলেন কারণরূপ ঘটনা সবসময় কার্যরূপ ঘটনার আগে ঘটবে। যদিও কারণ কার্যের পূর্ববর্তী ঘটনা, তবুও যে কোন পূর্ববর্তী ঘটনা কারণ নয়। কারণ কার্যের অপরিবর্তনীয় পূর্ববর্তী ঘটনা। আবার যেকোন অপরিবর্তনীয় পূর্ববর্তী ঘটনাকে কারন বলা যায় না। যেমনদিন রাত্রীর অপরিবর্তনীয় পূর্ববর্তী ঘটনা হলেও দিনকে রাত্রির কারণ বলা যায় না।  সুতরাং যে অপরিবর্তনীয় পূর্ববর্তী ঘটনা শর্তান্তরহীন কেবল তাকেই কারণরূপে গণ্য করা হয়।

বহুকারণবাদ অস্বীকার: নৈয়ায়িকগন বহু কারণবাদ স্বীকার করে না। বহু কারণবাদের অর্থ হল, একই কার্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন কারণের দ্বারা উৎপন্ন হতে পারে। কিন্তু নৈয়ায়িকেরা বলেন, একই কার্য বিভিন্ন কারণে উৎপন্ন হতে পারে না। তাঁদের মতে, যে কোন একটি বিশেষ কার্যের একটি মাত্র বিশেষ কারণ থাকবে। বাচস্পতি কারণকে কারণ-সামগ্রী বলেছেন। অর্থাৎ তাঁর মতে, কারণ হলো কতকগুলো শর্তের সমষ্টি। পাশ্চাত্য তর্কবিজ্ঞানী মিলও কারণকে কতকগুলো সদর্থক এবং নঞর্থক শর্তের সমষ্টি বলেছেন।

কারনের প্রকারভেদ: নৈয়ায়িকগণের মতে কারণ তিন রকমের। যথা- সমবায়ী কারণ, অসমবায়ী কারণ এবং নিমিত্ত কারণ।

সমবায়ী কারণ: যে বস্তুর দ্বারা কার্য উৎপন্ন হয় তাই সমবায়ী কারণ। যেমন বস্ত্ররূপ কার্যের সমবায়ী কারণ হল সূত্র। কেননা সূত্র ছাড়া বস্ত্র থাকতে পারে না।

অসমবায়ী কারণ: অসমবায়ী কারন হল উপাদানের সংযোগ। যেমন বস্ত্ররূপ কার্যের সূত্রের সংযোগ হল অসমবায়ী কারণ। অসমবায়ী কারন কোন দ্রব্য নয়। এটি দ্রব্যের গুণ বা ক্রিয়া। আর যার শক্তিতে বা চেষ্টায় উপাদানের দ্বারা কার্য উৎপন্ন হয় তাকে বলা হয় নিমিত্ত কারণ। এখানে বস্ত্রের বা চেষ্টায় উপাদানের দ্বারা কার্য উৎপন্ন হয় তাকে বলা হয় নিমিত্ত কারণ। এখানে বস্ত্রের নিমিত্ত কারণ হল তন্তুবায় এবং তার তাঁত।

নৈয়ায়িকদের মতে, আরো দুই প্রকার কারন আছে। যথাসাধারণ নিমিত্ত কারণ অসাধারণ নিমিত্ত কারণ। সাধারন নির্মিত্ত কারণ সবসময় কার্যের মধ্যে উপস্থিত থাকে। সাধারণ কারণের তুলনায় কোন বিশিষ্ট কার্যের বিশিষ্ট কারণকে অসাধারণ কারণ বলা হয়

কার্য-কারণ সম্পর্ক: কার্যকারণ সম্পর্কের ব্যাপারে ভারতীয় দর্শনে দুটি মতবাদ প্রচলিত আছে। একটি হল সৎকার্যবাদ এবং অপরটি হল অসৎকার্যবাদ। সৎকার্যবাদীদের মতে, কার্য উৎপন্ন হওয়ার পূর্বে এটি উপাদান কারণের মধ্যে অব্যক্ত বা প্রচ্ছন্ন অবস্থায় বিদ্যমান থাকে। যেমন- তৈলরূপ কার্য উৎপত্তির পূর্বে তিলরূপ উপাদান কারণে নিহিত থাকে। সাংখ্য দার্শনিকগন সৎকার্যবাদকে প্রতিষ্ঠা করবার জন্য নানাবিধ যুক্তির অবতারনা করেছেন।

অসৎকার্যবাদের সমর্থক: কার্যকারণ সম্পর্কে ন্যায় দর্শনের মতবাদ অসৎকার্যবাদ নামে পরিচিত। ন্যায় দার্শনিকগণ সাংখ্যের সৎকার্যবাদের বিরোধিতা করেন। তাঁরা বলেন কার্য উৎপন্ন হওয়ার পূর্বে এটি উপাদান কারণে বিদ্যমান থাকে না। তাঁদের মতে, উপাদান কারণ হল সৎ আর কার্য হল দর্শন। ন্যায় দর্শন মতে, সৎ হতে অসৎ এর উৎপত্তি বা আরম্ভ। নৈয়ায়িকগণের মতে উৎপত্তির পূর্বে কার্যের অভাবই থাকে, কার্য উৎপন্ন হওয়ার অর্থই হল প্রাগভাব নষ্ট হওয়া। তাদের মতবাদকে আরম্ভবাদও বলা হয়। যেহেতু তাদের মতে কার্য সম্পূর্ণ নতুন সৃষ্টি বা আরম্ভ। অসৎকার্যবাদের সমর্থনে নৈয়ায়িকগন নিম্নোক্ত যুক্তিগুলো প্রদর্শন করেন।

প্রথমত, কার্য যদি উৎপত্তির পূর্বে উপাদান কারণে বিদ্যমান থাকে, তবে কার্য উৎপন্ন হল, এই কথা বলা অর্থহীন নয়। দ্বিতীয়ত, কার্য যদি উৎপত্তির পূর্বে উপাদান কারণে বিদ্যমান থাকে, তবে কার্যের উৎপত্তির জন্য “নিমিত্ত কারণের” প্রয়োজন হয় না। যেমন- মৃত্তিকার মধ্যে যদি ঘট থাকে, তবে কুম্ভকারের প্রয়োজন কি? কিন্তু সকলেই জানে, কুম্ভকার এবং তার চক্রযষ্টি ছাড়া ঘটের উৎপত্তি সম্ভব নয়।

তৃতীয়ত, কার্য উৎপন্ন হওয়ার পূর্বে যদি উপাদান কারণে বিদ্যমান থাকত, তবে কার্য উপাদান কারণের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকত না। উভয়কে একই নামে ডাকা চলত এবং উভয়েই একই প্রয়োজন মেটাতো। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। কেউ মৃত্তিকাকে ঘট বলে না এবং মৃত্তিকা দিয়ে জল পানও করে না। ঘটের সাহায্যেই জল পান করে। 

চতুর্থত, সৎকার্যবাদী সাংখ্য দার্শনিকগণও স্বীকার করেন যে, কার্য এবং কারণের মধ্যে আকারগত পার্থক্য আছে। যেমন- মৃত্তিকা এবং ঘটের একই আকার নয়, ঘটরূপ কার্যের আকার যদি মৃত্তিকারূপ কারণের মধ্যে বিদ্যমান না থাকে, তবে কার্য কারণের মধ্যে বিদ্যমান থাকে না, এই কথাই বলতে হয়। সুতরাং অসৎ কার্যবাদকে স্বীকার করাই যুক্তিযুক্ত। বৈশেষিক এবং বৌদ্ধ দার্শনিকগণও অসৎকার্যবাদকে সমর্থন করেন।

নৈয়ায়িকদের মতে কারণ এবং কার্যের ভিন্ন সত্তা আছে। তা যদি না হত তবে কারন হতে কার্যকে পৃথক করা যেত না। কিন্তু সাংখ্যকার বৈদান্তিকদের মতে কারণ কার্য অভিন্ন। মীমাংসকগন বলেন, কারণের মধ্যে এক অদৃষ্ট শক্তি আছে এবং শক্তিই কার্যকে উৎপন্ন করে। কিন্তু নৈয়ায়িকগণ, কারণের মধ্যে কোন অদৃষ্ট শক্তির অস্তিত্ব স্বীকার করেন না।

উপসংহার

উপসংহারে বলা যায় যে, ন্যায় দর্শন বস্তুর জ্ঞান নিরপেক্ষ স্বাধীন সত্তায় বিশ্বাসী। তাই এটি বস্তুবাদী দর্শন। এই দর্শন বেদের প্রামাণ্য স্বীকার করে জগৎকর্তা হিসেবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিলেও এদের মতবাদ স্বাধীন চিন্তা বিচারের উপর প্রতিষ্ঠিত।

Related Posts