কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের সবচেয়ে বড় অঙ্গ হলো মস্তিষ্ক, যা সুষুম্নাকাণ্ড বা মেরুরজ্জুর উপরে মাথার খুলির মধ্যে অবস্থিত। এটি এক জটিল সংগঠন ব্যবস্থার সমন্বয়। কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে মস্তিষ্ক। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মস্তিষ্কের আয়তন ১৫০০ ঘন সেন্টিমিটার এবং গড় ওজন প্রায় ১.৩৬ কেজি। এতে প্রায় ১০ বিলিয়ন নিউরন থাকে। প্রায় ১০০ কোটি স্নায়ুকোষের মধ্যে অধিকাংশই মস্তিষ্কে অবস্থিত। এই স্নায়ুকোষসমূহ মস্তিষ্কের কার্যনির্বাহী ব্যবস্থায় স্নায়ুপ্রবাহ প্রেরণ ও গৃহীত নির্দেশ বিভিন্ন অঙ্গ সঞ্চালন অংশে সরবরাহের মাধ্যমে আচরণে কার্যকরী ভূমিকা রাখে। এটি আমাদের যাবতীয় মানসিক ক্রিয়ার উৎস। স্মৃতি সংরক্ষণ এবং বুদ্ধি, বিচার, ইচ্ছাশক্তির নিয়ন্ত্রক ও পরিচালক হচ্ছে মস্তিষ্ক। মস্তিষ্কের কার্যক্রমের ফলেই মানব আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। আজকের লেখায় আমরা মস্তিষ্ক সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তথা মস্তিষ্কের গঠন ও কাজ বা মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের কাজ সম্পর্কে জানবো। সেই সাথে সহজে বুঝার সুবিধার্থে মস্তিষ্কের গঠন চিত্রও তুলে ধরবো।
মস্তিষ্কের গঠন ও কাজ
মাতৃগর্ভে ভ্রূণ গঠনকালে মেরুরজ্জুর অগ্রবর্তী দণ্ডাকার অংশ ভাঁজ হয়ে পর পর ৩টি স্ফীতি সৃষ্টি হয় এবং পরবর্তীতে এই স্ফীতিসমূহ মস্তিষ্কের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়। তাই মানুষের মস্তিষ্ক তিনটি প্রধান ভাগে বিভক্ত। এগুলো হলো:
১. সম্মুখ মস্তিষ্ক (Fore brain),
২. মধ্যম মস্তিষ্ক (Mid brain) এবং
৩. পশ্চাৎ মস্তিষ্ক (Hind brain)।
১. সম্মুখ মস্তিষ্ক (Fore brain)
মস্তিষ্কের প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে সম্মুখ বা অগ্র মস্তিষ্ক। এ প্রসঙ্গে C. T. Morgan উল্লেখ করেছেন, “এটি কার্যতভাবে সংবেদন ও প্রত্যক্ষণের বিভিন্ন অংশ ধারণ করে এবং আবেগ, প্রেষণা, শিক্ষণ, ভাষা ও চিন্তা-চেতনাকে অন্তর্ভুক্ত করে। এমন সব আচরণ কাঠামোর মধ্যে সমন্বয়সাধন করে। সম্মুখ মস্তিষ্কের প্রধান দুটি অংশ হলো Telenecphalon Diencephalon। এর উল্লেখযোগ্য অংশ হলো:
ক. গুরু মস্তিষ্ক (Cerebrum).
খ. রেখা মস্তিষ্ক (Corpus striatum),
গ. থ্যালামাস (Thalamus),
ঘ. হাইপোথ্যালামাস (Hypothalamus) এবং
৫. নাসা মস্তিষ্ক (Rhinencephalon)।
ক. গুরু মস্তিষ্ক (Cerebrum)
দুটি বড় কুণ্ডলি পাকানো ও খাঁজবিশিষ্ট খণ্ড নিয়ে গুরু মস্তিষ্ক গঠিত। এটি মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশসমূহের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বৃহত্তর, জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মস্তিষ্কের ওজনের ৮০%ই হচ্ছে গুরু মস্তিষ্ক এবং অন্যান্য অংশকে এটি আবৃত করে রাখে। খণ্ড দুটি ভিতরের দিকে কর্পাস ক্যালোসাস নামে চওড়া স্নায়ুগুচ্ছ দিয়ে যুক্ত। পৃষ্ঠতল নানা স্থানে ভাঁজ হয়ে উঁচুনিচু অবস্থায় থাকে। উঁচু জায়গাকে জাইরাস (Gyrus) এবং নিচু জায়গাকে ফিসার (Fissure) বলে। কয়েকটি ভাঁজ সুগঠিত ও গভীর হয়ে এটি প্রশস্ত ফিসার সৃষ্টি করে, যথা সেন্ট্রাল, প্যারাইটো- থেক্সিপিটাল এবং ল্যাটেরাল ফিসার। ফলে প্রতিটি সেরেব্রাল হেমিফিয়ার ৫টি সুস্পষ্ট খণ্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এগুলো হলো:
i. ফ্রন্টাল লোব (Frontal lobe);
ii. প্যারাইটাল লোব (Parietal lobe);
iii. অক্সিপিটাল লোব (Occipital lobe);
iv. টিম্পোরাল লোব (Temporal lobe) এবং
v. লিম্বিক লোব (Limbic lobe)।
স্নায়ুতন্ত্র কাকে বলে ও স্নায়ুতন্ত্রের শ্রেণীবিভাগ |
গুরু মস্তিষ্কের বহিঃস্তর ৩ সে.মি. পুরু ও গ্রেমেটারে গঠিত। এর নাম সেরেব্রাল কর্টেক্স (Cerebral cortex)। এর নিচের স্তরটি অর্থাৎ গুরু মস্তিষ্কের অন্তঃস্তর হোয়াইট ম্যাটারে গঠিত এবং এটি সেরেব্রাল মেডুলা (Cerebral medulla) নামে পরিচিত। (উল্লেখ্য, সুষুম্নাকাও বা মেরুরজ্জুর ক্ষেত্রে হোয়াইট ম্যাটার থাকে বাইরের দিকে, আর গ্রে ম্যাটার থাকে ভিতরের দিকে)। ডান সেরেব্রাল হেমিস্ফিয়ার দেহের বাম পাশকে এবং বাম হেমিস্ফিয়ার দেহের ডান পাশকে নিয়ন্ত্রণ করে।
গুরু মস্তিষ্কের শতকরা পঞ্চাশ ভাগ ধূসর পদার্থ এবং শতকরা পঞ্চাশ ভাগ শ্বেতবর্ণের পদার্থ দ্বারা গঠিত। এর আবরণে অধিক ভাঁজ থাকে এবং ভাঁজ যত অধিক হয়, মানুষের বুদ্ধি তত বেশি হয়। উন্নত প্রাণীদের সাথে নিম্নতর প্রাণীদের মস্তিষ্কের মৌলিক পার্থক্য মূলত এর সংগঠন ও আকৃতির উপর নির্ভর করে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের গুরু মস্তিষ্কের উপরিভাগের আয়তন প্রায় ২০০০ বর্গ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা সংবেদন গুরু মস্তিষ্কের সংবেদন কেন্দ্রে পৌছালে তা কর্মে পরিণত করার জন্য পেশীগুলোতে শক্তি সঞ্চালিত হয় এবং সেগুলোকে সক্রিয় করে।
কার্যক্রম (Function): গুরু মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করে। মস্তিষ্কের বাম অংশ যৌক্তিক বিশ্লেষণ, ভাষা প্রক্রিয়াকরণ, গাণিতিক হিসাব, বৈজ্ঞানিক চিন্তা-চেতনা প্রভৃতি কার্যে দক্ষ এবং ডান অংশ বিভিন্ন সংবেদী তথ্য বিশ্লেষণের কার্যে পারদর্শী হয়। এছাড়া গুরু মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের কার্যক্রম নিম্নরূপ:
i. সংবেদনমূলক কাজ (Sensory functions): গুরু মস্তিষ্কের অন্যতম কাজ হলো সংবেদী অঙ্গ থেকে আসা অনুভূতি গ্রহণ ও বিশ্লেষণ করা। এর সংবেদীয় অঞ্চলের মাধ্যমে সংবেদনমূলক কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। মানুষের ইন্দ্রিয়সমূহ এ কাজে নিয়োজিত এবং প্রত্যেকটি বিশেষ শ্রেণির উদ্দীপকের প্রতি সংবেদনশীল হয়। উদ্দীপকসমূহ ইন্দ্রিয়ের সংগ্রাহক কোষে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ফলে সৃষ্ট স্নায়ুপ্রবাহ মস্তিষ্কের সংবেদন কেন্দ্রে সংবেদন অঞ্চলকে উত্তেজিত করে। সৃষ্ট প্রতিক্রিয়া বাইরের পরিবেশের সাথে উপযোজনে সহায়তা করে থাকে।
ii. সংযোগমূলক কাজ (Associative functions): সংযোগমূলক কাজ বলতে গুরু মস্তিষ্কের চারটি Lobe এর সংবেদন গ্রহণ ও সঞ্চালন তথা নির্দেশ প্রদানের সমন্বয়কে বুঝায়। এ স্থানে বিভিন্ন মানসিক বিষয় যেমন- চিন্তন, শিক্ষণ, বৃদ্ধি, ইচ্ছাশক্তি, প্রত্যক্ষণ প্রভৃতি সম্পন্ন হয়। এর ডান গোলার্ধে রয়েছে দৈহিক অনুভূতি অঞ্চল। এটি মস্তিষ্কের নিম্নাংশ ও মেরুরজ্জুর কাজের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে। মোটকথা, উন্নত মানসিক বোধের নিয়ন্ত্রণ এবং বিভিন্ন ধরনের যৌক্তিক কার্যক্রমের কেন্দ্রস্থল হলো গুরু মস্তিষ্ক।
iii. সঞ্চালনমূলক কাজ (Motor function): গুরু মস্তিষ্ক দেহের সব ঐচ্ছিক পেশীর অঙ্গ সঞ্চালন কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে। এটি গতিশীল স্নায়ুপ্রবাহকে মেরুরজ্জুতে পৌছানোর ব্যবস্থা করে এবং এগুলো প্রান্তীয় ঐচ্ছিক স্নায়ুপথে বিভিন্ন মাংসপেশীতে গিয়ে অঙ্গ সঞ্চালন ঘটিয়ে থাকে। আমরা যখন ইচ্ছে করে দেহের কোন অঙ্গ সঞ্চালন করি, তখন এ স্থলের বিশেষ অংশ উদ্দীপিত হয়ে উত্তেজনা বা সংবেদন সৃষ্টি করে।
এছাড়া গুরু মস্তিষ্ক বিভিন্ন সহজাত প্রবৃত্তির নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে এবং বাকশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। মনোবিজ্ঞানী উড্ওয়ার্থ গুরু মস্তিষ্ককে সৈন্যদলের প্রধান সেনাপতির সাথে তুলনা করেছেন। এ প্রসঙ্গে মনোবিজ্ঞানী স্টাউট (Stout) বলেছেন, “মেরুরজ্জু, মস্তিষ্কবৃন্ত, লঘু মস্তিষ্ক এবং অন্যান্য নিউরনগুচ্ছের মধ্যে যেসব ক্রিয়া ঘটছে, গুরু মস্তিষ্ক সেগুলোকে আরম্ভ করে, বাধা দেয়, সংযুক্ত বা পৃথক করে।”
খ. রেখা মস্তিষ্ক (Corpus striatum)
এই অংশটি গুরু মস্তিষ্কের একটি বিক্ষিপ্ত অংশ, যা এর ভিতর দিকের ধূসর অঞ্চলে অবস্থিত। এটি থ্যালামাসের পশ্চাৎ ও সম্মুখ অংশকে বেষ্টন করে অবস্থান করে। গুরু মস্তিষ্কে সৃষ্ট শক্তি, এতে গমনকারী সংবেদনবাহী স্নায়ুপ্রবাহের পরিবর্তন, বাধাদান, সংশোধন প্রভৃতি রেখা মস্তিষ্কের প্রধান কাজ। এছাড়া এটি কয়েকটি প্রতিবর্ত ক্রিয়া নিয়ন্ত্রকের কাজও করে থাকে।
গ. থ্যালামাস (Thalamus)
থ্যালামাস হচ্ছে মস্তিষ্কের একটি বড় ধরনের সংবাদ প্রেরক যন্ত্র (Relay station) বা সংযোগ স্থাপনকারী কেন্দ্র। এটি মস্তিষ্কের কর্টেক্সের প্রেরণকেন্দ্র এবং অন্তর্মুখী ও বহির্মুখী সংকেত পরিচালনা করে থাকে। থ্যালামাস প্রতিটি সেরেব্রাল হেমিস্ফিয়ারের সেরেব্রাল মেডুলায় অবস্থিত এবং গ্রে ম্যাটারে গঠিত এককটি ডিম্বাকার অঞ্চল। দুটি থ্যালামাস একটি যোজক দিয়ে যুক্ত। এটি পাঁচটি স্নায়ুপিও নিয়ে গঠিত। থ্যালামাসের মূল কাজ হলো পঞ্চ ইন্দ্রিয় থেকে প্রাপ্ত স্নায়ুতরঙ্গকে বিভিন্ন সংবেদন কেন্দ্রে প্রেরণ করা। C. T. Morgan এর মতে, “It consists of many nuclei connected with each other, with the lower centres of the brain and spinal cord and with the cerebral hepispheres of the telencephalon above it.”
কার্যক্রম (Functions): থ্যালামাসের কার্যক্রমগুলো নিম্নে বর্ণনা করা হলো:
1. থ্যালামাস সংজ্ঞাবহ স্নায়ুর ‘রিলে স্টেশন’ হিসেবে কাজ করে (স্নায়ু আবেগ> থ্যালামাস> সেরেব্রাম)।
ii. স্পর্শ, চাপ, যন্ত্রণা প্রভৃতি স্থল অনুভূতির কেন্দ্র, আবেগের কেন্দ্র ও অভ্যন্তরীণ অঙ্গের নিয়ন্ত্রক কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে।
iii. এটি মানুষের ব্যক্তিত্ব ও সামাজিক আচরণের প্রকাশ ঘটায়।
iv. ঘুমন্ত মানুষকে হঠাৎ জাগিয়ে তোলা ও পরিবেশ সম্পর্কে সতর্ক করে তোলে।
V. এছাড়া খ্যালামাস মানুষের রাগ, চাপ, পীড়ন প্রভৃতি আবেগ সংক্রান্ত প্রতিক্রিয়া করে থাকে।
vi. পিটুইটারি গ্রন্থির অনেক কাজ এ অংশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
ঘ. হাইপোথ্যালামাস (Hypothalamus)
থ্যালামাসের ঠিক নিচে হাইপোথ্যালামাস অবস্থিত। এটি গ্রে ম্যাটার নির্মিত এবং অন্তত এক ডজন পৃথক অঞ্চলে বিভক্ত অংশ। অংশগুলো সুনির্দিষ্ট কাজে নিয়োজিত থাকে। হাইপোথ্যালামাস একটি সূক্ষ্ম অংশের সাহায্যে পিটুইটারি গ্রন্থির সাথে সংযুক্ত থাকে। এটি আবেগজনিত প্রতিক্রিয়ার সমন্বয়সাধন ও নিয়ন্ত্রণ করে। এটি আবেগের কেন্দ্রস্থল হিসেবে পরিচিত। হাইপোথ্যালামাস এমন একটি স্নায়বিক গ্রন্থির সংগঠন, যা আকৃতিতে ক্ষুদ্র হলেও অত্যন্ত প্রাণশক্তিসম্পন্ন। মানুষের জৈবিক আচরণ নিয়ন্ত্রণে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
কার্যক্রম (Functions): হাইপোথ্যালামাসের কার্যক্রম নিম্নরূপ:
i. হাইপোথ্যালামাস ক্ষুধা, ঘাম, তৃষ্ণা, ঘুম, রাগ, পীড়ন, ভালোলাগা, ঘৃণা, উদ্বেগ, প্রভৃতির কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে।
ii. এটি স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রমণ্ডলীর প্রধান নিয়ামক বা কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে।
iii. এটি দেহতাপ ও শক্তিক্ষয় নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
iv. নিউরো হরমোন উৎপন্ন করে ট্রপিক হরমোনের ক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ করে।
v. ভ্যাসোপ্রেসিন ও অক্সিটোসিন নামে দু’রকম নিউরো হরমোন সরাসরি ক্ষরিত হয় এবং তা পশ্চাৎ পিটুইটারির মধ্যে জমা থাকে।
vi. যৌনানুভূতি, যৌনক্রিয়ায় সহায়তা, ফুসফুস, হৃৎপিণ্ড প্রভৃতির কাজকে নিয়ন্ত্রণ করে।
vii. হাইপোথ্যালামাস প্রাণীর নিদ্রা ও জাগরণ কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ এবং শরীরের বিপাক ক্রিয়ায় সহায়তা করে থাকে।
viii. রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ ও মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহের কাজ মূলত হাইপোথ্যালামাসের উপর নির্ভরশীল।
ix. হাইপোথ্যালামাস আবেগের ভারসাম্য আনয়ন এবং অভ্যন্তরীণ মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
ঙ. নাসা মস্তিষ্ক (Rhinencephalon)
সম্মুখ মস্তিষ্কের আরেকটি অংশ হচ্ছে নাসা মস্তিষ্ক। নাসা মস্তিষ্ক সংলগ্ন অঞ্চলকে প্রান্ত সংস্থা বা লিম্বিকতন্ত্র (Limbic system) বলা হয়। এটি প্রধানত হিপোক্যাম্পাস (Hipocampus), এমিগড্যালা (Amygdala), হাইপোথ্যালামাস এবং সেন্টাল অঞ্চল (Saptal area) এর কতকগুলো অংশ নিয়ে গঠিত। মানুষের আবেগের সাথে এর প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। এই অংশটির গঠন ও কার্যাবলি বেশ কঠিন। পূর্বে এটিকে ঘ্রাণ সম্পর্কিত সংবেদনের জন্য দায়ী করা হতো। কিন্তু পরবর্তীকালে গবেষণায় দেখা গেছে যে, ঘ্রাণ সংবেদনের সাথে এর কিছুটা সম্পর্ক থাকলেও এটি প্রধানত আবেগীয় প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে।
২. মধ্যম মস্তিষ্ক (Mid brain)
এটি খাটো ও সংকোচিত অংশ, যা সম্মুখ ও পশ্চাৎ মস্তিষ্কের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করে এবং সেরেব্রাল হেমিস্ফিয়ারে সম্পূর্ণ আবদ্ধ থাকে। এর নিচের অংশ সেরেবেলাম ও পল্স (পশ্চাৎ মস্তিষ্ক) এর সাথে এবং উপরের অংশ সম্মুখ মস্তিষ্কের সাথে সংযুক্ত। এই মস্তিষ্কের দৈর্ঘ্য প্রায় ২ সেন্টিমিটারের মতো। এটি আকৃতিগত দিক থেকে যেমন ক্ষুদ্রতর, তেমনি কার্যক্রমের দিক থেকেও কম গুরুত্বপূর্ণ। মধ্যম মস্তিষ্ক তিনটি অংশ নিয়ে গঠিত। যথা:
ক. সেরেব্রাল পেডাঙ্কল (Cerebral peduncle);
খ. কর্পোরা কোয়াড্রিজেমিনা (Corpora quadrigemina) এবং,
গ. সেরেব্রাল অ্যাকুইডাক্ট (Cerebral aqueduct)।
ক. সেরেব্রাল পেডাঙ্কল (Cerebral peduncle)
এটি মধ্য মস্তিষ্কের মেঝেয় অবস্থিত এবং অনুদৈর্ঘ্য স্নায়ুতন্ত্র নির্মিত একজোড়া পুরু নলাকার ব্যান্ড। এটি অগ্র ও পশ্চাৎ মস্তিষ্কের সমন্বয় কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে।
খ. কর্পোরা কোয়াড্রিজেমিনা (Corpora quadrigemina)
মধ্য মস্তিষ্কের পৃষ্ঠদেশ নির্মাণকারী চারটি গোল অংশকে কর্পোরা কোয়াড্রিজেমিনা বলা হয়। প্রকৃতপক্ষে একজোড়া বড় আকৃতির লোব (খণ্ড) এর প্রত্যেকটি লোব আড়াআড়ি দ্বিখণ্ডিত হয়ে মোট ৪টি লোবের সৃষ্টি হয়। অক্ষিপেশীর প্রতিবর্ত সঞ্চালন নিয়ন্ত্রণ করা, চোখের পিউপিল ও লেন্সের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ঘটানো, দৃষ্টি ও শ্রুতিজনিত উদ্দীপনা সাড়া দিয়ে মাথা, ঘাড় ও দেহকান্ডকে প্রতিবর্তী সঞ্চালনে সাহায্য করা এবং দৃষ্টি ও শ্রুতিজনিত প্রতিবর্ত ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করা এর কাজ।
গ. সেরেব্রাল অ্যাকুইডাক্ট (Cerebral aqueduct)
এটি মধ্য মস্তিষ্কের ১৫ মি.মি. লম্বা ও সংকীর্ণ নালী, যার প্রাচীর কর্পোরা কোয়াড্রিজেমিনা ও সেরেব্রাল পেডাঙ্কলে নির্মিত হয়। এটি ৩য় ও ৪র্থ ভেন্ট্রিকল (মস্তিষ্ক) এর মধ্যে যোগসূত্র রচনা করে।
মূলত মধ্যম মস্তিষ্ক দেহের বিভিন্ন পেশীর মধ্যে সমন্বয়সাধন করা, দেহের ভারসাম্য রক্ষা, দেহতাপ নিয়ন্ত্রণ করা, করোটিক স্নায়ুর কেন্দ্র হিসেবে কাজ করা, স্নায়ুতন্ত্রসমূহ পরিবহন, সুনিপুণ অঙ্গ সঞ্চালন, বিভিন্ন ধরনের সংবেদী কাজ প্রভৃতি কার্যক্রম সম্পাদন করে।
৩. পশ্চাৎ মস্তিষ্ক (Hind brain)
মধ্য মস্তিষ্কের নিচে অবস্থিত ফাঁপা অংশকে পশ্চাৎ মস্তিষ্ক বলা হয়। এটি পরামস্তি ও সুষুম্না মস্তিষ্ক বা মেডুলা অবলংগেটা নিয়ে গঠিত। তিনটি প্রধান অংশ নিয়ে মধ্যম মস্তিষ্ক গঠিত। এগুলো হলো:
ক. লঘু মস্তিষ্ক (Cerebellum);
খ. অধঃমস্তিষ্ক (Medula obloganta) এবং
গ. সেতু মস্তিষ্ক (Pons varolli)।
ক. লঘু মস্তিষ্ক (Cerebellum)
এটি পশ্চাৎ মস্তিষ্কের সবচেয়ে বড় অংশ, যা সেরেব্রাল হেমিস্ফিয়ারের নিচে অবস্থিত, কুণ্ডলীকৃত ও সমগোলার্ধ নিয়ে গঠিত। গোলার্ধটি ভার্নিস (Vernis) নামে একটি ক্ষুদ্র যোজকের সাহায্যে যুক্ত। সেরেবেলামের বাইরের অংশ গ্রে ম্যাটারে এবং ভিতরের অংশ হোয়াইট ম্যাটারে গঠিত। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের লঘু মস্তিষ্কের গড় ওজন প্রায় ১৫০ গ্রাম এবং এটি মস্তিষ্কের অনেকখানি স্থান জুড়ে অবস্থান করে আছে বলে একে ‘Little Brain’ও বলা হয়। লঘু মস্তিষ্ক সম্পর্কে বলা হয়েছে, “The cerebellum is a structure that resembles the cerebral hemispheres, in that gray matter froms in outer surface and white matter, to gether with certain nuclei, makers up its interior.”
লঘু মস্তিষ্ক ৩টি অংশে বিভক্ত। এগুলো হলো:
i. মেরুরজ্জু সংলগ্ন অংশ (Ventral portion): এই অংশটি দেহের বিভিন্ন সংবেদন অঙ্গ থেকে প্রেরিত তথ্য গ্রহণ করে থাকে।
ii. উপরিভাগ ও নিচের ভাগ (The anterior and posterior portions): লঘু মস্তিষ্কের এই অংশটি মেরুরজ্জু থেকে আগত তথ্যকে সরবরাহের জন্য নিয়োজিত থাকে।
iii. পশ্চাৎ ভাগ (Dorosal or neocerebellum): এই অংশটি মূলত গুরু মস্তিষ্কের কর্টেক্সের সম্মুখ (Lobe) বা পিন্ডের সাথে পন্স এর নিউক্লির যোগাযোগ রক্ষা করতে সহায়তা করে।
স্নায়ুতন্ত্রের কাজ কি | স্নায়ুতন্ত্রের কার্যাবলী |
লঘু মস্তিষ্ক ঐচ্ছিক চলাফেরাকে নিয়ন্ত্রণ করে। ঐচ্ছিক পেশীয় পেশীটান নিয়ন্ত্রণ করে। এটি দেহের ভারসাম্য ও দেহভঙ্গি বজায় রাখে। বিভিন্ন বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ সম্পাদন করে লঘু মস্তিষ্ক। এছাড়া এটি সংবেদন তথ্যাদি বিশ্লেষণের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে অংশগ্রহণ করে। তবে কোন কারণে লঘু মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হলে এ ধরনের কাজে ব্যাপক মাত্রায় অন্তরায় লক্ষ্য করা যায়। এর ফলে চলনশক্তি, কথা বলার ক্ষমতা, লেখা, দেখা প্রভৃতি ব্যাহত হয়। মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপানে এ কেন্দ্র সাময়িকভাবে নিষ্ক্রিয় হয়।
খ. অধঃমস্তিষ্ক (Medulla oblongata)
এটি পন্স এর কিনারা ঘেঁষে প্রসারিত, অনেকটা পিরামিড আকৃতির দণ্ডাকার অংশ, যা লম্বায় প্রায় ৩ সে. মি. চওড়ায় ২ সে. মি. এবং স্থূলত্বে ১.২ সে. মি.। অধঃমস্তিষ্ক ধূসর ও সাদা পদার্থ দ্বারা গঠিত। এটি মস্তিষ্কের সর্বোচ্চ অংশের সাথে মেরুরজ্জুর সংযোগ স্থাপন করে। এটি মস্তিষ্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র বলা যায়। অধঃমস্তিষ্ক দেহের গুরুত্বপূর্ণ কার্যাদি সম্পন্ন করে।
এই অংশের গুরুত্ব সম্পর্কে Morgan বলেছেন, “It is important as the place of exit and extrance of the majority of cranical nerves.” অর্থাৎ, অধিকাংশ করোটি স্নায়ুর প্রবেশ ও বাইরের ক্ষেত্রে এটি একটি, গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
কার্যক্রম: অধঃমস্তিষ্কের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো হলো নিম্নরূপ:
1. হৃদস্পন্দন, শ্বসন, গলাধঃকরণ, কাশি, রক্তবাহিকার সংকোচন, লালাক্ষরণ প্রভৃতির স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে।
ii. বমন, মলমূত্র ত্যাগ, রক্তচাপ, পৌষ্টিক নালীর পেরিস্ট্যালসিস প্রভৃতি নিয়ন্ত্রণ করে।
iii. মেরুরজ্জু ও মস্তিষ্কের মধ্যে যোগসূত্র সৃষ্টি করে।
iv. নবম, দশম ও একাদশ করোটিক স্নায়ুর উৎসস্থল হিসেবে কাজ ও সংশ্লিষ্ট স্নায়ুর কাজ নিয়ন্ত্রণ করে।
v. মধ্য মস্তিষ্কের মধ্যে প্রবাহিত অনেকগুলো Tract ধারণ করে, যেগুলো মস্তিষ্কের সর্বোচ্চ কেন্দ্র ও রজ্জুর মধ্যে প্রণোদনা প্রেরণ ও সঞ্চালন করে।
গ. সেতু মস্তিষ্ক (Pons varolli)
এটি মেডুলা অবলঙ্গাটির উপরের অংশের মেঝেতে অবস্থিত এবং আড়াআড়ি স্নায়ুতন্ত্র নির্মিত একটি পুরু ব্যান্ড। সেতু মস্তিষ্কের মধ্যে কতকগুলো স্নায়ুপথ ও স্নায়ুকেন্দ্রের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। যথা:
i. তীর্যক স্নায়ুপথ (Transverse fiber),
ii. পনটাইন স্নায়ুকেন্দ্র (Pontine nuclei).
iii. ঊর্ধ্বমুখী ও নিম্নমুখী স্নায়ু (Asending and Deconding fiber) এবং
iv. ট্রাইজেমিনাল স্নায়ু (Trigeminal nerve)।
দেখতে সেতুর মতো বলে একে সেতু মস্তিষ্ক বলা হয়। একে যোজকও বলা হয়। এটি লঘু মস্তিষ্কের দুটি গোলার্ধের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী হিসেবে কাজ করে থাকে। এর অন্যান্য কাজগুলো হচ্ছে নিম্নরূপ:
i. সেরেবেলাম, মেরুরজ্জু ও মস্তিষ্কের অংশের মধ্যে ‘রিলে স্টেশন’ হিসেবে কাজ করে।
ii. দেহের দু’পাশের পেশীয় কর্মকাণ্ড সমন্বয় করে।
iii. সেতু মস্তিষ্ক স্বাভাবিক শ্বাসক্রিয়ার হারকে নিয়ন্ত্রণ করে।
iv. এখান থেকে সৃষ্ট ৫-৮ম করোটিক স্নায়ু দেহের নানাবিধ কাজ সম্পন্ন করে।
৮. শ্বাসকার্য, অক্ষিগোলকের সঞ্চালন, মুখের অভিব্যক্তি, অভ্যন্তরীণ প্রতিবর্তী ক্রিয়া, মলত্যাগ প্রভৃতি নিয়ন্ত্রণকারী বিভিন্ন স্নায়ুকেন্দ্র সেতু মস্তিষ্কে অবস্থিত।