প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা
মিসরের নীল নদের অববাহিকায় পৃথিবীর প্রাচীন ও সমৃদ্ধ সভ্যতার উন্মেষ ঘটে। মিশরীয় সভ্যতার মত আর কোন সভ্যতা মানব জাতির ক্রম বিবর্তন, উন্নতি ও উৎকর্ষতায় এতবড় অবদান রাখতে পারেনি। প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা এর সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১০৯০ পর্যন্ত বিস্তৃত।
মিশরীয় সভ্যতার অবদান
মানব সভ্যতার ইতিহাসে প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বিস্ময়কর। মিশরীয় সভ্যতার অবদান মানব সভ্যতার ইতিহাসে চিরস্মরণীয়। নিচে মিশরীয় সভ্যতার (ক) রাষ্ট্র ও সমাজ (খ) অর্থনীতি (গ) ধর্ম ও (ঘ) লিখন পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো-
(ক) রাষ্ট্র ও সমাজ
খ্রিস্টপূর্ব ৩২০০ সাল থেকে মিসরের নীল নদের অববাহিকায় সংঘবদ্ধ জাতির বসবাস শুরু হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৩২০০ সালের পূর্বে মিসরকে প্রাক রাজবংশীয় যুগ বলা হয়। প্রাক রাজবংশীয় যুগে প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার সূচনা হয়। এ সময়ে মিসরে কতকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন নগররাষ্ট্র ছিল-এতে রাষ্ট্রগুলো সংঘবদ্ধ ছিল না।
আরও পড়ুন: রোমান সভ্যতার অবদান সম্পর্কে আলোচনা কর
খ্রিস্টপূর্ব ৩২০০ সালে মেনেস নামের এক রাজা সমগ্র মিশরকে একত্রিত করে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। তিনিই প্রথম রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। প্রথমে এ রাষ্ট্রের রাজধানী- উত্তরে থিরিসে ছিল। পরে রাজধানী স্থানান্তরিত হয়ে দক্ষিণ মিসরে মেসফিসে আসে।
মিসরের শাসনকর্তাকে ফারাও বা ফেরাউন বলা হত। তিনি ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে রাজ্য শাসন করতেন। রাজা বড় রাজ প্রাসাদে বাস করতেন এবং প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন বলে তাকে ফারাও বলা হত। ফারাওগণ পরাক্রমশালী ছিলেন, কান্তিও শৃঙ্খলার সাথে রাজ্য শাসন করতেন।
সামাজিক শ্রেণীবিভাগ: প্রাচীন মিশরীয় সমাজ পেশাভিত্তিক কয়েকটি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। এগুলো হলো-
১. রাজ পরিবার ২. পুরোহিত শ্রেণী ৩. অভিজাত সম্প্রদায় ৪. ব্যবসায়ী শ্রেণী ৫. লিপিকার ৬. শিল্পী এবং ৭. কৃষক ও ভূমিদাস।
রাজ পরিবার ও শাসক সম্প্রদায় ছিল সমাজের সর্বোচ্চ স্তরে এবং শ্রমজীবি কৃষক ও ভূমিদাসের অবস্থান ছিল সমাজের নিম্নস্তরে।
(খ) অর্থনীতি
প্রাচীন মিশরীয় অর্থনীতি ছিল কৃষি ভিত্তিক। কৃষক ও ভূমিদাস কৃষিকাজে নিয়োজিত থাকত। প্রাক রাজকীয় যুগ থেকেই মিশরীয়রা চাষের জন্যে লাঙ্গলের ব্যবহার শুরু করে। কৃষি কাজের জন্যে জল-সেচ, জলাশয়কে কৃষিক্ষেত্রে রূপান্তরিত করার কৌশল তারা আবিস্কার করে। গম, যব, তুলা, পেঁয়াজ অন্যতম কৃষিজ পণ্য ছিল।
কৃষিকাজ ছাড়াও প্রাচীন মিসরীয়রা বিভিন্ন ধরণের মাটির পাত্র নির্মাণ করত। তারা বিভিন্ন ধরণের হাতিয়ার ও অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহারও জানত। পাথর শিল্প, নৌযান তৈরী, মাটির পাত্র রপ্তানি এবং সোনা, রূপা, হাতির দাঁত, কাঠ ইত্যাদি আমদানি করত। ফিলিস্তিন, সিরিয়া, ফিনিশিয়া ও ক্রীট দ্বীপের সাথে তাদের ব্যবসা বাণিজ্য ছিল।
(গ) ধর্ম
প্রাচীন জাতি সমূহের মধ্যে মিসরীয়রা প্রথম ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রচলন করে। প্রাচীন মিসরীয়দের জীবনে ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল। মিসরীয়দের সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক জীবনের অর্থাৎ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতিফলন দেখা যায়।
মিসরীয়দের প্রধান দেবতার নাম ছিল আমনরে। নীল নদী ভিত্তিক সভ্যতার অপর এক দেবতার নাম ছিল ওসিরিস। ওসিরিস নীলনদের দেবতা বলেও পরিচিত ছিল। এ দু’দেবতাই প্রভাবশালী ছিল। অন্যান্য দেব-দেবী তেমন প্রভাবশালী ছিল না। মিসরীয়দের পুর্নজীবনের প্রতি এবং দোযখ ও বেহেস্তের প্রতি তাদের পূর্ণবিশ্বাস ছিল।
(ঘ) লিখন পদ্ধতি
মিশরীয়দেরদের লিখন পদ্ধতির নাম ছিল চিত্রলিখন রীতি এবং মিশরীয়রাই সর্বপ্রথম লিখন পদ্ধতি আবিষ্কার করে। গ্রীক ভাষায় এ নামের অর্থ হল পবিত্র লিপি। এ লিখন পদ্ধতির চব্বিশটি চিহ্ন ছিল এবং প্রতিটি চিহ্ন একটি বিশেষ অর্থ নির্দেশ করত। প্রতিটি চিহ্ন পাশাপাশি খোদিত করে শব্দ প্রকাশ করা হতো। ধর্ম লেখা এবং রাজার আদেশ প্রচারের জন্যে এ ধরনের লিপিকে ব্যবহার করা হত। ধীরে ধীরে লিখন পদ্ধতির উন্নতি ঘটে। চিত্রভিত্তিক থেকে অক্ষরভিত্তিক এবং শেষে বর্ণভিত্তিক লিপি ব্যবহৃত হয়। পাথর বা কাঠের গায়ে প্রথমে লিপি খোদাই করা হত।
মিশরীয়রা প্রথমে নলখাগড়া জাতীয় পাপিরাস গাছের মন্ড থেকে কাগজ তৈরী করে। এ কাগজের নাম ছিল পাপিরাস। লিপিকারগণ পাপিরাসের গায়ে লিখে রাখত। বিশ্বসভ্যতায় মিসরীয়দের অবদান অনবদ্য। শুধু লিখন পদ্ধতি, রাষ্ট্র ও সমাজ, অর্থনীতিতে তাদের অবদান সীমাবদ্ধ থাকেনি বরং প্রাচীন সভ্যতার সর্ব ক্ষেত্রে অবদান চিরস্মরণীয়।
আরও পড়ুন: ই-কমার্স কি? ই-কমার্স এর ব্যবহার লিখ।