বাংলাদেশে বন্যার প্রভাব
বাংলাদেশে বন্যার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। বন্যা বাংলাদেশে একটি অতি পরিচিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এ দুর্যোগটি এদেশে যেসব প্রভাব বিস্তার করে সেগুলো নিম্নরূপ:-
১) সম্পদ হানি
বাংলাদেশে সৃষ্ট প্রতিটি বন্যায় বিপুল পরিমাণ সম্পদ হানি ঘটে। বন্যার পানি মাঠ-ঘাট, ঘরবাড়ি, হাট-বাজার প্রভৃতি ক্ষতিগ্রস্ত করে তোলে। ফসল, গবাদি পশু, ঘরবাড়ি প্রভৃতি সম্পদের ক্ষতিসাধন বন্যার সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কযুক্ত।
২) উৎপাদন হ্রাস
বন্যার পানিতে মাঠ-ঘাট, হাট-বাজার, শহর-গঞ্জ প্রভৃতি ভেসে যায়। ফলে বাংলাদেশের কৃষি ও শিল্প উৎপাদন ক্ষতির। সম্মুখীন হয়। সামগ্রিক উৎপাদন দ্রুত হ্রাস পায়।
বাংলাদেশের বন্যার কারণ ও প্রতিকার আলোচনা কর |
৩) দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি
বন্যার ফলে কৃষি ও শিল্প উৎপাদন হ্রাস পাওয়া বাংলাদেশের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। বন্যার পানিতে ফসলের মাঠ ভেসে যায়, যা কৃষি ফসল সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট করে দেয়। দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন ও সরবরাহ কমে যায়। ফলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করে। বন্যার সময় সম্পদ হারিয়ে তারা আরো দরিদ্রে পরিণত হয়। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি তাদের সমস্যাকে আরো কয়েক গুণ বৃদ্ধি করে দেয়।
৪) অপুষ্টি
বন্যার ফলে খাদ্যসামগ্রীর উৎপাদন ও প্রাপ্যতা কমে যায়। সাধারণত মানুষ পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে তারা অপুষ্টিতে ভোগে। এভাবে বন্যা বাংলাদেশে অপুষ্টির হার বৃদ্ধি করে।
৬) উদ্বাস্তু সৃষ্টি
বন্যার ফলে বাংলাদেশে বহু মানুষের ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়। বন্যায় সৃষ্ট নদী ভাঙনে বহু সংখ্যক ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। একইভাবে মানুষ চাষের জমি ও অন্যান্য সম্পদ (যেমন- বনভূমি) হারিয়ে ফেলে এবং উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়। বাংলাদেশে বন্যাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতি বছর উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীতে পরিণত হচ্ছে।
৭) দারিদ্র্যতা বৃদ্ধি
বন্যা বাংলাদেশের দারিদ্র্যের প্রকোপ বৃদ্ধি করে। বন্যা একদিকে যেমন বিপুল সম্পদের হানি ঘটায়, তেমনি বন্যা ও বন্যা পরবর্তী সময়ে মানুষ বিভিন্ন ধরনের রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে, যা মানুষের কর্মক্ষমতা হ্রাস করে দেয়। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত জনগণ অনেক সময় তাদের পূর্বের পেশায় ফিরে আসতে পারে না। বন্যার ফলশ্রুতিতে তারা আরো দরিদ্র হয়ে পড়ে এবং অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে অগ্রসর হয়।
৮) অপরাধ বৃদ্ধি
বন্যার ফলে বাংলাদেশের মানুষ সহায়-সম্বল হারিয়ে বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত হয়ে পড়ে। অসহায় মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদে অপরাধমূলক কার্যকলাপ সংঘটনে পিছপা হয় না। সমাজে মাদক, চোরাচালান, খুন, সন্ত্রাস, ছিনতাই, পতিতাবৃত্তিসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।
৯) শহরে জনচাপ বৃদ্ধি
বাংলাদেশের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত জনগণ জীবন জীবিকার খোঁজে শহরে চলে আসে। তারা শহরে জনচাপ বৃদ্ধি করে। শহরে এসে তারা সাধারণত বস্তিতে, খোলা আকাশে নিচে, রাস্তার পাশে প্রভৃতি স্থানে বসবাস করে এবং নতুন বস্তি গড়ে তোলে। বাংরাদেশের শহরগুলোর অধিক সংখ্যক বস্তিবাসী ও খোলা আকাশের নিচে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী বন্যাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়। এ জনগোষ্ঠী শহরে জনচাপ বৃদ্ধিসহ নানা ধরনের অসামাজিক ও অপরাধমূলক কার্যকলাপ বৃদ্ধি করে।
দুর্যোগ কত প্রকার ও কি কি? |
১০) রোগ-ব্যাধির বিস্তার
বাংলাদেশে বন্যা ও বন্যা পরবর্তী সময়ে বিভিন বিভিন্ন ধরনের ধরনের। রোগ-ব্যাধির বিস্তার ঘটে। বন্যার পানিতে বিভিন্ন দ্রব্য পঁচে চারপাশের পরিবেশ রোগ-ব্যাধির বিস্তার ঘটায়। ঘরবাড়ি হারিয়ে অনেক মানুষ বিভিন্ন স্থানে অরক্ষিত পরিবেশে বসবাস করতে বাধ্য হয়। ফলে তারা সহজেই বিভিন্ন রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। বন্যা ও বন্যা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের ডায়রিয়া, কলেরা, নিউমোনিয়াসহ বিভিন্ন রোগের বিস্তার ঘটে।
১১) পারিবারিক ভাঙন
বন্যার ফলে বহু সংখ্যক মানুষ রোগ-ব্যাধি, সাপের কামড়সহ বিভিন্ন কারণে মৃত্যুবরণ করে। পরিবারে কোনো সদস্যের মৃত্যুতে গোটা পরিবারে অনিশ্চয়তা নেমে আসে। স্বামীর মৃত্যুতে অনেক মহিলা বিধবা হয়ে যায়। পিতা-মাতার মৃত্যুতে শিশুরা হয়ে পড়ে অসহায়। ফলে পারিবারিক জীবনে নেমে আসে বিষাদের ঘনছায়া।
১২) যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন
বন্যার ফলে বাংলাদেশের অনেক জনপদ প্লাবিত হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এসব এলাকায় নিত্য, প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী সরবরাহের ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি হয়। ফলে বন্যা প্লাবিত এলাকার মানুষ দুর্ভোগের সম্মুখীন হয়।
আশাকরি, উপরোক্ত আলোচনা থেকে আপনারা বন্যার প্রভাব গুলি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে সক্ষম হয়েছেন।