ত্রিপিটকে অন্যতম ও তৃতীয় বিভাগ হলো অভিধর্ম। অভি ও ধম্ম শব্দ দু’টি সমন্বয়ে গঠিত অভিধম্ম। অভিধর্ম বৌদ্ধ মননশীলতার চরম বিকাশ। অভিধর্মে প্রকৃষ্ট জ্ঞান ব্যতীত কেউ উত্তম ধর্ম কথক হতে পারে না। কথিত আছে ভগবান বুদ্ধত্ব প্রাপ্তির সপ্তম বর্ষে তাবতিংস দেবলোকে গিয়ে চক্ৰবাসী দেবগণের সম্মুখে একাক্রমে তিনমাস অভিধর্ম দেশনা করেছিলেন। পিণ্ডপাত করে ভোজন সময় হলে মর্ত্যলোকে এসে ভোজন করতেন এবং আয়ুষ্মান সারিপুত্র স্থবিরকে তাঁর দেশিত ধর্মের সংক্ষিপ্ত সার জ্ঞাপন করতেন। অভিধর্মের বিষয়বস্তু হলো পরমার্থ সম্পর্কীয়। যথা– স্কন্ধ, আয়তন, ইন্দ্রিয়, ধাতু, চ্যুতি, প্রতিসন্ধি, সন্ততি, আত্মা, বল, বোধ্যঙ্গ, নির্বাণ ও প্রজ্ঞপ্তি ইত্যাদি।
অভিধর্ম শব্দের অর্থ কি?
ধর্ম ও অভিধর্ম মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই। “ধর্ম” শব্দের যেই অর্থ ”অভিধর্ম” শব্দেরও সেই একই অর্থ। “ধর্ম” শব্দের সাথে “অভি” উপসর্গ যোগ করে ”অভিধর্ম” পদ গঠিত হয়। অভি, অতি, অধি প্রভৃতি সমার্থক উপসর্গ। এর অর্থ অধিক, বিশিষ্ট অথবা অধিকতর। সুতরাং অভিধর্ম শব্দের অর্থ বিশিষ্ট ধর্ম, অতিরিক্ত ধর্ম, অধিকতর ধর্ম।
আচার্য বুদ্ধঘোষের মতে, “ধম্মাতি রেক ধম্ম বিসেসখেন অভিধম্মো” অর্থাৎ সূত্রাতিরিক্ত ধর্মই অভিধর্ম। বুদ্ধঘোষ বলতে চেয়েছেন সূত্রপিটকে যাহা সাধারণভাবে উপদেশিত হয়েছে অভিধর্মপিটকে তাহাই পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিশ্লেষেণ করা হয়েছে। সূত্রপিটকে যেই ধর্ম লৌকিকভাবে দেশনা করা হয়েছে তাহাই অভিধর্ম পিটকে অসাধারণভাবে বা পরমার্থিক উপায়ে আলোচিত, বিভাজিত ও ব্যাখ্যাত হয়েছে।
বৌদ্ধদার্শনিক বীরেন্দ্র লাল বড়ুুয়ার ভাষায়, “সূত্রের ভাষা আছে, সেই ভাষায় তরঙ্গ আছে, অপায় ভয় আছে, দেব–ব্রহ্মা আছে, দেব–ব্রহ্ম লোকের আকর্ষণ আছে, নির্বাণের সুমাচার আছে। অভিধর্ম যেন ভাষাহীন, শুধু ছেদন, বিশ্লেষণ, বিভাজন, পর্যবেক্ষণ এবং নৈর্ব্যক্তিক পরম সত্য জ্ঞানের উদ্ভাবন। সঙ্গে সঙ্গে চির চঞ্চল ব্যবহারিক জগতের নিরবশেষ বিলয় সাধন।”
আরও পড়ুন
প্রতীত্য সমুৎপাদ নীতি বা কার্যকারণ তত্ত্ব কি? কার্যকারণ তত্ত্ব কত প্রকার ও কি কি?
চাকমা বৌদ্ধদের প্রধান ধর্মীয় উৎসবগুলো সম্পর্কে আলোচনা কর
অভিধর্মের গ্রন্থসমূহ
অভিধর্ম গ্রন্থের সংখ্যা সর্বমোট সাতটি। যথা- ১) ধর্মসঙ্গনী, ২) বিভঙ্গ, ৩) ধাতুকথা, ৪) পুগ্গলপঞঞতি, ৫) কথাবত্থু, ৬) যমক, ৭) পট্ঠান ।
অভিধর্মের বিষয়বস্তু সম্পর্কে আলোচনা
অভিধর্মের মূল আলোচ্য বিষয় বৌদ্ধ দর্শন ও পরমার্থ সত্য। অভিধর্মের আলোচনা এক অফুরন্ত ব্যাপার। নিম্নে অভিধর্মের বিষয়বস্তু সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
ধর্মসঙ্গনী: ধম্ম সঙ্গনী অভিধর্ম পিটকের প্রথম গ্রন্থ। ধম্ম সঙ্গনী শব্দের মূল অর্থ ধর্ম সংগননা অথবা ধর্মের সংক্ষিপ্ত দেশনা বলা হয়। এর মধ্যে কামলোক, রূপলোক, অরূপলোক ও নির্বাণ সম্পৰ্কীয় বিষয় সমূহ সুন্দরভাবে শৃঙ্খলা বদ্ধ ও সংগ্রথিত করা হয়েছে। ধম্ম সঙ্গনীকে অভিধর্মের সারাংশ বলা যায়। নাম রূপকে কার্যকারণ অনুসারে কুশল, অকুশল এবং অব্যাকৃত এ তিনভাগে ভাগ করা যায়। উপরোক্ত ধম্ম সঙ্গনীর আলোচ্য বিষয়কে তিনভাগে ভাগ করা যায়। যথা– ১. চিত্ত ও চৈতসিকের পরিচয়, ২. রূপ বা জড় পদার্থের পরিচয় এবং ৩. পূর্বোক্ত বিষয়ের সংক্ষিপ্ত সার বা নিক্ষেপ।
বিভঙ্গ: বিভঙ্গ শব্দের অর্থ মূল বিষয়গুলোকে ভেঙ্গে–চুরে বিশদ ভাবে ব্যাখ্যা। ধম্মসংগণিতে যে বিষয়গুলো বর্ণিত হয়েছে সেগুলোকেই বিষয়ভিত্তিক ১৮টি পরিচ্ছেদে বিভঙ্গ গ্রন্থ সংকলিত হয়েছে। বিষয়বস্তু এক হলেও আলোচনার ধারা ও আলোচিত বস্তুর দিক থেকে বিভঙ্গ আলাদা, তাই ধম্ম সঙ্গনীর চেয়ে বিভঙ্গের মূল্য কোন অংশে কম নয়। বিভঙ্গের আর একটি বৈশিষ্ট্য হ‘ল এখানে ৩টি পদ্ধতি অনুসরণ করে বিষয়বস্তুকে আরও সহজ ও বোধগম্য করা হয়েছে।
ধাতুকথা: এটি প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে লিখিত অভিধম্ম পিটকের ক্ষুদ্রতম গ্রন্থ। এটির প্রকৃত নাম হওয়া উচিত ছিল খন্ধ-আয়তন-ধাতু-কথা। কারণ, এর চতুর্দশ পরিচ্ছেদে ধম্মসঙ্গনি ও বিভঙ্গের স্কন্ধ, আয়তন ও ধাতু বিষয়ক আলোচনা আছে। ধাতুকথার আলোচ্য বিষয় হচ্ছে- পঞ্চস্কন্ধ, দ্বাদশ আয়তন, আঠারো প্রকার ধাতু, চার প্রকার ধ্যান, পঞ্চবল, সপ্তবোধ্যঙ্গ ও অষ্টাঙ্গিক মার্গ।
পুগ্গল পঞঞতি: অভিধর্মের চতুর্থ গ্রন্থ হচ্ছে পুগ্গল পঞ্ঞতি। পুদ্গল অর্থ ব্যক্তি, পুরুষ, সত্ত্বা বা আত্মা বুঝায়। পঞ্ঞতি বা প্রজ্ঞপ্তি শব্দের অর্থ প্রজ্ঞাপনা, জ্ঞাতকথা, প্রকার করা বা যথার্থ বলে বিবেচিত করা হয়। সুতরাং পুদুগল প্রজ্ঞপ্তি অর্থ দাঁড়ায় যে, পুস্তক পুদ্গল বা ব্যক্তি বিশেষভাবে পরিচয় প্রদান করে। এতে পুদ্গল বা ব্যক্তি বিশেষের স্বরূপ ও বিকাশ দেখানোর জন্য পুদ্গলকে নানাভাবে বিভক্ত করা হয়েছে। যথা- পৃথকজন, শৈক্ষ্য, অশৈক্ষ্য, আর্য, স্রোতাপন্ন, সকৃদাগামী, অনাগামী, অর্হৎ, প্রত্যেকবুদ্ধ, সম্যক সম্বুদ্ধ প্রভৃতি। এ গ্রন্থে ৫০ প্রকার পুদ্গলের বিষয়ের আলোচনা করা হয়েছে।
কথাবত্থু: কথাবত্থু অভিধর্ম পিটকের পঞ্চম গ্রন্থ এবং অন্যতম মূল্যবান গ্রন্থ ও বলা যায়। বিশুদ্ধ বুদ্ধ বাক্য অবলম্বনে সম্রাট অশোকের গুরু সংঘ নায়ক অর্থৎ স্থবির মোগ্গলিপুত্ততিস্স এই বিশাল গ্রন্থের রচয়িতা। অশোকের রাজত্বকালে তৃতীয় বৌদ্ধ সংগীতিতে তিনি এই গ্রন্থ রচনা করেন। মিথ্যা দৃষ্টিক ও বিরুদ্ধবাদীদের মিথ্যা অভিমত বা যুক্তি খণ্ডন করার উদ্দেশ্যে এ গ্রন্থের রচনা। যে ধারাবাহিক মতানুগতিকতায় ত্রিপিটক গ্রন্থ সমূহ রচিত তা হতে কথাবত্থু রচনা পদ্ধতি সম্পূর্ণ পৃথক। এতে প্রতি অধ্যায়ে ১২টি প্রশ্ন এবং উত্তর রয়েছে। এগুলো বিবিধ প্রকার জটিল মিথ্যাদৃষ্টি সম্পর্কীয়।
যমক: “যমক” শব্দের অর্থ জোড়া বা যুগ্ম। এই গ্রন্থে প্রত্যেকটি অধ্যায়ে স্বপক্ষীয় ও প্রতিপক্ষীয় প্রশ্ন ও উত্তর যুগ্মভাবে উপস্থাপিত হয়েছে বলে এই গ্রন্থের নাম যমক করা হয়েছে। যমক স্বয়ংসম্পূর্ণ দশটি “যমক” বা পরিচ্ছেদে বিভক্ত। যথা- মূলযমক, খন্ধযমক, আয়তনযমক, ধাতুযমক, সচ্চযমক, সংখারযমক, অনুসয়যমক, চিত্তযমক, ধম্মযমক এবং ইন্দ্রিয়যমক। প্রত্যেকটি পরিচ্ছেদই স্বয়ংসম্পূর্ণ। গ্রন্থটি খুবই দুরূহ। অভিধর্মপিটকের পূর্ববর্তী ৫টি গ্রন্থ পাঠ করেও যেসব সমস্যা বা প্রশ্ন থাকতে পারে সম্ভবতঃ সেগুলোর সমাধানই এই গ্রন্থটি রচনার উদ্দেশ্য। প্রত্যেকটি পরিচ্ছেদের নামকরণ থেকেই পরিচ্ছেদগুলির আলোচ্য বিষয় জানা যায়।
পট্ঠান: পট্ঠান শব্দের অর্থ মূল কারণ বা প্রধান কারণ। পালি অভিধর্মপিটকে এটি সব চেয়ে বৃহৎ গ্রন্থ। তাই হয়ত একে মহাপ্রকরণ বলা হয়। বৌদ্ধধর্মের কার্যকারণ নীতি নির্ণয়ের ২টি রীতি। একটি প্রতীত্যসমুৎপাদরীতি, অপরটি পট্ঠানরীতি। পঠানকে প্রতীত্যসমুৎপাদেরই বিশদ ব্যাখ্যা বলা যেতে পারে। প্রতীত্যসমুৎপাদের ১২টি নিদান পট্ঠানে ২৪টি প্রত্যয়াকারে অতি সরলভাবে বর্ণিত হয়েছে।
উপসংহার
অভিধর্ম ত্রিপিটককে সমৃদ্ধ এবং উন্নত করেছে। অভিধর্ম বুদ্ধের দেশনা ও স্কন্ধকে বিশদ ও সঠিক ভাবে ব্যাখ্যা প্রদান করেছে। অভিধর্মপিটকের সর্বত্র ধর্মকে বৈজ্ঞানিক প্রণালিতে বিশ্লেষণ করার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। বৌদ্ধদর্শনের জটিল ও পরমার্থ সত্যকে যথাযথ পন্থায় ব্যাখ্যা করা হয়েছে ত্রিপিটকে। বুদ্ধের কোন বচন দুর্জেয় মনে হলে তার জন্য অভিধর্ম পাঠ অত্যন্ত জরুরী।