Home » কথাবত্থু গ্রন্থের রচনাকাল ও বিষয়বস্তু সংক্ষেপে আলোচনা কর। এই গ্রন্থকে কিভাবে ত্রিপিটকে অন্তর্ভুক্ত করা হল লিখ।
কথাবত্থু গ্রন্থের রচনাকাল ও বিষয়বস্তুর আলোচনা

কথাবত্থু গ্রন্থের রচনাকাল ও বিষয়বস্তু সংক্ষেপে আলোচনা কর। এই গ্রন্থকে কিভাবে ত্রিপিটকে অন্তর্ভুক্ত করা হল লিখ।

by Susmi
0 comment

ত্রিপিটকান্তর্গত গ্রন্থসমূহের মধ্যে কথাবত্থু একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। রচনানৈপুণ্য, আঙ্গিকবৈশিষ্ট্য এমন কি ভাষার দিক দিয়েও এটি অন্যান্য গ্রন্থের চেয়ে বৈচিত্র্যময়। যেই ধারাবাহিক গতানুগতিকতায় ত্রিপিটক গ্রন্থসমূহ রচিত তা হতে কথাবত্থুর রচনা পদ্ধতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। ত্রিপিটকের অন্যান্য গ্রন্থে কোথাও লেখকের নামোল্লেখ না থাকলেও কথাবত্থুতে রচয়িতার নাম স্পষ্টভাবে প্রদত্ত হয়েছে। বিশুদ্ধ বুদ্ধবাক্য অবলম্বনে সম্রাট অশোকের গুরু সঙ্ঘ নায়ক অর্হৎ স্থবির মোগ্গলিপুত্ততিস্স এই বিশাল গ্রন্থের রচয়িতা।

কথাবত্থু কি? 

কথাবত্থু অভিধর্ম পিটকের পঞ্চম গ্রন্থ। সুমঙ্গল বিলাসিনী নামক দীর্ঘনিকায়ের অট্ঠকথায় এটিকে অভিধর্ম পিটকের তৃতীয় গ্রন্থ বলে উল্লেখ  করা হয়েছে। এটাকে বৌদ্ধ দর্শন সম্পর্কীয় তর্কশাস্ত্র গ্রন্থ বলা যায়। এটি  Mr. A. C. Taylor কর্তৃক লন্ডন পালিটেক্সট সোসাইটি হতে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। শ্রীমতি রীস ডেভিড্স শ্রী . জে. আউং “Points of Controversy” নামে একটি ইংরেজী অনুবাদও প্রকাশ করেছেন। এটি ছাড়া শ্রীমতি রীস ডেভিড্স তাঁর  “Buddhist Psychology” গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণের কোনো অধ্যায়ে কথাবত্থু গ্রন্থে উল্লেখিত বহু বিষয়ের আলোচনা করেছেন।

কথাবত্থু গ্রন্থের রচনাকাল বিষয়বস্তু

কথাবত্থু গ্রন্থের রচনাকাল নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। তাঁদের মতে, এই গ্রন্থের কিছু অংশ অশোকের সমসাময়িক। অবশিষ্ট অংশ অশোকের পরে রচনা করে মূল গ্রন্থের সাথে যুক্ত করে দেয়া হয়েছে। তবে কোন অংশ পরে এবং কোন অংশ পূর্বে রচিত হয়েছিল তা বলা কঠিন। তবে  যেই অংশে শৈল, বৈটুল্লক, সংকন্তিক, হৈমবতিক, উত্তরাপথক প্রভৃতি ধর্ম সম্প্রদায়ের উল্লেখ দৃষ্ট হয় সেই অংশই অপেক্ষাকৃত পরবর্তীকালের বলে অনুমান করা হয়। কারণ প্রাক অশোক যুগে নিকায়গুলির অস্তিত্ব বর্তমান ছিল কিনা অন্য কোথাও উল্লেখ নেই।

বুদ্ধ: ধর্ম ও দর্শন by নীরুকুমার চাকমা

TK. 200 TK. 176

Professor Winternitz is of openion that “Tissa Moggaliputta might have completed a Kathavatthu in the third century B.C. but that work was augmented by additional portions of every time when a new heresy cropped up” 

পাসাদিকা সিংহলী ইতিহাস কাব্য মহাবংশ অনুসারে, অশোকের রাজত্বকালে তৃতীয় বৌদ্ধ মহাসঙ্গীতির অবসানে অর্হৎ স্থবির মোগ্গলিপুত্ততিস্স কথাবত্থু গ্রন্থটি রচনা করেন। থেরবাদ সম্বন্ধে লেখক তিস্স বা তিষ্য স্থবিরের সজ্ঞান আলোচনায় এই গ্রন্থ সমৃদ্ধ। মিথ্যাদৃষ্টিক বিরুদ্ধবাদীদের মিথ্যা অভিমত বা যুক্তি খণ্ডন করার উদ্দেশ্যে গ্রন্থের রচনা।

আরও পড়ুন:   অভিধর্ম শব্দের অর্থ কি? অভিধর্মের বিষয়বস্তু সম্পর্কে আলোচনা কর

প্রাকমৌর্য যুগে এবং অশোকের সমসাময়িক কালে বহু মিথ্যাদৃষ্টিসম্পন্ন সন্নাসী বৌদ্ধ সংঘে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে নানা প্রকার অনাচারের দ্বারা সংঘের সুনাম নষ্ট করে। তাঁরা শুধু বিনয়ের নিয়ম ভঙ্গ করে চলাফেরা করতো তা নহে, কেহ কেহ আবার নানা প্রকারের ভিন্নমতও পোষণ করতো। অবস্থায় কে সৎ বা প্রকৃত ভিক্ষু এবং কে মিথ্যাদৃষ্টিসম্পন্ন ভিক্ষু তা নির্ধারণ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল।

কথিত আছে, এই সময় সংঘের অবস্থা এমন হয়ে পড়েছিল যে, শীলবান ভিক্ষুরা সংঘের সম্পর্ক ত্যাগ করে অরণ্যে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। বহুদিন পাটলিপুত্রের অশোকারাম বিহারে প্রাতিমোক্ষ উপোসথ বন্ধ ছিল। সর্বাস্তিবাদ, মহাসাঙ্গিক, সম্মিতীয় প্রভৃতি সম্প্রদায়ের ভিক্ষুরা নিজেদের মতই বুদ্ধ প্রচারিত মতের সাথে অভিন্ন বলে প্রচার করতে থাকে। সমস্ত ভিন্ন ভিন্ন পরস্পর বিরোধী মতসমূহের সামঞ্জস্য বিধান পরমত খণ্ডনই এই গ্রন্থের প্রধান উপজীব্য। গ্রন্থকার প্রত্যেকটি মতই যুক্তি সহকারে খণ্ডন করে বিভাজ্যবাদই যে বুদ্ধের মূলনীতি তা প্রতিষ্ঠা করেন।

খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে বুদ্ধঘোষ যখন কথাবত্থুর উপর ভাষ্য গ্রন্থ রচনা করেন তখন এটি ২৩ টি অধ্যায়ে বিভক্ত ছিল। প্রত্যেক অধ্যায়ে হতে ১২টি প্রশ্ন এবং তাদের উত্তর প্রতুত্তর দেওয়া আছে। প্রশ্নগুলো সাধারণত বিবিধ প্রকার জটিল মিথ্যাদৃষ্টি সম্পর্কীয়।

ত্রিপিটকে অন্তর্ভুক্তকরণ

কথাবত্থু গ্রন্থটি নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বহু তর্ক বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। এর প্রধান কারণ হলতৃতীয় সঙ্গীতির অবসানে তিস্স মোগ্গলিপুত্ত কর্তৃক এই গ্রন্থ রচিত হওয়া সত্ত্বেও কেন এটিকে ত্রিপিটকের অন্তর্ভুক্ত করা হল? কারণ স্বরূপ বলা হয়েছে যে, ত্রিপিটকের অন্তর্গত বিষয়বস্তু নিয়েই এটি রচিত হয়েছে। এতে এমন কোন বিষয় যুক্ত করা হয়নি, যা ত্রিপিটকের কোথাও না কোথাও দৃষ্ট হয় না।

মূল ত্রিপিটকে যা আছে এতে উহারই পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে মাত্র। ত্রিপিটকের অন্তর্গত গ্রন্থসমূহের মধ্যে কথাবত্থু একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। কথাবত্থুর রচনা পদ্ধতি ত্রিপিটক গ্রন্থসমূহের রচনা পদ্ধতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এতে প্রতিটি অধ্যায়ে হতে ১২ টি প্রশ্ন এবং তাদের উত্তর প্রত্যুত্তর দেয়া আছে। উত্তরগুলি যথাযথ কিনা পরীক্ষা করার জন্য ত্রিপিটকের বিভিন্ন স্থান হতে উদ্ধৃতি প্রদান করা হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিনয় সূত্রপিটক হতে উত্তরগুলি নেয়া হয়েছে। আবার কিছু কিছু বাক্য বা বাক্যাংশ অভিধর্ম পিটকের ধম্মসঙ্গনী বিভঙ্গ হতেও নেয়া হয়েছে। এর দ্বারা ত্রিপিটক শাস্ত্রের প্রাচীনত্ব প্রমাণিত হয়।

তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়কথাবত্থু গ্রন্থটা ত্রিপিটকের অন্তর্ভুক্ত হওয়া খুবই সমীচীন এবং যুক্তিসঙ্গত। বিভিন্ন জটিল দার্শনিক তত্ত্বের উত্তর প্রত্যুত্তর প্রদান রচয়িতার কুশলী শক্তি অভিজ্ঞ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক। এতে লেখকের সুগভীর মননশীলতা সুরুচিপূর্ণ অনুরাগ পরিস্ফুট।

কথাবত্থু গ্রন্থটা বিখ্যাত বৌদ্ধ গ্রন্থ মিলিন্দ প্রশ্নের সাথে তুলনীয়। তবে মিলিন্দ প্রশ্নে দেখা যায়স্থবির নাগসেন বৌদ্ধ সম্প্রদায় বহির্ভূত রাজা মিলিন্দের বিবিধ প্রকার জটিল প্রশ্নের যথাযথ প্রত্যুত্তর প্রদান করে স্বীয় মতের প্রাধান্য স্থাপন করেছেন। কিন্তু কথাবত্থুতে মোগ্গলিপুত্তের সাথে বৌদ্ধসংঘে অনুপ্রবিষ্ট বিভিন্ন মতবাদীদের কথোপকথন হয় এবং পরস্পর উত্তরপ্রত্যুত্তরের মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, লেখকের মতই যুক্তিযুক্ত।

উপসংহার

বৌদ্ধ সাহিত্যে কথাবত্থু একটি মূল্যবান সংযোজন। এতে আমরা যেমন বৌদ্ধ প্রজ্ঞার পরিচয় পায় তেমনি পরবর্তী যুগে অভিধর্ম শাস্ত্রের ক্রমবিকাশ সম্পর্কে একটি যথেষ্ট আলোকপাত করে। বিভিন্ন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ইতিহাস সম্পর্কে তাৎপর্যপূর্ণ নৈপুণ্য আঙ্গিক বৈশিষ্ট্য ভাষার অভিনবত্বে একটি ত্রিপিটকের গ্রন্থ সমূহের মধ্যে বৈচিত্রময় বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা পদ্ধতি বিচার করলে কথাবত্থুকে মৌলিক গ্রন্থ না বলে থেরবাদ মতের বিশ্লেষণ মূলক গ্রন্থ বলা যায়।

Related Posts