ব্যবসায়িক যোগাযোগ
ব্যবসায়িক যোগাযোগ যেমন- ক্রেতা, বিক্রেতা, কর্মী, সহযোগী ব্যবসায়ী, ঋনদাতা, সরকার ইত্যাদির সাথে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রক্ষা করতে হয়। ব্যবসায়িক প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হতে এর অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক বিভিন্ন পক্ষের সাথে যে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত করা হয় তাকেই ব্যবসায়িক যোগাযোগ বলে।
ব্যবসায়িক যোগাযোগের সংজ্ঞা
ব্যবসায়িক যোগাযোগ সম্পর্কে লেখক ও মনীষীদের মন্তব্য বা সংজ্ঞা নিম্নরূপ-
১. অধ্যাপক জে. হাস্ট-এর মতে, “সুষ্ঠুভাবে ব্যবসায় পরিচালনা ও সংগঠনের নিমিত্তে দুই বা ততোধিক ব্যক্তির মধ্যে যে যোগাযোগ সংঘটিত হয় তাকে ব্যবসায়িক যোগাযোগ বলে।”
২. চেস্টার আই. বার্নার্ড-এর মতে, “যোগাযোগ হলো ব্যবসায় পরিচালনার কেন্দ্রবিন্দু। আর ব্যবস্থাপকদের সব কাজই হলো যোগাযোগকেন্দ্রিক।”
৩. বি. লরেন্স-এর মতে, “ব্যবসায়িক যোগাযোগ হচ্ছে বাণিজ্য ও শিল্প সম্পর্কিত ধারণার প্রকাশ, পরিবেশন, গ্রহণ ও বিনিময় প্রক্রিয়া।”
উল্লিখিত সংজ্ঞায় প্রতীয়মান হয় যে, ব্যবসায়-বাণিজ্য সংক্রান্ত যে কোন বিষয়ে বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে পারস্পরিক যে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয় তাকে ব্যবসায়িক যোগাযোগ বলে। ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনার অভিপ্রায়ে একদিকে প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের সাথে ও অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানের বাইরের বিভিন্ন পক্ষের সাথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন পড়ে। প্রতিষ্ঠানের ভিতরের ও বাইরের বিভিন্ন পক্ষের সাথে ব্যবসায়িক প্রয়োজনে ভাব, তথ্য ও সংবাদের বিনিময়কেই ব্যবসায়িক যোগাযোগ বলে।
আরও পড়ুন: অফিসের কার্যাবলী আলোচনা কর
ব্যবসায়িক যোগাযোগের গুরুত্ব
মানুষ কার্যত সার্বক্ষণিকই যোগাযোগ নির্ভর। ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি আরও বেশি প্রযোজ্য। কারণ যোগাযোগ ব্যতীত আধুনিক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের কথা চিন্তাও করা যায় না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রক্ষা করেই ব্যবসায় পরিচালনা করতে হয়। নিচে আধুনিক ব্যবসায়ের যোগাযোগের গুরুত্ব বা প্রয়েঅজনীয়তা বর্ণনা করা হলো-
১. পরিকল্পন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন
ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য ব্যবস্থাপনাকে বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে হয়। আর যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমেই এরূপ কার্য সম্ভব। গৃহীত পরিকল্পনার সঠিক এবং ফলপ্রসূ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে যোগাযোগ বিশেষ সহায়তা প্রদান করে থাকে।
২. লক্ষ্য অর্জন
প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জনই ব্যবস্থাপনার মুখ্য উদ্দেশ্য। আর এ লক্ষ্য অর্জনের নিমিত্তে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত বিভিন্ন ব্যক্তি বা বিভাগের সমবেত প্রচেষ্টা পরিচালিত হয়। যোগাযোগের মধ্য দিয়েই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, কর্মচারী প্রত্যেকেই প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জনে সচেষ্ট থাকে। তাই লক্ষ্য অর্জনেও যোগাযোগের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
৩. তথ্যের বিনিময়
তথ্যের আদান-প্রদান ব্যতীত কোনো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যাবলি পরিচালনা করতে পারে না। কারণ যোগাযোগের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠানের ভিতরে ও বাইরের বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে তথ্য ও ভাবের বিনিময় ঘটে। তথ্য সংগ্রহ ও আদান প্রদানেও যোগাযোগ মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
৪. সিদ্ধান্ত গ্রহণ
একজন ব্যবস্থাপক প্রতিটা প্রয়োজনীয় মুহূর্তে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেই প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন। আর সুষ্ঠু যোগাযোগের মাধ্যমেই বিভিন্ন উৎস থেকে সঠিক তথ্যাদি সংগ্রহ করে তার আলোকে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়। তাই সিদ্ধান্ত গ্রহণেও যোগাযোগের গুরুত্ব কম নয়।
৫. সমন্বয় সাধন
প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জনের নিমিত্তে একজন ব্যবস্থাপক বিভিন্ন বিভাগীয় কার্যাবলির মধ্যে সবসময়ই সমতা বিধানের চেষ্টা করে। আর কার্যকরী যোগাযোগের মাধ্যমেই নির্বাহীর পক্ষে বিভিন্ন বিভাগীয় কাজের গতি প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা গ্রহণ এবং প্রয়োজনীয় সমন্বয় ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হয়।
৬. পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নয়ন
ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের ভিতরে বিভিন্ন ব্যক্তি বা পক্ষের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রেও যোগাযোগ একান্ত অপরিহার্য। বাইরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিবর্গের সাথেও যোগাযোগ রক্ষা করে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হয়। তাই অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক সম্পর্ক উন্নয়নকল্পেও যোগাযোগ অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৭. দক্ষতা ও মনোবল উন্নয়ন
ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের ভিতরে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মীদের দক্ষতা ও মনোবল বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও যোগাযোগ গুরুত্বপূর্ণ। কার্যকর যোগাযোগের অভাবে কর্মীদের মধ্যে অস্পষ্টতা, ভুল ধারণা ও ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। এতে কর্মীদের দক্ষতা ও মনোবলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মীদের দক্ষতা ও মনোবল উন্নয়ন সম্ভব হয়।
৮. কার্য সন্তুষ্টি বৃদ্ধি
প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী ও কর্মচারীদের কার্য সন্তুষ্টি বিধানেও যোগাযোগ অপরিহার্য। কারণ উচ্চ পর্যায়ের ব্যবস্থাপনার সাথে যদি নিম্নপদস্থ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য ও ভাব বিনিময় হয় তবে সকলের মধ্যকার পারস্পরিক বিশ্বাস ও সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটে। যা কার্য সন্তুষ্টি বিধানে সহায়ক হয়।
৯. ব্যবস্থাপকীয় দক্ষতার উন্নয়ন
আধুনিক ব্যবস্থাপনা বিশারদদের অনেকেই মনে করেন যোগাযোগই হলো ব্যবস্থাপনা। কারণ একজন ব্যবস্থাপক পরিকল্পনা গ্রহণ ছাড়াও এর বাস্তবায়নে নির্দেশ প্রদান ও তত্ত্বাবধানসহ সকল কাজেই যোগাযোগের ওপর নির্ভর করে। সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণেও যোগাযোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। তাই দক্ষ যোগাযোগ ছাড়া ব্যবস্থাপকীয় দক্ষতার উন্নয়ন সম্ভব নয়।
১০. সফল নেতৃত্ব সৃষ্টি
সফল নেতৃত্ব সৃষ্টিতেও যোগাযোগ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ অধস্তনদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব হলেই কোনো ব্যক্তি নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে। ঘন ঘন যোগাযোগের সুবাদেই নেতার প্রতি অধস্তনদের মনে দুর্বলতা, আনুগত্য বা সহানুভূতির সৃষ্টি হয়।
১১. প্রচারে সহায়তা
যোগাযোগ পণ্য ও সেবার বিজ্ঞাপন ও প্রচারণা বৃদ্ধিতেও অবদান রাখে। বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে লিখিত ও মৌখিক যোগাযোগের ফলে পণ্যের প্রচার ও বিক্রয় প্রসার ঘটে। এভাবে বাজার সম্প্রসারিত হয়- যা প্রতিষ্ঠানের জন্য ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়।
১২. গুজন নিরসন
গুজব অনেক সময় প্রতিষ্ঠানে বিভ্রান্তি, তথ্য বিকৃতি, ভুল বোঝাবুঝি এবং অসন্তোষ ছড়ায়। ফলে ব্যবস্থাপনা ও কর্মীদের মধ্যে পরস্পর সম্পর্কে ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়। সেরূপ অবস্থায় সুষ্ঠু যোগাযোগ এরূপ অনভিপ্রেত অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রতিষ্ঠানকে সাহায্য করে।
১৩. সামাজিক দায়িত্ব পালন
সামাজিক দায়িত্ব পালনেও যোগাযোগ বিশেষ ভূমিকা পালন করে। আধুনিক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান মুনাফা অর্জনের পাশাপাশি সমাজসেবামূলক কার্যাবলি সম্পাদনের ওপর গুরুত্ব দেয়। তাই সমাজের চাহিদা সম্পর্কে জানা এবং সমাজের প্রতি সেবামূলক কার্য সম্পাদনে যোগাযোগ ব্যবসায়ীদের সহায়তা প্রদান করে।
উপরিউক্ত আলোচনার আলোকে পরিশেষ বলা যায়, যোগাযোগ ভিন্ন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান পরিচালনা বর্তমানকালে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। প্রতিষ্ঠানের ভিতরে ও বাইরের বিভিন্ন পক্ষের সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পরিচালনায় দক্ষ ব্যবসায়ীগণ তাই বর্তমানকালে যোগাযোগের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করে থাকেন।