Home » মহাযান দর্শন বলতে কি বুঝ? মহাযান দর্শনের উৎপত্তির কারণ ও ক্রমবিকাশ আলোচনা কর

মহাযান দর্শন বলতে কি বুঝ? মহাযান দর্শনের উৎপত্তির কারণ ও ক্রমবিকাশ আলোচনা কর

by Susmi
0 comment

আজকের আলোচনার বিষয় মহাযান দর্শন কি এবং মহাযান দর্শনের উৎপত্তির কারণ ও ক্রমবিকাশ। আশাকরি আর্টিকেলটি থেকে অনেক উপকৃত হবেন।

ভূমিকা

বৌদ্ধ বিশ্বে বৌদ্ধধর্ম প্রধান দুই ধারায় প্রবাহিত। যথা- হীনযান বা স্থবিরবাদ এবং মহাযান। স্থবিরবাদের অর্থ প্রামাণিক ও প্রাচীন মতবাদ। এই মতবাদ মহাকাশ্যপাদি স্থবিরগণের পরম্পরায় অবিচ্ছিন্নভাবে চলে আসছে। স্থবিরবাদের ধর্মগ্রন্থ পালি ভাষায় সুরক্ষিত। স্থবিরবাদ ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, মায়ানমার, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া প্রভৃতি দেশে প্রচলিত। পক্ষান্তরে, মহাযান চীন, জাপান, কোরিয়া, মঙ্গোলিয়া, ভিয়েতনাম, তিব্বত, ভূটান প্রভৃতি দেশে বিদ্যমান। ’যান’ শব্দের অর্থ হলো মার্গ। যেমন আর্য-অষ্টাঙ্গিক মার্গকে ব্রক্ষ্মযান, ধর্মযান বলা হয়েছে। কিন্তু বৌদ্ধ সাহিত্যে ‘মহাযান’ নামে কোন শব্দের উল্লেখ নেই। ধারণা করা হয়েছে যে, মহাযান প্রবর্তক আচার্যগণের এটি কল্পিত নাম।

আরও পড়ুন:   জ্ঞানতত্ত্ব কি? ন্যায় জ্ঞানতত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা কর

মহাযান দর্শন

মহাযানীদের মতে, কেবল নিজের মুক্তির জন্য সাধনা করা স্বার্থপরতা ছাড়া কিছুই নয়।তাই তারা সকল মানুষের মুক্তির কৃচ্ছসাধনে পক্ষপাতী। বৌদ্ধদের কর্তব্য হল সমগ্র বিশ্বে কল্যাণ সাধনের জন্য কাজ করা।বুদ্ধের উপদেশও হল সর্ব জীবে দয়া করা। বিশ্ব প্রেম বা বিশ্ব কল্যাণই মহাযান সম্প্রদায়ের লক্ষ্য। হীনযানীদের মত মহাযানীরাও বিশ্বাস করে জগত দুঃথময়।তবে তারা হীনযানীদের মত দুঃখবাদী ছিলেন না, বরং আশাবাদী। মহাযান দর্শন হল জগতে ভালো -মন্দ , সুখ-দুঃখ সবই আছে। তা সত্ত্বেও প্রত্যেকের মুক্তি লাভের উপায় আছে। এছাড়াও মহাযানীদের আদর্শ বুদ্ধত্ব লাভ, হীনযানীদের ন্যায় অর্হত্ব লাভ নয়। তারা স্বয়ং নির্বাণ লাভে উন্মুখ না হয়ে জগতের হীতার্থে উৎসর্গ করা। মহাযান দর্শনে অপর একাট আদর্শ হল বোধিসত্ত্ববাদ বা বোধিসত্ত্বকল্পনা।

Riversong Stream N EA65 Neckband : Riversong

TK. 1,500 TK. 1,140

মহাযান দর্শনের উৎপত্তির কারণ

মহাযান ধর্মমতের ইতিহাস বিশাল ও বিচিত্র। হাজার বৎসর ব্যাপী শত শত মনীষীগণের চিন্তাধারার গতিছন্দে বিকাশ লাভ করেছিল এ ধর্ম দর্শনের বিভিন্ন শাখা প্রশাখা। পরম্পরাগত অভিমত এই যে, মহাসাংঘিক নিকায় হতেই মহাযানের উদ্ভব হয়। কিন্তু এ নিশ্চিতরূপে বলা কঠিন যে, বৌদ্ধসংঘের যে অষ্টাদশ নিকায়ের উল্লেখ পাওয়া যায় তাদের মধ্যে কোন কোন নিকায় মহাযানের বিকাশে সহায়তা করেছিল। হিউয়েন সাং এমন ভিক্ষুরও নামোল্লেখ করেছেন যে, যারা স্থবিরবাদী হয়েও মহাযান মতের অনুগামী ছিলেন।

ইৎসিংয়ের মতে, “অষ্টাদশ নিকায়ের মধ্যে কারা মহাযান, কারা হীনযান, বলা কঠিন”। তবে এ নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, অশোকের সময় পর্যন্ত মহাযানীরা প্রকটরূপে আত্মপ্রকাশ করতে পারেনি। তবে স্বীকার করতে হয় যে, অশোকের পর কনিষ্কের সময় পর্যন্ত যে সকল প্রবৃত্তি বিকাশ লাভ করেছিল তাতে মহাযানের পূর্বরূপের দর্শন পাওয়া যায়। তৎকালীন উত্তর-পশ্চিম ভারতে মহারাজ কনিষ্ক এক ধর্ম মহাসংগীতির অধিবেশন আহ্বান করেন এবং সেই অধিবেশনে “মহাবিভাষা শাস্ত্র” নামক এক মহাগ্রন্থ রচিত হয়। উক্ত অধিবেশনে স্থিরকৃত সিদ্ধান্তানুযায়ী দিকে দিকে ধর্মদূত প্রেরিত হয়, যার ফলস্বরূপ সুদূর চীন, জাপান, কোরিয়া, মাঞ্চুরিয়া প্রভৃতি দেশে বুদ্ধের বাণী সমূহ প্রচারিত হয় এবং তারই ফলশ্রুতি এক বিশাল ভূখন্ড বৌদ্ধধর্মের অমৃত বাণীতে সিক্ত হয়, যা মহাযান নামে পরিচিত হয়।

পরবর্তীকালে অষ্টাদশ নিকায়ের অন্তর্গত চার দার্শনিক সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। যথা- বৈভাষিক, সৌত্রান্ত্রিক, মাধ্যমিক শূন্যবাদ এবং যোগাচার বিজ্ঞানবাদ। এদের মধ্যে মাধ্যমিক শূন্যবাদ এবং যোগাচার বিজ্ঞান বাদই মহাযান, যাদেরকে আদর্শবাদী বলা হয়। মাধ্যমিক শূন্যবাদী মতে, যাকে ব্যবহারিক রূপে জীবন বলা হয় বস্তুতঃ তার কোন পারমার্থিক অস্তিত্ব নেই, প্রত্যেক বস্তু শুধু এক নিঃসার ভ্রান্তি মাত্র। স্বভাব শূন্য অর্থাৎ নিঃস্বভাব। আর যোগাচার বিজ্ঞানবাদীদের মতে, বাহ্য বস্তুর যথার্থ কোন সত্তা নেই, আন্তরিক বিচার মাত্র।

মহাযান দর্শনের ক্রমবিকাশ

মহাযান দর্শন মূলত আদর্শবাদী দর্শন। যোগাচার, মাধ্যমিক প্রভৃতি সম্প্রদায় বুদ্ধের দার্শনিক মতবাদ বিশ্লেষণ ও ব্যাখা করে পরমার্থ সত্য তত্ত্ব তাদের নিজ নিজ মতানুযায়ী প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস পেয়েছেন। মহাযানের আদিপর্যায়ে রচিত মহাযান সূত্রাবলী ছাড়াও পরবর্তীকালের মহাযান দার্শনিক ও কবিদের রচনায় মহাযান সাহিত্য বিপুল আকার ধারণ করে। পণ্ডিতদের মতে, মহাযান সূত্রাবলীর মধ্যে প্রাচীনতম গ্রন্থ অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা খৃঃ পূর্ব ১ম শতাব্দীতে রচিত হয়েছিল। সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা যায়, খৃষ্ট পূর্ব ২য় শতাব্দীতে মহাযান বৌদ্ধধর্মের আবির্ভাব ঘটে। প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্র, লংকাবতার সূত্র ও অন্যান্য মহাযান সূত্রাবলীতে মহাযানী শূন্যতা দর্শন, আলয় বিজ্ঞান, বিজ্ঞপ্তিমাত্রতা প্রভৃতি মহাযানী দার্শনিক তত্ত্বগুলো অসংলগ্ন, বিক্ষিপ্ত ও শৃঙ্খলাহীন ভাবে আলোচিত হয়েছে।

মহাযান বৌদ্ধসম্প্রদায়ের পরবর্তীকালে বিভক্ত প্রধান দুই শাখা মাধ্যমিক শূন্যবাদ ও বিজ্ঞানবাদের মধ্যে কোন শাখার দার্শনিক তত্ত্ব ঐ সূত্রগুলোতে আলোচিত হয়েছে তা সুনিশ্চিত ভাবে জানা যায় নি। বস্তুত দুই শাখার দার্শনিকগণ এই সূত্রগুলোকে মূল উৎসরূপে ভিত্তি করেই তাদের দার্শনিক সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণ ও উপস্থাপিত করেছেন। এই দুই শাখার মধ্যে মাধ্যমিক শূন্যবাদ শাখার প্রবর্তক হলেন আচার্য নাগার্জুন। তিনিই প্রথম প্রজ্ঞাপারমিতা ও অন্যান্য মহাযান সূত্রে বিক্ষিপ্ত ও অসংলগ্নভাবে আলোচিত শূন্যতাদর্শনকে সুবিন্যস্ত ও সুশৃঙ্খলভাবে উপস্থাপিত ও বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর পরে বুদ্ধপালিত, ভাববিবেক, চন্দ্রকীর্তি ও শান্তিদেব শূন্যবাদ প্রচার করেন।

আরও পড়ুন:   ন্যায় দর্শন কি? ন্যায় দর্শনে কার্যকারণ তত্ত্ব আলোচনা কর

যোগাচার বিজ্ঞানবাদের প্রবর্তক ছিলেন আচার্য মৈত্রেয়নাথ। কিন্তু যোগাচার বিজ্ঞানবাদ বিকাশরূপে দার্শনিক মর্যাদা লাভ করে যখন ভারতীয় দর্শন জগতে অসংগ এবং বসুবন্ধু প্রদীপ্ত ভাস্কররূপে আত্মপ্রকাশ করেন। এই দর্শন প্রণালীকে যারা দীর্ঘদিন স্থায়িত্ব দান করেন তারা হলেন স্থিরমতি, বিমুক্তি সেন, হরিভদ্র প্রমুখ দার্শনিকগণ। তারাই এই দর্শন চক্রের কাণ্ডারীরূপে একে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নেন। পরবর্তী পর্যায়ে দিঙনাগ, ধর্মকীর্তি, প্রজ্ঞাকর, ধর্মোত্তর, শান্তরক্ষিত, কমলশীল, কর্ণগোমী, মোক্ষাকর প্রভৃতি বৌদ্ধ দার্শনিকগণ এই দর্শন চক্রকে অবিচ্ছিন্ন ধারায় চালিয়ে নেন। তবে তাঁদেরকে দার্শনিক না বলে নৈয়ায়িক বলাই অধিক যুক্তিসংগত। কারণ এরাই বুদ্ধ এবং বৌদ্ধ দার্শনিকগণের তত্ত্বমীমাংসাকে যুক্তিতর্কের সুদৃঢ় ‍ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তবে এই দার্শনিকেরা মাধ্যমিক শূন্যবাদ অপেক্ষা যোগাচার বিজ্ঞানবাদের প্রতি বেশি অনুরক্ত ছিলেন।

উপসংহার

পরিশেষে বলা যায়, খৃঃ পূঃ ষষ্ঠ শতাব্দীতে তথাগত ভগবান বুদ্ধ যে দর্শনচক্র প্রবর্তন করেছিলেন, তাঁর অনুগামী শিষ্য-প্রশিষ্যগণ সেই দর্শনচক্রকে নিজ নিজ সম্প্রদায়ের মতানুসারে অর্থ স্থাপন করত দীর্ঘদিন চালিয়ে নিয়েছিলেন। এই দর্শনচক্রে সুদীর্ঘ চতুর্দশ বৎসরকাল পরিক্রমার পর পরিসমাপ্তি ঘটে খ্রিস্টীয় অষ্টম-নবম শতাব্দীতে। যখন শান্তরক্ষিত “তত্ত্বসংগ্রহ” নামক গ্রন্থ লিখেন, যাকে বৌদ্ধদর্শনের “প্রজ্ঞাসম্রাজ্ঞ” বলা হয়।

Related Posts