সিংহলী ঐতিহ্যানুযায়ী বৌদ্ধধর্ম সিংহল দ্বীপে প্রথম প্রবর্তন করেন স্থবির মহেন্দ্র খৃষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে। উক্ত সময়ে সিংহল দ্বীপের রাজা ছিলেন মুটসিবের দ্বিতীয় পুত্র দেবানংপিয়তিস্স। সিংহলের অনুরাধ পুরের নিকটবর্তী মিস্সক পর্বতে মহিন্দ্রের সহিত সিংহলের রাজা দেবানংপিয়তিস্সের প্রথম সাক্ষাৎকারের ঘটনাটি আখ্যানগুলিতে সুন্দরভাবে বর্ণিত রয়েছে। কথিত আছে, মহেন্দ্র রাজার জ্ঞানবেত্তার পরিচয় পেয়ে ”চুলহত্থিপদোপম সুত্ত” দেশনা করেছিলেন এবং উক্ত দেশনাই শ্রবণ করে রাজা স্বয়ং তাঁর অনুচরবৃন্দসহ বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।
মহেন্দ্র ও সংঘমিত্রার পরিচয়
মহেন্দ্র ও সংঘমিত্রা ছিলেন সম্রাট অশোকের পুত্র ও কন্যা। সংঘমিত্রা হলেন মহেন্দ্রের ছোট বোন। তাঁদের মাতার নাম পাওয়া যায় নি। রাজকন্যা হলেও সংঘমিত্রা মাতার নিকট বিদিশা নগরীতে বড় হন। পরিণত বয়সে অগ্নিব্রক্ষ্মা নামক এক যুবকের সাথে তাঁর পরিণয় ঘটে। অশোক ভ্রাতা তিস্স কুমার প্রবজ্যাকালে সংঘমিত্রার স্বামী অগ্নিব্রক্ষ্মাও প্রব্রজিত হন। পরবর্তীতে সম্রাট অশোক চুরাশি হাজার ধাতু চৈত্য ও পুত্র মহেন্দ্র এবং কন্যা সংঘমিত্রাকে বৌদ্ধধর্মে দান করেন। অচিরেই উভয়ই ধর্ম বিনয়ে পারদর্শীতা অর্জনসহ অর্হত্ব ফল লাভ করেন।
আরও পড়ুন: নির্বাণ বলতে কি বুঝ? নির্বাণ কত প্রকার ও কি কি? নির্বাণের বর্ণনা দাও।
সিংহলে বৌদ্ধধর্ম প্রচার ও প্রসারে মহেন্দ্রের অবদান
কথিত আছে, মহেন্দ্রের সাথে ছয়জন স্থবির যথা- ইত্থিয়, উত্তিয়, সম্বল, ভদ্দসাল, সংঘমিত্রার পুত্র শ্রমণ সুমন এবং উপাসক ভন্ডুকও সিংহলে গমন করেছিলেন। এরপর মহেন্দ্র স্থবির দেবানংপিয়তিস্স রাজার অনুরোধে অনুরাধপুরে গমন করেন। এটি জানা যায় যে, তাঁর দেশনায় মুগ্ধ হয়ে তথাকার অসংখ্য ব্যক্তি বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হন।
রাজা দেবানংপিয়তিস্স অনুরাধপুরের দক্ষিণে মহামেঘবনে বিহার নির্মাণ করে ভিক্ষুদিগের বসবাসের জন্য দান করেন। দীপবংসের বর্ণনানুযায়ী উক্ত মহামেঘবন মহাবিহার সিংহল দেশের প্রথম বৌদ্ধবিহার রূপে খ্যাতি লাভ করে এবং এটিই পরবর্তীকালে মহাবিহার সম্প্রদায়রূপে সুপ্রসিদ্ধ হয়।
বস্তুত: সিংহলের মহাবিহার পরিচয়ের অপেক্ষা রাখেনা। এটিকে বর্ণনা করা হয়েছে- The great center of Buddhist culture and learning in the island, the stronghold of the Theravada. মহেন্দ্র তথায় ছাব্বিশ দিন অবস্থান করে যথাক্রমে, অগ্গিক্খন্ধোপম সুত্ত, পেতবত্থু, বিমানবত্থু, সচ্চসংযুক্ত, দেবদত্ত সুত্ত, বালপণ্ডিত সুত্ত, ধম্মচক্কপ্পবত্তন সুত্ত ইত্যাদি দেশনার দ্বারা অসংখ্য ব্যক্তিকে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত করেন।
এটি ছাড়াও উক্ত রাজার সময়ে ভারতবর্ষ হতে বুদ্ধের পবিত্র চিতাভস্ম, বুদ্ধের ভিক্ষাপাত্র, বিভিন্ন বৌদ্ধশাস্ত্র ও বোধিবৃক্ষের শাখার আনয়ন সিংহল দ্বীপের ইতিহাসে একটি অভূতপূর্ব ঘটনা বিশেষ। এটি নিঃসন্দেহে উল্লেখ করা যায় যে, মহেন্দ্রের ধর্ম প্রচারের পূর্বে সিংহল দ্বীপে কোন সুসংবদ্ধ ধর্মের অস্তিত্ব ছিল না।
সিংহলে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার ও প্রসারে সংঘমিত্রার অবদান
থের মহেন্দ্র এবং থেরী সংঘমিত্রা উভয়ের ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মহর্ষি অশোক বোধিবৃক্ষের ১টি দক্ষিণ শাখা স্বর্ণপাতে আহরণ করে কন্যা সংঘমিত্রার হাতে অর্পন করলেন। সংঘমিত্রা আটজন বিচক্ষণ থেরীদের নিয়ে বোধিবৃক্ষের শাখাসমূহ নিয়ে জাহাজে চড়ে সাতদিনে লংকাদ্বীপে পৌঁছালেন। রাজা তিস্স রাজকীয় সম্মানে মহাবোধিবৃক্ষ শাখাসহ থেরী সংঘমিত্রা ও তাঁর সহভিক্ষুণীদের অভ্যর্থনা জানালেন। রাজা বোধিবৃক্ষ শাখার স্বর্ণপাত্রটি নিজের মাথায় তুলে নিলেন এবং বোধিবৃক্ষকে লংকাদ্বীপের অধিপতিরূপে সম্মানিত করলেন।
অবশেষে মহাবোধি বৃক্ষের শাখাটিসহ মহেন্দ্র, সংঘামিত্রা এবং অপরাপর বহু ভিক্ষু-ভিক্ষুণীসহ রাজা তিষ্য মহামেঘ উদ্যানে গমন করলেন। সেখানে আরো বহু লোকের সমাবেশে জনারণ্য সৃষ্টি হল। সেই মহা সমাবেশে সকলকে বিস্মিত করে অলৌকিক শক্তিতে মহাবোধি বৃক্ষের পূর্বদিকের শাখায় একটি হীন ফল উৎপন্ন হল। সেই ফল মুহুর্তে মাটিতে পতিত হয়ে অঙ্কুরিত হয়ে আরো আটটি শীষ গজাল। সেগুলো থেকে আরো চারটি করে বাড়তে বাড়তে মোট বত্রিশটি শীষ বত্রিশ জায়গায় রোপন করে লংকা দ্বীপে মহাবোধিবৃক্ষ স্থাপিত হলো ভিক্ষুনী সংঘমিত্রার অবদানে।
মহাবোধিবৃক্ষ প্রতিষ্ঠার পর প্রব্রজ্যার জন্য উন্মুখ হয়ে উপাসিকা বিহারে অপেক্ষারত অনুলাদেবীসহ পাঁচশত রমণীকে সংঘমিত্রা প্রব্রজ্যা প্রদান করেন। তারা অচিরেই অর্হত্বফল লাভ করলেন। ভিক্ষুণী সংঘমিত্রাও ভিক্ষুনীদের সাথে উপাসিকা বিহারে অবস্থান করতে লাগলেন।
সংঘামিত্রা পরে বারোটি সৌধ নির্মাণ করলেন। সেই সৌধগুলোর তিনটির মধ্যে একটিতে সংরক্ষিত হলো বোধিশাখা নিয়ে আসা জাহাজের মাস্তুল। আরেকটি হাল এবং অপর একটিতে হালের দাড়। এগুলোর নামেই সেই তিনটি সৌধের নামকরণ হলো যথাক্রমে- চুলগনাগার, মহাগনাগার এবং সিরিবদ্ধাগার। সহস্র ভিক্ষুণী যেই বিহারে অবস্থান করতেন সেটা ছিল বহু ভিক্ষুণীর বাস। তাই সেই বিহার ত্যাগ করে নির্জন স্থানে অবস্থান করতে চিন্তা করলেন।
এছাড়াও এই অনাকীর্ণ বিহার ভিক্ষুণীসংঘের সংকুলান না হওয়ায় আরেকটি আরামেরও চিন্তা করলেন। ধর্মের উন্নতিকামী ও ভিক্ষুণীগণের মঙ্গলকারীনী মহান ভিক্ষুণী সংঘামিত্রা উক্ত বিহার ত্যাগ করে সেই দূরের নির্জন স্তুপ আগারে গিয়ে অবস্থান করলেন। থেরী ভিক্ষুনীর আবাস ত্যাগের বিষয় জ্ঞাত হয়ে স্তুপ আগারের সন্নিকটেই আরো একটি ভিক্ষুণী আবাস নির্মাণ করালেন। আবাসটি হস্তী খুটির নিকটে হওয়ায় সেটাকে হস্তী আড়হক বিহার বলা হত। সর্বজনপ্রিয় মহাজ্ঞানী ভিক্ষুণী সংঘমিত্রা এরপর হতে সেই নব নির্মিত ভিক্ষুণী আরামেই অবস্থান করতেন।
উপসংহার
সিংহলে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য স্থবির মহেন্দ্র ও সংঘমিত্রার অবদান অবিস্মরণীয়। সিংহলে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারিত হওয়ার পর সিংহলের জাতীয় জীবনে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। পরে সিংহলে চতুর্থ সংগীতি অনুষ্ঠিত হলে সিংহল দ্বীপ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। সংঘমিত্রা ও মহেন্দ্র স্থবির মহাশ্রাবক না হলেও বৌদ্ধধর্ম প্রচার, প্রসার ও প্রতিষ্ঠায় অবদানের জন্য মহাশ্রাবকের ন্যায় আমাদের নিকট প্রতীয়মান হয়।