Home » লক্ষণসূত্র কোন নিকায়ের অন্তর্গত? এ সূত্র অবলম্বনে বুদ্ধের ৩২ প্রকার লক্ষণ সম্পর্কে আলোচনা কর

লক্ষণসূত্র কোন নিকায়ের অন্তর্গত? এ সূত্র অবলম্বনে বুদ্ধের ৩২ প্রকার লক্ষণ সম্পর্কে আলোচনা কর

by Susmi
0 comment

বৌদ্ধদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ হল ত্রিপিটক। ত্রিপিটক বলতে তিনটি পিটককে বুঝায়। সেগুলো হল বিনয় পিটক, সূত্ত পিটক ও অভিধর্ম পিটক। সুত্ত পিটকের প্রথম বিভাগ দীর্ঘ নিকায়ে মোট ৩৪ টি দীর্ঘ মাপের সূত্র আছে। তার মধ্যে লক্ষণ সূত্র হচ্ছে ৩৩ তম সূত্র। এই সূত্রটি দীর্ঘনিকায়ের পটিকবর্গের একটি অন্যতম সূত্র। এই সূত্রে ৩২ প্রকার মহাপুরুষের লক্ষণ সমূহ সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে।

লক্ষণ সূত্র

লক্ষণ শব্দের অর্থ হল চিহ্ন। এর প্রতিশব্দ প্রতীক, প্রতিরূপ, মূর্তি, দৃশ্যমান চিহ্ন, নিদর্শন, সংকেত ইত্যাদি। লক্ষণ সূত্রটি ত্রিপিটকের অন্তর্গত দীর্ঘ নিকায়ের অন্তর্ভুক্ত। এই সূত্রে ৩২ প্রকার মহাপুরুষ লক্ষণ সম্বন্ধে বুদ্ধের উপদেশ আছে। সেই সকল মহাপুরুষ লক্ষণ থাকলে যেকোন ব্যক্তি বা গৃহী চক্রবর্তী রাজা হয়ে বিনাদণ্ডে, বিনাশাস্ত্রে সসাগরা ধরিত্রীকে শাসন করবেন। আর যদি প্রব্রজ্যিত হন তাহলে অর্হৎ সম্যক সম্বুদ্ধ হয়ে বহুজনের হিতের জন্য ধর্ম প্রচার করবেন।

আরও পড়ুন:   কথাবত্থু গ্রন্থের রচনাকাল ও বিষয়বস্তু

বুদ্ধের ৩২ প্রকার লক্ষণ

লক্ষণ সূত্র অবলম্বনে বুদ্ধের ৩২ প্রকার মহাপুরুষের লক্ষণ সমূহ সম্পর্কে নিচে বর্ণিত হল-

১. সুপ্রতিষ্ঠিত পদ বা সমতল বিশিষ্ট পদতল। বুদ্ধগণ বোধিসত্ত্বাবস্থায় কায়িক, বাচনিক ও মানসিক সৎকর্ম সম্পাদন করেন। তারা দান, শীল প্রতিরক্ষা করেন, আদিগুরু মাতা-পিতা ও শ্রামণ, ব্রাক্ষ্মণগণের প্রতি সম্মান, শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন তথা বহুবিধ কুশল কর্ম সম্পাদন করেন, এজন্য তারা অন্তিম জন্মে সুপ্রতিষ্ঠিত পাদ হয়ে সমভাবে মাটিতে পদক্ষেপ, সমভাবে উত্তোলন ও সমভাবে সম্পূর্ণ পদতল দ্বারা ভূমি স্পর্শ করতে পারেন। এটি তথাগতের প্রথম মহাপুরুষের লক্ষণ।

বৌদ্ধ অনুচিন্তা: অমল বড়ুয়া - Bouddho Anuchinta: Amal Barua

TK. 275 TK. 237

২. দুই পদতলে দুটি চক্র। বুদ্ধগণ বোধিসত্ত্বাবস্থায় জীবগণের সুখবিধান করেন। তাদের ভয়, সন্ত্রাস, চিন্তা, যথাসম্ভব দূরীভূত করেন। আশ্রয়হীনকে আশ্রয়, অন্নহীনকে অন্ন, ভয়ার্তকে ভয় হতে মুক্তি, জীবদেরকে ধর্মানুযায়ী রক্ষার ব্যবস্থা, সাধ্যমত সব প্রয়োজনীয় বস্তু প্রদর্শন পূর্বক প্রাণীর স্বস্তি বিধান করেন। আর সে কারণেই তারা অন্তিম জন্মে স্বীয় পদতলে সহস্র অর, নেমি ও নাভিযুক্ত, সর্বাকারে পরিপূর্ণ ও সুবিভক্ত চক্র সমন্বিত হয়। এটি তথাগতের দ্বিতীয় মহাপুরুষ লক্ষণ।

৩. আয়ত পাষ্ণি বা পরিপূর্ণ পায়ের গোড়ালি।

৪. হস্ত ও পদের আঙ্গুল সমূহ সাধারণ অপেক্ষা দীর্ঘ।

৫. ব্রক্ষ্মার ন্যায় দিব্য ঋজুতা সম্পন্ন শরীর। তথাগতগণ বোধিসত্ত্বকালে জীবের সুখ বিধান করেন, প্রাণী হত্যা হতে বিরত থাকেন, অস্ত্র ও শস্ত্র হাতে নেন না, পাপের ঘৃণা ও ভয় করেন, আর সমস্ত প্রাণীর প্রতি মৈত্রীভাব পোষণ করেন।

৬. মৃদু-তরুণ হস্ত পাদ সম্পন্ন।

৭. জাল হস্ত- পাদ সম্পন্ন।

৮. পাদতলের মধ্যস্থলে স্থিত গুল্ফ-সন্ধি বিশিষ্ট।

৯. অদৃঢ় যুক্ত পাদ।

১০. লোম সমূহের অগ্রভাগ উর্দ্ধমূখী। তথাগতগণ বোধিসত্ত্বাবস্থায় মানবগণের অর্থবহ ধর্মযুক্ত, হিতকর কল্যাণমূলক উপদেশের মাধ্যমে অনেকের বিবিধ মঙ্গল সাধন করেন। সেকারণে শেষ জন্মে গমনকালে সম্মুখ ও পশ্চাৎ হতে পদতল দৃষ্ট হয়। সাধারণ মানব হতে ভিন্নতর হয়ে দেহের লোমসমূহ উর্দ্ধমূখী হয়েছিল। পাদ গ্রন্থিসমূহ ছিল সুব্যস্থিত। তদুপরি মাংস ও রক্তসহ বিস্তৃত ত্বক শোভিত হয়েছিল।

১১. ত্রণী-জঙ্ঘা বিশিষ্ট অর্থাৎ কৃষ্ণসার হরিণের ন্যায় মাংসল।

১২. চেহারা অতিশয় মসৃণ ও স্নিগ্ধ ত্বক।

১৩. সুবর্ণ বর্ণ। বুদ্ধ অতীত জন্মে বোধিসত্ত্বকালে ক্রোধহীন ও শান্ত চিত্ত ছিলেন। বহু বাক্যের বিষয়ীভূত হলেও ক্ষোভ, দ্বেষ, বিরোধের বশীভূত হতেন না। তিনি সূক্ষ্ম সুচিক্কন ও মৃদু ক্ষৌম ও ঔন আস্তরণ ও আস্বাদন দান করতেন। এজন্য তিনি সুবর্ণ ও কাষ্ণন সন্নিভ ত্বক সমন্বিত হন।

১৪. উপস্থ বা জনেন্দ্রিয় বারণ বৃষভের ন্যায় চর্ম্মাভ্যন্তরে লুকায়িত।

১৫. বটবৃক্ষের ন্যায় দীর্ঘ প্রস্থে আপাদমস্তক ও প্রসারিত বাহুর পরিমাণ সম শরীর।

১৬. অবনমিত শরীর।

১৭. সিংহের সম্মুখাংশ অঙ্গের ন্যায় পরিপূর্ণ শরীর।

১৮. পৃষ্ঠদেশ অবিভক্ত বা মাংস পটলে পরিপূর্ণ উন্নত বক্ষ।

১৯. সমগোলাকার গ্রীবা।

২০. সপ্তশত রসহরিণী সম্পন্ন শিরা। বুদ্ধ বোধিসত্ত্বাবস্থায় হস্ত, প্রস্তর খণ্ড বা অস্ত্রশস্ত্র দ্বারা প্রাণীর প্রতি হিংসা আচরণ করেন নি, তদ্বেতু তার রস বাহিনী স্নায়ু উর্দ্ধাগ্র হয়ে গ্রীবাদেশে জাত এবং সমভাবে বিক্ষিপ্ত ও তাতেই তিনি সপ্তশত রস অনুভব করতেন।

২১. অতি বিশুদ্ধ নীলবর্ণ চক্ষু।

২২. সদ্যজাত রক্তবর্ণ গো-বৎসের ন্যায় চক্ষু কোটর। পূর্বজন্মে বুদ্ধ কারোর প্রতি বক্র, তির্য্যক দৃষ্টি দিতেন না। তিনি সোজা ও অকপট দৃষ্টি সম্পন্ন ছিলেন। উদার মৈত্রী চিত্তে প্রিয় চক্ষুর দ্বারা দর্শন বা দৃষ্টিপাত করতেন। সেজন্য তিনি অন্তিমকালে সম্যক সম্বুদ্ধ হয়ে গাঢ় নীল নেত্রধারী ও সদ্যজাত গোবৎসের ন্যায় পরিপূর্ণ ও নয়নাভিরাম চক্ষু কোটর সম্পন্ন হয়েছিলেন।

২৩. মস্তক রাজ মুকুট সদৃশ।

২৪. উর্ণালোম বা ভ্রুমধ্যস্থ শ্বেত রোমাবর্ত।

২৫. প্রত্যেক লোমকূপে এক এক খানা লোম।

২৬. দু’ পাটিতে ২০ টি ২০ টি ৪০টি দাঁত।

২৭. অবিবর বা ছিদ্রহীন সুসজ্জিত দন্ত। ভগবান বোধিসত্ত্বাবস্থায় পিশুন বাক্য ত্যাগ পূর্বক জীবন যাপন করতেন। একস্থানে গিয়ে সেখানে শ্রুত আলাপ আলোচনা অন্য স্থানে ভেদ উৎপাদনের নিমিত্তে প্রকাশ করতেন না। যারা কলহলিপ্ত, মতানৈক্য প্রতিষ্ঠিত তাদের মধ্যে মৈত্রীতা বৃদ্ধিতে সচেষ্ট থাকতেন। তজ্জন্য উপরোক্ত দুই মহাপুরুষ লক্ষণে তিনি বিভূষিত হন।

২৮. মৃদু, দীর্ঘ ও বিস্তৃত ‍বিলক্ষণ সম্পন্ন জিহ্বা।

২৯. মহা ব্রক্ষ্মার স্বর সদৃশ বিশুদ্ধ সুমধুর স্বর। তথাগত পূর্বজন্মে কর্কশ বাক্য না বলে সুমধুর, শ্রুতিমধুর, নমনীয়, হৃদয়গ্রাহী, বিনীত, বহুলোকের প্রীতি উৎপাদক ও মনোজ্ঞ বাক্য ভাষণ করতেন। ফলে তিনি উপরোক্ত লক্ষণদ্বয় প্রাপ্ত হন।

৩০. সিংহের নিম্মস্থ হনু বা চোয়াল সদৃশ পরিপূর্ণ হনু। ভগবান পূর্বজন্মে কালবাদী, ভুতবাদী, ধর্মবাদী, বিনয়বাদী হয়ে যথাকালে যুক্তিপূর্ণ, অর্থবহ, সুবিভক্ত ও মূল্যবান বাক্য বলতেন। এ হেতুতে তার চিবুক সিংহের চিবুকের ন্যায় হয়েছিল।

৩১. এক সমান দন্ত।

৩২. শুক তারার জ্যোতি হতেও অত্যধিক সমুজ্জ্বল শুভ্র দন্ত।

ভগবান বুদ্ধ অতীত জন্মে পঞ্চবাণিজ্য যথা- মাংস, প্রাণী, অস্ত্র, বিষ ও মাদক বাণিজ্য ত্যাগ পূর্বক সম্যক জীবিকায় জীবিকা নির্বাহ করতেন। ফলে তিনি উপোরক্ত দুটি মহাপুরুষ লক্ষণ প্রাপ্ত হন।

উপসংহার

উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, লক্ষণ সূত্রের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল মহাপুরুষের ৩২ প্রকার লক্ষণ একমাত্র মহাপুরুষগণই উক্ত লক্ষণ সমূহ সম্পন্ন হন। এই লক্ষণ গুলো থাকলে যে কোন ব্যক্তি চক্রবর্তী রাজা হয়ে বিনাদণ্ডে ধরিত্রীকে শাসন করবেন, আর যদি প্রব্রজ্যিত হন তবে অর্হৎ সম্যক সম্বুদ্ধ হয়ে বহুজনের হিতের জন্য ধর্ম প্রচার করবেন।

আরও পড়ুন:   

খুদ্দক পাঠের একটি সম্যক ধারণা দাও এবং কুমার প্রশ্নগুলোর গুরুত্ব আলোচনা কর   

Related Posts