যেকোনো কিছু করার জন্য একটা পরিকল্পনা লাগে। বলা হয়ে থাকে, যার পরিকল্পনা যত নিঁখুত তার সফল হওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি। তাই আজকের এই আর্টিকেলে পরিকল্পনা কি বা পরিকল্পনা কাকে বলে এবং একটি উত্তম পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য কি কি হয় সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো। আশাকরি আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবেন।
পরিকল্পনা কি বা কাকে বলে?
পরিকল্পনা কি বা পরিকল্পনা কাকে বলে তা এককথায় বুঝানো সহজ নয়। আসুন কিছু বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে বুঝে নিই।
পরিকল্পনা হলো ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়ার সর্বপ্রথম ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কেননা পরিকল্পনার সাহায্যে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে কোনো কিছু করা কিংবা করা থেকে বিরত থাকার অগ্রিম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। তবে ভবিষ্যতে কি করা হবে তার জন্য পূর্ব হতে চিন্তা করে রাখার সাথে পরিকল্পনা সম্পর্কযুক্ত। সুতরাং, ভবিষ্যৎ কার্যক্রমের অগ্রিম সিদ্ধান্তকে পরিকল্পনা বলে।
আরও পড়ুন: ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনের মধ্যে পার্থক্য আলোচনা কর।
ব্যাপক অর্থে, যে বুদ্ধিদীপ্ত মানসিক প্রক্রিয়ার সাহায্যে কোনো লক্ষ্য অর্জনের জন্য সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত কর্মসূচি নির্বাচন করা হয় তাকে পরিকল্পনা বলে।
পরিকল্পনা সংজ্ঞা
পরিকল্পনা কি সে সম্পর্কে বিভিন্ন বিশারদ নিজেদের মতামত তুলে ধরেছেন যেগুলো পরিকল্পনার সংজ্ঞা হিসেবে বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। উল্লেখযোগ্য এরকম কয়েকটি সংজ্ঞা নিচে তুলে ধরা হলো-
১. W. H. Newman-এর মতে, “ভবিষ্যতে কি করা হবে তার অগ্রিম সিদ্ধান্তকে পরিকল্পনা বলে। অর্থাৎ, পরিকল্পনা হলো আগেভাগে চিন্তা-ভাবনা করে দাঁড় করিয়ে রাখা কর্মসূচি।” (“Planning is deciding in advance what is to be done, that is a plan is a projected course of action.”)
২. Griffin-এর মতে, “প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য প্রতিষ্ঠা করে সর্বোত্তমভাবে অর্জনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাকে পরিকল্পনা বলে।” ( “Planning means setting an organizational goals and deciding how best to achieve them.”)
অতএব, বৈজ্ঞানিক উপায়ে ভবিষ্যৎ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য স্থির করে সে অনুসারে নীতি নির্ধারণ ও ভবিষ্যৎ কর্মসূচি গ্রহণ করাকে পরিকল্পনা বলে।
উত্তম পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য
পরিকল্পনা হলো ভবিষ্যৎ কার্যক্রমের পূর্বনির্ধারিত প্রতিচ্ছবি। ব্যবস্থাপনা কার্য প্রক্রিয়ায় পরিকল্পনা প্রথম ও প্রধান গুরুত্বপূর্ণ কাজ। একটি উত্তম পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য কেমন হয় বা কি কি থাকে নিম্নে তার ধারণা দেয়া হলো-
১. ভবিষ্যৎমুখীতা
পরিকল্পনা ভবিষ্যৎমুখী হওয়া আবশ্যক। ভবিষ্যতে কি করা হবে, কি করা হবে না, এর একটা সুস্পষ্ট ছক পূর্বেই তৈরি করতে হবে। এজন্যই বলা হয়- পরিকল্পনা ভবিষ্যৎ কর্মসূচির মানসিক প্রতিচ্ছবি।
২. তথ্যনির্ভর
পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় আনুষঙ্গিক তথ্য সংগ্রহ করে পরিকল্পনার গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করতে হবে। একটি আদর্শ পরিকল্পনা অবশ্যই তথ্য ও অভিজ্ঞতা নির্ভর হওয়া আবশ্যক। পরিকল্পনার জন্য সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ করত হয়। তাই পরিকল্পনা প্রণয়নে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের উপর প্রাপ্ত তথ্যাদি বিবেচনায় এনে কার্যসম্পাদন করা হয়।
৩. নিরবচ্ছিন্নতা
পরিকল্পনা প্রক্রিয়া কখনো থেমে থাকার বিষয় নয়। নিরবচ্ছিন্নতা পরিকল্পনার একটি অত্যাবশ্যকীয় গুণ। একটি পরিকল্পনার কাজ সমাপ্ত হওয়ার সাথে সাথে অন্য পরিকল্পনার কাজ শুরু হয়। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র সময়কেই যে প্রাধান্য দেয়া হয় তা নয়। পূর্বের পরিকল্পনার সাথে মিল রেখে নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হয়।
৪. লক্ষ্য নির্ভর
পরিকল্পনার পিছনে যুক্তিসঙ্গত উদ্দেশ্য নিহিত থাকে। এ লক্ষ্যে মূল পরিকল্পনাকে ছোট ছোট কতিপয় পরিকল্পনায় বিভক্ত করা হয় এবং এ সমস্ত ক্ষুদ্র পরিকল্পনাগুলোর সাফল্যের উপর মূল পরিকল্পনার সাফল্য নির্ভর করে। এতে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন যেমন সহজ হয়, তেমনি শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতাও বজায় থাকে।
৫. সঠিক পথনির্দেশনা
পরিকল্পনার মাধ্যমে ভবিষ্যতে কি করতে হবে তার অগ্রিম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কোনো কাজ কে করবে, কেন করবে, কখন করা হবে- এসব প্রশ্নের সমাধান পরিকল্পনার মাধ্যমে করার চেষ্টা করা হয়। পরিকল্পনার মাধ্যমে পরিকল্পনাকারীর অধীনস্থ ব্যক্তিদেরকে সঠিক দিকনির্দেশনা দেয়া হয়।
৬. সময়
পরিকল্পনার কার্যকারিতা সময়ের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এর দ্বারা নির্দিষ্ট সময়ে প্রাপ্ত সুযোগ সুবিধার সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।
৭. পরিকল্পনার ব্যাপ্তি
প্রতিষ্ঠানের সকল স্তরই পরিকল্পনার আওতাভুক্ত। তাই কারবার প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী হতে ফোরম্যান পর্যন্ত সকলেই পরিকল্পনার সাথে জড়িত থাকে। ফলে সাংগঠনিক কাঠামোর সকল স্তরে কম বেশি পরিকল্পনার কাজ হয়।
৮. সঠিক বিকল্প গ্রহণ
প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য একাধিক পন্থা থাকে। এগুলোর মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট পন্থাটি বাছাই করাই হচ্ছে উত্তম পরিকল্পনা। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন বিকল্পগুলো সঠিকভাবে মূল্যায়ন করে উত্তম বিকল্পকেই পরিকল্পনা হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
৯. বাস্তবমুখী
কোনো বাস্তব উদ্দেশ্য অর্জনের নিমিত্তে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। এটি কোনো অনুমাননির্ভর কিংবা কল্পনাভিত্তিক পরিস্থিতির জন্য প্রণীত হয় না। অবাস্তব কথার ফুলঝুরিপূর্ণ পরিকল্পনা সবার মাঝে তাৎক্ষণিক কিছুটা আশাবাদ জাগালেও তা কখনো কাঙ্খিত ফল দেয় না। তাই বাস্তব অবস্থাকে ভিত্তি করে পরিকল্পনা করলে উত্তম ফল অর্জিত হয়।
১০. নমনীয়তা
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খাপ খাওয়ানোর যোগ্যতাকে নমনীয়তা বলে। যে কোনো পরিস্থিতি পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিকল্পনায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন এনে বাস্তব অবস্থার মোকাবিলা করতে হয়। তাই পরিকল্পনায় অবশ্যই রদবদলে ব্যবস্থা বা নমনীয়তার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
সবশেষে বলা যায়, মানবজীবনের কোনো কাজই পরিকল্পনা ছাড়া চলে না। প্রাতিষ্ঠানিক উদ্দেশ্যের সফল বাস্তবায়নের জন্য পরিকল্পনার উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রয়োগ ঘটাতে হয়। কেননা, পরিকল্পনা যদি সুষ্ঠু ও সুন্দর না হয় তাহলে প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য সকল কাজ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।