শ্রীলংকায় বৌদ্ধধর্ম প্রচারে সবচেয়ে ভূমিকা রাখেন সম্রাট অশোক। এজন্য তিনি বৌদ্ধধর্মে এক অবিস্মরনীয় এবং শ্রেষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক রাজা। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় তৃতীয় সংগীতি অনুষ্ঠিত হয়। তার সময়ে চুরাশি হাজার বুদ্ধ ধাতু চৈত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বৌদ্ধধর্মের ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের জন্য রাজকীয় কর্মচারী, ধর্মমহামাত্র নিয়োগ, বহির্বিশ্বে রাজাদের নিকট ধর্মদূত প্রেরণ, ভারতের মধ্য এশিয়া ও ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে ধর্ম প্রচারক হিসেবে ভিক্ষুদের প্রেরণ করেন। তারই ধারাবাহিকতা স্বরূপ তিষ্য স্থবির সিংহল দ্বীপে প্রেরন করেন মহেন্দ্র ও সংঘমিত্রাকে। তারাই সিংহল দ্বীপে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা।
শ্রীলংকায় বৌদ্ধধর্ম প্রচার
সিংহলী ঐতিহ্যমতে, খৃষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে স্থবির মহেন্দ্র সর্বপ্রথম সিংহল দ্বীপে বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তন করেন। সেসময় সিংহল দ্বীপের রাজা ছিলেন মূটসিবের পুত্র দেবানংপিয়তিস্স। থের মহেন্দ্র রাজগুরু তিস্স স্থবিরের নির্দেশে থের ইত্থিয়, উত্তিয়, সম্বল, ভদ্দসাল, শ্রামণ সুমন এবং উপাসক ভন্ডুককে সঙ্গে নিয়ে লংকাদ্বীপে গমন করেন। জানা যায়, তাঁর দেশনায় মুগ্ধ হয়ে তথাকার অসংখ্য ব্যক্তি বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নেন।
আরও পড়ুন:
মহেন্দ্র কে ছিলেন? সিংহলে বৌদ্ধধর্ম প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে মহেন্দ্র ও সংঘমিত্রার অবদান আলোচনা কর
শ্রীলংকায় বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস
স্থবির মহেন্দ্র সিংহলে গমন করে মিস্সক পর্বতে রাজা দেবনাম প্রিয় তিস্স ও তার চল্লিশ হাজার সৈন্যকে চলহত্থিপদোপম সুত্র‘ দেশনা করেন এবং উক্ত দেশনা শ্রবণ করে রাজা সৈন্যসহ বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। রাজা স্থবিরকে অনুরাধপুরে আমন্ত্রন জানিয়ে “মহামেঘবন” নামে একটি সুবৃহৎ সংঘারাম নির্মাণ করে দান করেন। এটি সিংহলের প্রথম বৌদ্ধবিহার এবং পরবর্তীকালে ‘মহাবিহার‘ সম্প্রদায়রূপে সুপ্রসিদ্ধ হয়।
মহামেঘবন মহাবিহার সম্পর্কে পন্ডিতগণ বলেন, “The great center of Buddhist culture and learning in the island, the stronghold of the Theravada”. থের মহেন্দ্র সেখানে ছাব্বিশ দিন অবস্থান করে বিভিন্ন সূত্র দেশনা করেন। ভারতবর্ষ হতে বুদ্ধের পবিত্র চিতাভস্ম, ভিক্ষাপাত্র, বিভিন্ন বৌদ্ধশাস্ত্র, বোধিবৃক্ষের শাখা আনয়ন, সিংহল রাজকুমারী অনুলাদেবীর থেরী সংঘমিত্রার নিকট প্রব্রজ্যা গ্রহনের দ্বারা সিংহলে ভিক্ষুণী সংঘের প্রতিষ্ঠা সিংহলের ইতিহাসে অভূতপূর্ব ঘটনা।
দেবানং পিয় তিস্স রাজার মৃত্যুর পর তাঁর ভ্রাতা উত্তিয় সিংহলের সিংহাসনে আরোহন করেন এবং উত্তিয়ের রাজত্বকালের অষ্টম বর্ষে থের মহেন্দ্র এবং নবম বর্ষে থেরী সংঘমিত্রার পরিনির্বাণ ঘটে। কথিত আছে রাজা উত্তিয় তাদের উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শনার্থে তাদের চিতাভস্মের উপর স্তূপ নির্মাণ করেছিলেন।
উত্তিয়ের পরবর্তীকালে সিংহল দ্বীপ তামিল আক্রমণকারীদের হাতে চলে যায়। রোহণের কাকবর্ণ তিসসের পুত্র দুট্ঠগামনী তামিল আক্রমণকারীকে যুদ্ধে হত্যা করে পুনরায় সিংহাসনে আরোহন করেন। দুট্ঠগামনীর দীর্ঘ ৪৪ বছর রাজত্বকালে বৌদ্ধধর্মের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। তাঁর সময়ে বিদেশী রাষ্ট্র হতে বহু বৌদ্ধ ভিক্ষুর আগমনে সিংহল বৌদ্ধধর্মের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় পীঠস্থানে পরিণত হয়।
রাজা বট্টগামনী অভয় খৃষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে সিংহলে রাজত্ব করেন। তিনি সিংহলের বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ নৃপতি বলে উল্লেখিত। তাঁর সময়ে সমগ্র ত্রিপিটক ও অর্থকথা লিখিত রূপ দেয়ার জন্য সংগীতি আহ্বান করা হয়। উক্ত সংগীতিতে পাঁচশত জন যোগ্য ভিক্ষু মাতল নামক স্থানের আলুবিহারে সমবেত হয়ে সমগ্র বুদ্ধবচন আবৃত্তি করেন। এতে বিনয়পিটকের সর্বশেষ গ্রন্থ পরিবার পাঠো যা স্থবির দীপ দ্বারা রচিত তা ত্রিপিটকের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
কথিত আছে, রাজা বট্টগামনী “অভয়গিরি” নামক একটি বিহার ও চৈত্য নির্মাণ করেন। জানা যায়, অভয়গিরিবাসী ভিক্ষুদের সাথে মহাবিহার বাসী ভিক্ষুদের সংঘাত বেঁধেছিল। পরবর্তীকালের ইতিহাসে দেখা যায়, সম্প্রদায় গুলির মাঝে বিভেদের সূত্রপাত হয়ে চারটি ভিন্ন ভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তবে কেবলমাত্র মহাবিহারবাসী ভিক্ষুদের মধ্যেই রক্ষণশীল বৌদ্ধধর্ম সংরক্ষিত হতে দেখা যায়। জানা যায়, তৃতীয় শতাব্দীতে রাজা বোহারিক তিসসের রাজত্বকালে বৈতুল্যবাদ নামক একটি সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। পরবর্তীতে চতুর্থ শতাব্দীর প্রথমার্দ্ধে রাজা গোঠাভয় বৈতুল্যবাদীদের দমন করে রাজ্য হতে বিতাড়িত করেন।
চীনা পরিব্রাজক ফা হিয়েন পঞ্চম শতাব্দীতে রাজা বুদ্ধদাসের সময়ে সিংহল পরিভ্রমণে যান। তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্ত অনুযায়ী সেসময় সিংহলে অভয়গিরিবাসী ভিক্ষুদের প্রাধান্য ছিল। পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যভাগে রাজা মহানামের সময়ে সুপ্রসিদ্ধ টীকাকার আচার্য বুদ্ধঘোষ সিংহলদ্বীপে গমন করেন। সেসময় তিনি সিংহলী ভাষায় রচিত ত্রিপিটক গ্রন্থসমূহের অর্থকথাগুলি পালি ভাষায় অনুবাদ করেন।
ষষ্ঠ শতাব্দী হতে পরবর্তী একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত কয়েকজন রাজার নামোল্লেখ করা যায়, যথা– প্রথম মোগ্গলান ও কুমার ধাতুসেন, যারা বৌদ্ধধর্মকে তাদের আন্তরিক প্রচেষ্টার দ্বারা পরিশুদ্ধ করে ধর্মের অশেষ উন্নতি সাধন করেন। কিন্তু পরবর্তীতে প্রবল রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ভিক্ষুসংঘে বিশৃঙ্খলার জন্য বৌদ্ধসংঘের উন্নতি ও প্রসার সম্পূর্ণরূপে ব্যহত হয়। রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অস্থিরতা দমন করার লক্ষ্যে রাজধানী অনুরাধপুর থেকে পেলোন্নরুবতে স্থানান্তর করা হয়।
পরিশেষে রাজা প্রথম বিজয়বাহু (১০৭২ অব্দ) আক্রমণকারীদের পরাজিত করে সিংহাসনে আরোহন করেন। তাঁর রাজত্বকাল সিংহলের বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করেছে। পরবর্তীকালের সিংহলের ইতিহাস বহুলাংশে অন্ধকারাচ্ছন্ন। রাজা বিজয়বাহু ও রাজা পরাক্রমবাহুর মৃত্যুর পর সিংহলে বৌদ্ধধর্ম পুনরায় বিপর্যস্ত হয়। দ্বিতীয় বিজয়বাহু (১১৮৬–১২৫৭ অব্দ), রাজা নিস্সংকমল্ল (১১৮৯-১১৯৮ অব্দ), দ্বিতীয় পরাক্রমবাহু ও ষষ্ঠ পরাক্রমবাহু (১৪১২ – ১৪৬৮) রাজত্বকালে বৌদ্ধধর্ম বহুলাংশে সজীবতা লাভ করে। আবার পরবর্তীতে উন্নতির পাশাপাশি পশ্চিমী শক্তিগুলির আক্রমনে সিংহলদ্বীপে ঘোর দুর্দিন এসে উপস্থিত হয়। পর্তুগীজ, ওলন্দাজ ও বৃটিশ শক্তিবর্গ সিঙ্গলদ্বীপ আক্রমণ ও দখল করে। জানা যায়, ব্রহ্মদেশ, শ্যামদেশ প্রভৃতি বৌদ্ধদেশ হতে পণ্ডিতবর্গের সহায়তায় বৌদ্ধধর্ম ও সংঘ পুনরায় জীবনীশক্তি লাভ করে।
বলা বাহুল্য, বর্তমান যুগে সিংহলে বৌদ্ধধর্ম অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং বিশ্বের একমাত্র দেশ যার রাষ্ট্রধর্ম বৌদ্ধ। বর্তমানে সিংহলে তিনটি সম্প্রদায় দেখতে পাওয়া যায়। যথা– ১.শ্যামনিকায় (শ্যামদেশ হতে সৃষ্টি), ২.অমরপুর নিকায় (অমরপুর হতে সৃষ্টি), ৩.রামঞ্ঞনিকায় (রামঞ্ঞ দেশ হতে সৃষ্টি)। বর্তমানে উপরোক্ত তিনটি সম্প্রদায়ের মধ্যেই মিত্রতা রয়েছে। বস্তুত, সম্প্রদায়গুলি রক্ষণশীল স্থবিরবাদ সম্প্রদায়ভুক্ত। এদের মধ্যে কেবলমাত্র বিনয় নিয়মের রদবদল ব্যতীত অপর কোনরূপ পার্থক্য নেই।
উপসংহার
পরিশেষে বলা যায় যে, বর্তমানে সিংহল দ্বীপে বৌদ্ধধর্ম অন্যতম ধর্ম রূপে বিরাজমান। উক্তদেশের জনসংখ্যার সত্তরভাগ ব্যক্তি বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। এছাড়া, ছয় হাজারেরও বেশী বৌদ্ধবিহার সমগ্র দ্বীপটিতে ছড়িয়ে আছে, যাতে পনেরো হাজারেরও বেশী ভিক্ষু বসবাস করেন। বিহারগুলি কেবলমাত্র বসবাসের জন্য নহে তা শিক্ষাদীক্ষারও পীঠস্থান।