বৌদ্ধধর্ম ও বাঙালিদের ইতিহাসে অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান এক কালজয়ী প্রতিভার নাম। তিনি কর্ম ও পান্ডিত্যের অপূর্ব সমাহার সম্পূর্ণ এক ব্যক্তিত্ব। তিনি একাধারে প্রখ্যাত ধর্মগুরু, পন্ডিত,গ্রন্থকার, অনুবাদক,চিকিৎসক, পরিকল্পনাবিদ, সমাজসংস্কারক ও মানবদরদী। তার কর্ম ব্যাপৃতির সীমা স্বদেশের গন্ডি পেরিয়ে বহির্বিশ্বেও সম্প্রসারিত হয়েছিল। অতীশ দীপঙ্করের তিব্বত গমণ এক ঐতিহাসিক অধ্যায়।স্বদ্ধর্ম প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে তিনি তিব্বত গমন করেন। এভাবে শুধু ভারত বর্ষে নয়, ভারত বর্ষের বাইরেও তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল।
লামা কি?
তিব্বতীরা অত্যন্ত ধর্মভিরু।তাদের মধ্যে ধর্ম একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। তাদের প্রধান ধর্মগুরুর নাম দালাই লামা। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা তিব্বতে লামা নামে পরিচিত। লামা শব্দের অর্থ হল সর্বপ্রধান আর দালাই শব্দের অর্থ জ্ঞান সমুদ্র। অর্থাৎ দালাই লামা শব্দের অর্থ হল জ্ঞান সমুদ্রের সর্বপ্রধান।
১৩৯১ সালে প্রথম দালাই লামার আবির্ভাব ঘটে।দালাই লামাকে তিব্বতীরা বুদ্ধের অবতার মনে করে। তারা বিশ্বাস করে যখন কেউ দালাই লামার পদে অভিষিক্ত হয় তখনই ভগবান বুদ্ধের আত্না তার মধ্যে আবির্ভূত হয়।
অতীশ দীপঙ্কর কে ছিলেন?
ইতিহাস মতে, ৯৮২ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিভাগের অন্তর্গত মুন্সিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামে এই বাঙালি বৌদ্ধাচার্য জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম কল্যাণশ্রী ও মাতার নাম প্রভাবতী অনেকের মতে কল্যাণ শ্রী ছিলেন চন্দ্রবংশীয় রাজা এবং দীপংকরের প্রথম জীবনের নাম ছিল চন্দ্রগর্ভ। তার দুই ভাই পদ্মগর্ভ ও শ্রীগর্ভ। দ্বিতীয় সন্তান চন্দ্রগর্ভই পরবর্তীকালে অতীশ দীপঙ্কর নামে খ্যাত হন। মাত্র ১৯ বছর বয়সে রঙিন গৈরিক বস্ত্র পরিধান করে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হয়ে তার নাম হয় দীপংকর এবং অতীশ ও শ্রীজ্ঞান এই দুটি তার উপাধি বা অভিধা।
ঐতিহাসিক গোই লোচাবা বলেছেন, ভারতীয়রা যাকে সাহোর এবং তিব্বতীরা জাহোর বলত, সেই বিশাল রাজ্যের অধিপতি ছিলেন কল্যাণ শ্রী এবং তার স্ত্রী প্রভার গর্ভে তিনটি পুত্র জন্মগ্রহণ করেন। এই মধ্যম পুত্র চন্দ্রগর্ভই আমাদের মহামান্য প্রভু। ঐতিহাসিক সুমপা বলেছেন, তিনি (দীপংকর) পূর্ব ভারতের বিক্রমপুর নগরের কেন্দ্রস্থানে স্বর্ণধ্বজাবিশিষ্ট প্রাসাদে জন্মগ্রহণ করেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও সুশীল কুমার দে প্রমুখ পন্ডিতদের অভিমত, দীপংকর ছিলেন বাঙালি। তিব্বতী গ্রন্থ তাঞ্জুরে এর বহু প্রমান আছে।
তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম প্রচার ও প্রসারে অতীশ দীপঙ্করের অবদান
বৌদ্ধধর্ম প্রচারে অতীশ দীপঙ্করের অবদানের কথা বলতে গেলে প্রথমে তিব্বতে তার মহাযান বৌদ্ধ দর্শন প্রতিষ্ঠার কথা বলতে হয়। তিব্বতের প্রাচীন ধর্ম ছিল পোন ধর্ম। তন্ত্র-মন্ত্র, ভূত-প্রেত পূজা ইত্যাদি। রাজানুকূল্য শিথিল থাকলে এ ধর্মের আচার অনুষ্ঠান বৌদ্ধ ধর্মে প্রবেশ করে একে দুর্বল করে ফেলে।ফলে বিভিন্ন সময় বৌদ্ধ ধর্ম সংস্কার করার প্রয়োজন দেখা দিত। এ সময় অতীশ দীপঙ্করকে বৌদ্ধধর্মের সংস্কার করতে হয়েছিল। তাই তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম প্রচার ও প্রসারের জন্য আজও তার নাম সমভাবে উচ্চারিত হয়।
আরও পড়ুন:
কাশগড় কোথায় অবস্থিত? কাশগড়ে কখন কার নেতৃত্বে বৌদ্ধধর্ম প্রচারিত হয়?
তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম কতটুকু বিরাজমান ছিল তা পুরোপুরি জানা না গেলেও অতীশ দীপঙ্করের তিব্বত পরিভ্রমণের পর সেখানে বৌদ্ধধর্মের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার লাভ করেছিল তা সন্দেহাতীত। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীর আগে তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম আছে বলে এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নি।
কিন্তু কথিত আছে যে, খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষের দিকে এবং সপ্তম শতাব্দীর প্রথমার্ধে নম-রি –স্রোঙ-সন নামে এক শক্তিশালী শাসক তিব্বতবাসীদের একত্রিত করে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে তার মৃত্যুর পর তার পুত্র স্রোঙ-সন-গম-পো সিংহাসনে আরোহন করলে তিনি পরাক্রমের সাথে নেপাল ও চীন দেশ জয় করে সে দেশের রাজকন্যা বিবাহ করেন। বিবাহ পরবর্তী তিনি মহিষীদ্বয়ের প্রভাবে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু ইতিহাসে সেসবের পূর্ণাঙ্গ কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।
অতীশ দীপঙ্করের তিব্বত যাত্রা
একাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে রাজা জে – সে- হোড এর রাজত্বকালে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ হতে বৌদ্ধাচার্য গণ তিব্বতে এসেছিলেন। কথিত আছে ভারত বর্ষ থেকে দীপংকর শ্রীজ্ঞান উক্ত রাজার শাসনামলে ১০৩৮ অব্দে তিব্বতে গমণ করেছিলেন এবং তিব্বতীয় বৌদ্ধধর্মে নতুনরুপে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন।
অতীশ দীপঙ্কর ৫৯ বছর বয়সে তিব্বতে পদার্পন করলে তার পৃষ্ঠপোষকতায় “কালচক্রযান” (সময় ও কালবিভাগ গণনা সমন্বিত মতবাদ) তিব্বতে প্রসার লাভ করে।
তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম সংস্কার
তিব্বতের বৌদ্ধ রাজা জে- সে-হোড তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের উন্নতি কামনায় দীপংকরকে নিয়ে যাওয়ার জন্য স্বর্ণোপহার ও পত্রসহ বিক্রমশীলায় দূত প্রেরণ করেন। তিব্বতে পৌঁছার কিছুদিনের মধ্যেই দীপংকর শ্রীজ্ঞান ধর্ম সংস্কারের কাজে নিয়োজিত হন। তিব্বতে তখন ধর্ম চর্চার নামে অবাধ যৌনাচার,নরবলি,পশুবলি,গুপ্তবিদ্যা ও নানা রকম কুসংস্কার ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। অতীশ দীপঙ্কর তখন ধীরে ধীরে প্রজ্ঞা ও সংস্কারের মাধ্যমে এর সমাধান করেন। একারণে তিব্বতীদের তন্ত্র ও অনাচার পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন। উপরন্তু তিনি তিব্বতীয় লামা ধর্মকে কুসংস্কার হতে মুক্ত করেন।
বোধিপথ প্রদীপ
তিব্বতে গমণের তিন বছরের মধ্যেই আচার্য দীপংকর শ্রীজ্ঞান বোধিপথ প্রদীপ নামে গ্রন্থ রচনা করেন।এটি তার মহৎ জীবনের মর্মবাণী রুপে আজও তিব্বতবাসীদের কাছে সমাদৃত হয়ে আছে। তিনি যে প্রকৃত মহাযান ধর্ম মত তিব্বতে প্রচার ও প্রসার এবং প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট ছিলেন এই গ্রন্থটিতে তিনি সংক্ষিপ্তসার লিপিবদ্ধ করেন। এ গ্রন্থটি আজও তিব্বতীদের কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয়। তিব্বতের প্রতিটি বৌদ্ধ ভিক্ষুর কাছে এটি অবশ্য পাঠ্য এবং একান্ত পূজ্য।
বৌদ্ধ সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা
বোম-তোন-পা এর আগ্রহে অতীশ দীপঙ্কর মধ্য তিব্বতে যান। ইতোপূর্বে সেখানে আচার্য শান্তরক্ষিত তিব্বতে একদল শিক্ষিত বৌদ্ধভিক্ষু গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তারা বিপক্ষ মতবাদী হয়ে নিচিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীতে বোম-তোন- পা ও অতীশ দীপঙ্করের সাংগঠনিক ও ধর্ম ব্যাখ্যার ভিত্তিতে একটি প্রকৃত বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়।
ধর্মগ্রন্থ রচনা
দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান ধর্ম প্রচারের জন্য বিভিন্ন জায়গায় একের পর এক গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি যখন তিব্বতে যান সে সময় নেপালে বসে সংস্কৃত ভাষায় চর্যাসংগ্রহ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। পরবর্তীকালে তিব্বতে অবস্থানকালে বোধিপথ প্রদীপ নামে গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি বৌদ্ধ দর্শন সম্পর্কে ৩৫টি এবং তন্ত্র সম্পর্কে ৮৩টি গ্রন্থ রচনা করেন। অনেকের মতে তিনি প্রায় ২০০টি গ্রন্থের রচনা অনুবাদ ও সংশোধনের সাথে জড়িত ছিলেন।
জাতকের ভিত্তিতে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব
তিনি বুদ্ধের অতীত জীবনের কাহিনী বলে তিব্বতবাসীদের মনের গভীরে আসন পেতে নিয়েছিলেন। তিনি গৌতম বুদ্ধের ২০টি জাতকের কাহিনী বলে তিব্বতবাসীদের কুসংস্কার হতে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন। এছাড়া তিনি ধর্ম, কর্ম, ধর্মের মূল বিষয় নির্বান প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা করেন। এ সমস্ত বিষয় তিনি তিব্বতীবাসীদের নিকট ব্যাখ্যা করেছিলেন এবং তারারসে আদর্শ অনুসরণ করেই বৌদ্ধধর্মের মূল সত্যকে সঠিকভাবে গ্রহণ করতে পেরেছিলেন। ঐতিহাসিকদের মতে, He gave a thoroughly spiritual truth to the minds of the tibetar people.
উপসংহার
অতীশ দীপঙ্কর বাংলাদেশ ও বাঙালির অন্যতম আলোকিত সন্তান ও গর্বের ধন।তিনি সারাজীবন মানুষের হিতের জন্য,কল্যাণের জন্য কাজ করে গেছেন। বিশেষত তিব্বতের সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম ও সাহিত্যে অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের অবদান গৌরবজনক। তিনি দীর্ঘ ১৩ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে তিব্বতে সদ্ধর্মের জ্যোতি প্রজ্জ্বলন করেন। এছাড়াও তিনি নিজে রচনা ও অনুবাদ করে বহু গ্রন্থ রেখে যান।যা বৌদ্ধ দর্শন ও সাহিত্যে এক গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। তিনি তিব্বতবাসীদের হৃদয়ে স্থায়ী আসন পেয়েছেন তা সন্দেহাতীত।