Home » চাকমা বৌদ্ধদের প্রধান ধর্মীয় উৎসবগুলো সম্পর্কে আলোচনা কর
চাকমা বৌদ্ধদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব

চাকমা বৌদ্ধদের প্রধান ধর্মীয় উৎসবগুলো সম্পর্কে আলোচনা কর

by Susmi
0 comment

এই বিশাল পৃথিবীর বুকে ছোট বড় হাজারের উর্ধ্বে বিভিন্ন জাতির বসবাস। তন্মধ্যে বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিভিন্ন ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর বসবাস। তাদের মধ্যে চাকমারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। বাংলাদেশ একটি বহুভাষী, বহু বর্ণের, বহু সম্প্রদায়ের একটি জনবহুল দেশ। এই দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি ছাড়াও অন্যান্য অনেক জাতি বসবাস করে। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক জাতির মধ্যে চাকমাদের রয়েছে নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি, ইতিহাস ও বৈচিত্র্যময় জীবনধারা। চাকমা জাতির ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো বৌদ্ধ ধর্মের মূল সত্যকর্মের ফল ও পুনর্জন্মের রহস্য নিয়ে প্রতিফলিত। এই আর্টিকেলে চাকমাদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ও সামাজি অনুষ্ঠান সম্পর্কে আলোকপাত করা হবে।

চাকমাদের ধর্মীয় উৎসব ও সামাজিক অনুষ্ঠান

চাকমারা আদি বৌদ্ধ ধর্মালম্বী জাতি। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ভৌগলিক ও ধর্মীয় উত্থান পতনের ধারায় পরিবর্তন ধর্মের নিয়ম অনুসারে তাদের মধ্যে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান ও ভাবধারা ঢুকে পড়েছে। চাকমাদের ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানাদি সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করা হল:

বৌদ্ধ ধর্মীয় উৎসব

চাকমাদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব বা পূজা পার্বন অনুষ্ঠানগুলো হচ্ছে- বৈশাখী বা বুদ্ধ পূর্ণিমা, মধু পূর্ণিমা, আষাঢ়ী পূর্ণিমা, প্রবারণা পূর্ণিমা, কঠিন চীবর দান উৎসব, মাঘী পূর্ণিমা ইত্যাদি। এসব অনুষ্ঠানগুলো বৌদ্ধ বিহারে গিয়ে উদযাপন করে। চাকমারা বৌদ্ধ বিহারে গিয়ে বুদ্ধ পূজা, পঞ্চশীল, অষ্টশীল গ্রহণ এবং উপাসনা-ধর্মালোচনার মাধ্যমে দিনগুলো উদযাপন করে থাকে এবং বিহারস্থ ভিক্ষুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় ধর্মানুষ্ঠানে গ্রামের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ আলোচনায় অংশ গ্রহণ করে উক্ত দিনের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেন এবং ধর্মালোচনা করেন। বিহারের প্রধান ভিক্ষু ও অন্যান্য ভিক্ষুরা জনগণের উদ্দেশ্যে ধর্ম উপদেশ প্রদান করেন।

বিঝু উৎসব

চাকমারা বাংলা বছরের শেষে দুই দিন ফুল বিঝু ও মূল বিঝু নামে এবং নতুন বছরের প্রথম ‍দিন গুজ্জেই পজ্জ্যাদিন নামে এই তিনটি দিন খুব ঘটা করে পালন করেন। এই দিনত্রয়কে সর্বশ্রেষ্ঠ সামাজিক উৎসবের দিন বলা চলে। ফুল বিঝু দিনে অর্থাৎ বাংলা বছরের সর্বশেষ দিনের আগের দিন প্রতি গৃহস্থ বাড়ির ছেলে মেয়ে অনেক সময় বয়োবৃদ্ধ পুরুষ মহিলারাও সকালে ঘুম থেকে উঠে বিভিন্ন ফুল চয়ন করে গৃহে আনে এবং সেই ফুল গুলি দিয়ে বুদ্ধ পূজা করে। ছেলেমেয়েরা ফুল দিয়ে বাড়ি সজ্জিত করে। মূল বিঝু বা বাংলা বছরের শেষ দিন প্রতি গৃহস্থের বাড়ির মেয়েরা সবজির সংমিশ্রণে পাঁচন রান্না করে। সেই সাথে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য তৈরি করে গৃহে আগত গ্রামবাসীকে খেতে দেয়। বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া, যুবক-যুবতী প্রভৃতি সমবয়সী ছেলেমেয়েরা নতুন জামা কাপড় অথবা চাকমা ঐতিহ্যবাহী পোশাকে চাকমা মেয়েরা পিনন খাদি পরে পুরুষ-স্ত্রী মিলিত হয়ে দলে দলে প্রতি গৃহস্থের বাড়িতে ঘুরে বেড়ায়। গুজ্জেই পজ্জ্যাদিন বা বাংলা বছরের প্রথম দিনে অর্থাৎ নববর্ষের প্রথম দিনে ধর্মপ্রাণ নরনারীগণ নিকটস্থ ক্যাং বা বিহারে গিয়ে বুদ্ধ পূজা এবং বৌদ্ধ ভিক্ষুদের উদ্দেশ্যে পিন্ড দান করেন। উপরোক্ত তিনটি দিনে চাকমাদের ধর্মীয় সামাজিক অনুষ্ঠানে অঙ্গীভূত।

আরও পড়ুন:   

প্রতীত্য সমুৎপাদ নীতি বা কার্যকারণ তত্ত্ব কি? কার্যকারণ তত্ত্ব কত প্রকার ও কি কি?

ছেলেমেয়ের জন্মোৎসব

কোন পরিবারে ছেলে মেয়ে ভূমিষ্ট হলে মনের শান্তিতে আমোদ উৎসব করে। উৎসবে গ্রামের মোড়ল ও গণ্যমান্য ব্যক্তিগণকে নিমন্ত্রণ করে শুকর, ছাগল, মোরগ ইত্যাদি মাংস দিয়ে খাওয়ানো হয় এবং তারা নবজাত ছেলে মেয়ের মঙ্গল কামনা করে আশীর্বাদ করে। অনেক সময় গরীব দুঃখীদেরকে ধান, চাউল, টাকা-পয়সা  ইত্যাদি দান করে নবজাতকের মঙ্গল ও দীর্ঘজীবন কামনা করা।

নোয়া বা নতুন ভাত উৎসব

স্মরণাতীত কাল হতে প্রায় প্রতিবার বছরে নতুন ভাত খাওয়ার সময় একটা ছোট/বড় নিমন্ত্রণের ব্যবস্থা করত। এটি সাধারণত: নতুন বছরের জুমের বা জমির ধান কেটে মাড়িয়ে গোলায় তোলার পর এই উৎসবের আয়োজন করা হত। এই উৎসব ‍বুধবারে (চাকমা সমাজে যা লক্ষ্মীবার হিসাবে চিহ্নিত) সম্পন্ন করা হয়।

বিবাহ উৎসব

চাকমা সমাজে দাভা/দাবীপ্রচলিত আছে। অর্থাৎ বিবাহ রীতি অনুযায়ী কনের পক্ষে বরের পক্ষ থেকে মদ, শূকর, টাকা, সোনা-গয়না ইত্যাদি দাবী করে থাকে। তবে বর্তমান বিবাহের দাভা ইত্যাদির কোন প্রচলিত নেই। সামাজিক প্রথা অনুসারে বাংলা বৎসরের পৌষ মাসে কোন বিবাহ হয়না। বৌ এর অলংকার, কাপড়, বৌয়ের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি ইত্যাদি বহন করার জন্য ফুল বারেংব্যবহার করা হত। এক প্রকার বাঁশের তৈরি ঢাকনাওয়ালা কারুকার্য্যখচিত থুরুর বিশেষ। বর্তমানে বাক্স ইত্যাদি ব্যবহার হয়ে থাকে। তবে অনেকের মধ্যে এখনও ঐ ফুল বারেং প্রচলিত। বিয়ের দিনে অলংকার কাপড় ইত্যাদি যাবতীয় দ্রব্যসম্ভার বরপক্ষ কন্যার পিতা মাতাকে কিংবা অভিভাবককে বুঝিয়ে দিলে, তার উপর গুরুজনদের তুলা ও তন্ডুলসহ আশীর্বাদ গ্রহণান্তর, ঐসব অলংকারসহ কন্যাকে বৌ সাজানো হলে, বৌ অতঃপর তার গুরুজনদের আশীর্বাদ গ্রহণ করে। বৌকে বরের ঘরে তোলার পূর্বে যুবতী ও কিশোরী মেয়েরা পানি কলসীতে ভরে ঐ পানির দ্বারা দরজায় মঙ্গলঘট স্থাপন করত। বৌকে ঐ পানি দিয়ে পা ধুয়ে ‍দিয়ে বরের বাড়ির ভিতরে নিয়ে গিয়ে একটি নির্দিষ্ট কক্ষে বসানো হয়। অতঃপর বৌদ্ধ ভিক্ষুদের নিকট পঞ্চশীল গ্রহণান্তর মঙ্গল সূত্রপাঠ শুনানো হয়। তারপর শাবালাতার দায়িত্ব কনের বাড়িতে গুরুজন স্থানীয়দের সঙ্গে আনীত খাদ্য দ্রব্য পরিবেশন, বস্ত্রালংকার ইত্যাদি দেখানো, বর ও কনেকে তাদের নির্ধারিত কামরায় সেই একই দিনের রাত্রিতে জোড়া বেঁধে দেয়। কনেকে বরের বামে পাশাপাশি বসিয়ে সাতহাত লম্বা একটা নতুন সাদা কাপড় দিয়ে কোমড়ে বেঁধে জোড়া বেঁধে দেওয়ার সম্মতি আছে কি নাবলার পর আছে, আছেবলে উত্তর দিতে হয়। এভাবে পরপর তিনবার বলার পর উত্তর দিতে হয়। এরপর বর কনেকে উক্ত কাপড়  দিয়ে শক্ত করে একত্রে কোমরে বেঁধে দেয়া হয়। এটিকে জদন বা বানাহ্ বলা হয়। তারপর সমাগত লোকদের অনুমতি নিয়ে সেই জদন খুলে দেয়া হয়। জদন খুলে দেয়া হলে বর কনে তাড়াতাড়ি আসন থেকে উঠে। সাধারণের বিশ্বাস যে আগে আসন হতে উঠতে পারে সংসারে তার হর্তাকর্তা চলে। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বর কনের বিবাহ সমাজে স্বীকৃতি পায়। বর কনেকে আংটি পরিয়ে দিয়ে মালা বদল করানো হয়। সমাগত লোকের কোলাহলের উৎসবে বাড়ি মুখরিত হয়। সামর্থ্যানুসারে বিবাহ উপলক্ষে যাত্রানুষ্ঠান গীত, বাদ্য ইত্যাদি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

বর-পারা পূজা

গৃহস্থের ভবিষ্যৎ কোন অমঙ্গলের সম্ভাবনা মনে করে অথবা কেবল গৃহস্পদের মঙ্গল কামনা করে শচিতা লাভার্থে এই পূজা করা হয়। এতে ওঝা বা বৈদ্যর দরকার হয়। এই পূজার দ্বারা গৃহস্থের অশুচিসমূহ দূর করা হয় বলে এটির অপর নাম মাথা-ধোওয়া। ওঝা উপস্থিত হয়ে  নদী তীরে পূজার ব্যবস্থা করেন এবং সাধারণত নতুন বছরের প্রথম ভাগে এই পূজা করা হয়। পূজার সময় গৃহস্থের সকলেই উপস্থিত থাকতে হয়। এতে যদিও বলির ব্যবস্থা আছে কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফুলের দ্বারাই এটির অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়ে থাকে।

থানমানা পূজা

এটি স্থান-দেবতা বা স্থাপত্য পূজা। এক বা ততোধিক গ্রামস্থ এক সমাজভুক্ত লোককে নিয়ে বড় রকমের আয়োজনে এই পূজা করা হয়।কাজেই এতে বহু লোকের সম্মেলন এবং  যুক্তভাবে পূজা হয়ে থাকে। প্রত্যেক গৃহস্থ হতে চাঁদা উঠিয়ে নদী বা ছড়ার তীরে এটির পূজা করা হয়। এতে বলির ব্যবস্থাও আছে। এই পূজার দ্বারা গ্রাম বা সমাজের ভবিষ্যৎ মঙ্গল কামনা করে পূজার কাজ সমাধান হয়ে থাকে। এটি অনেকটা বসুমতির পূজার মত স্থানীয় দেবতার উদ্দেশ্যে পূজা করা হয়। যার অর্থ স্থানকে পূজা করা। বর্তমানে এ ধরনের পূজা করা হয় না বললেই চলে।

শ্রাদ্ধ

দাহক্রিয়ার ৬ ‍দিন পরে সাপ্তাহিক ক্রিয়া হয়ে থাকে। এটাও এখন অনেকটা ধর্মীয় উৎসব হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে। এতে ভিক্ষু, শ্রামণসহ সমস্ত আত্মীয়দের ও সামাজিক লোকদের নিমন্ত্রণ করা হয় এবং গৃহীর সাধ্যমত অন্ন, ব্যঞ্জন প্রভৃতি বিবিধ ভোজ্য উপকরণ গৃহ সামগ্রী ভিক্ষু সংঘে মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে দান করা হয়। দানের সময় সকলে উপস্থিত থেকে মন্ত্র শ্রবণে দানের উৎসর্গ ক্রিয়া সম্পাদন করে থাকেন। অনেকে মৃত আত্মার উদ্দেশ্যে বার্ষিক ক্রিয়া দিয়ে থাকেন। পূর্বে শ্রাদ্ধ সময়ে আগরতারাপাঠ করা হত। সাপ্তাহিক ক্রিয়ার আয়োজনে নিরামিষ ভোজনই রীতি। অনেকে আবার আমিষের ব্যবস্থাও করে থাকেন।

রথ টানা/গাড়ি টানা

রাজা ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোক মারা গেলে গাড়ি টানার বিধান আছে। অবশ্য এটির কোন বাধ্য বাধকতা নেই। এতে সাধারণত ১০-১২ টা গাছের মোটা চাকা তৈরি করা হয়। নির্দিষ্ট দিনে গাড়ি, রাধাঘর ইত্যাদি বিবিধবর্ণে ৬ কারুকার্য্যে সজ্জিত করে তাতে শুকপাখি, বানর, হস্তি ইত্যাদির প্রতিকৃতি তৈরি করে শোভিত করা হয় এবং তার রক্ষিত গাছের পেটি তাতে উঠিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে টানাটানির প্রতিযোগিতা চলে। এটি ছাড়া অনুষ্ঠানে বাজি পোড়ানো, ঢোল বাজানো ইত্যাদির আয়োজন করা হয়। এই সব বড় ব্যাপারে বহু লোকের সমাগম হয়ে থাকে। কাজেই এই সব বৃহৎ অনুষ্ঠান বড় লোক ব্যতীত সমাধান করা সম্ভব নয়। রথ টানাটানির পর শব যথারীতি শ্মশানে দাহ করা হয়।

ভাত-দ্যা

মৃত্যুর পরে আবার জন্ম নিয়েছে বা আত্মার সদগতি ফলাফল জানার জন্য ভাদ্যা (নিমন্ত্রিত)। বৌদ্ধরা কর্মফল মানেন। চাকমা সমাজে মৃত আত্মার জন্মান্তরে কে কোথায় আছে এবং আত্মার সদগতি হল কিনা ইত্যাদি ও তাদের উদ্ধার লাভ করার উদ্দেশ্যে ভাদ্যা(পিন্ডদান) নামে এক বৃহৎ ধর্মানুষ্ঠানের প্রচলন বহু পূর্ব হতেই প্রচলিত আছে। 

পরিশেষে বলা যায় যে, চাকমারা একদিকে যেমন বৌদ্ধ ধর্মীয় উৎসব ইত্যাদি সমাপন করেন, অপরদিকে তেমন হিন্দুধর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট দেবদেবীর পূজা করেন। কিন্তু বর্তমান যুগে চাকমা সমাজে দেব-দেবীর পূজার পরিবর্তে বুদ্ধপূজা, সীবলী পূজা ইত্যাদি বৌদ্ধ ধর্মীয় রীতি নীতি প্রচলিত হচ্ছে।

Related Posts